শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

আওয়ামী লীগ নিজের মাথায় আঘাত করেছে



২০১২-০৩-১৬

কাজটা দুঃসাধ্য। তবু অভূতপূর্ব দক্ষতার সাথে আওয়ামী লীগ সে অসাধ্য সাধন করেছে- তারা নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করেছে। গত ১২ মার্চ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এবং গণতন্ত্রমনা আরো কায়েকটি দলের মহাসমাবেশ সম্বন্ধে অন্য কোনো রায় দেয়া সম্ভব নয়।
বিএনপি যদি সোমবার হরতাল ডাকত, সেটা এতটা সফল হতো কি না বলা কঠিন। কিন' শাসক দল আওয়ামী লীগ গায়ে পড়ে বিএনপিকে অভূতপূর্ব সাফল্য দিয়েছে। বিএনপি এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারিত মহা-মহাজোটের সমর্থকেরা মনে মনে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দেবেন।
অথচ এ দিনের কর্মসূচি বানচাল করে দেয়ার ওপর আওয়ামী লীগ তাদের ভবিষ্যৎ বাজি রেখেছিল। তিন দিন আগে থেকে তারা ঢাকাকে অবরুদ্ধ দুর্গে পরিণত করেছিল। আশা করেছিল যে, সে দুর্গে চোখ বন্ধ করে বসে থেকে তারা এই বলে আত্মপ্রতারণা করবে যে, বিএনপি মহাসমাবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের গদি এখন নিরাপদ। আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমতের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল শনি থেকে সোমবারের মধ্যে সেটা যে সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে চলে গেছে, শাসক দলের কোনো কোনো নেতা হয়তো এখনো সেটা বুঝে উঠতে পারেননি। বড় বড় কথা আর হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন, যেমন করে অন্ধকারের নিঃসঙ্গ পথিক ভয় কাটাতে শিস দেয়। বাংলাদেশের মানুষকে চিনতে অস্বীকার করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। 
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের শুরু থেকে আওয়ামী লীগ বরাবরই স্বৈরতন্ত্রী দল ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে এসে সেটা সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা পেয়ে তিনি যে সশস্ত্র ক্যাডার গঠন করেন, তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল বিএনপিকে বাকরোধ করার কাজে। বিএনপিকে তারা সভাসমাবেশের জন্য স'ান দেয়নি, রাজপথে বিএনপির মিছিলের ওপর অসংখ্যবার হামলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডা: ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডারেরা বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। আরো উল্লেখ্য, দ্বিতীয় দফা গদি পেয়ে শেখ হাসিনার সরকার ডা: ইকবাল ও অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় গদি পেয়ে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র ক্যাডারদের সংখ্যা বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে। এদের পোষা হচ্ছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ইত্যাদি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ছত্রছায়ায়। এবারে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে শুধু বিএনপিকে সভা-সমিতি আর মিছিল করা থেকে বঞ্চিত করাই নয়, বিএনপিসহ সব গণতান্ত্রিক প্রতিপক্ষকে সমূলে উচ্ছেদ করার কাজে। বিএনপিকে সভাসমাবেশ করার অনুমতি কিংবা স'ান দেয়া হয় না। দেয়া হলেও আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা একই সময়ে এবং একই স'ানে ভুয়া সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি ডেকে বসে। দলীয়কৃত প্রশাসন ‘ওপর-ওয়ালাদের’ নির্দেশমতো ‘শান্তি রক্ষার্থে’ ১৪৪ ধারা জারি করে বিএনপির সভা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বিগত তিন বছরে এমন ঘটনা বাংলাদেশের সর্বত্র অহরহ ঘটছে।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস'া ফিরিয়ে আনতে খালেদা জিয়ার আন্দোলনের সাফল্যে সরকার ভীত ও শঙ্কিত। রোডমার্চ করে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা খালেদা জিয়া সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে গেছেন। লাখ লাখ লোক সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে তাকে হর্ষধ্বনি দিয়েছেন, পথসভাগুলোতে তার বক্তৃতা শুনেছেন বহু লক্ষ লোক, নির্ধারিত সভাগুলোতে কয়েক কোটি লোক এ যাবৎ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে তার ভাষণে উৎসাহিত হয়েছেন। এসব সভায় নেত্রী একটাই দাবি করেছেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস'া ফিরিয়ে আনতে হবে। কোথাও যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গ মুখেও আনেননি। অথচ আওয়ামী লীগের গোয়েবলস আর তাদের প্রচারযন্ত্রগুলো দিন-রাত প্রচার চালাচ্ছে যে, খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের ‘বিচার’ বন্ধ করতে আন্দোলন চালাচ্ছেন।

গণভীতিতে বুদ্ধি বিভ্রম
বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে, তারা দেখছে এক দৃশ্য, কিন' আওয়ামী লীগ তাদের বোঝাতে চাইছে অন্য কিছু। এত দিন যারা দ্বিধাসঙ্কটে ভুগছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি যাদের কিছু সহানুভূতি অবশিষ্ট ছিল, তাদেরও এখন মোহভঙ্গ হয়েছে। তারা বুঝে গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ তাদের সাপের পাঁচ পা দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা জানতেন- অবাধে খালেদার ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ আন্দোলন চলতে দিলে কোটি মানুষ দেশের দূরদূরান্ত থেকে ঢাকায় আসত নেত্রীর মুখ থেকে কিছু আশার কথা শুনতে। জনতাকে এরা আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বমুখী চরম ব্যর্থতার কথা, এ সরকারের ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার কথা, বাংলাদেশকে আরেকটি সিকিম করার বিনিময়ে হাসিনার গদি চিরস'ায়ী করার কথা শুনতে দিতে চায়নি। জনতার প্রতি ভয় এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বুকে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১২ মার্চের ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ আন্দোলন ব্যর্থ করে দেয়ার উন্মাদ সিদ্ধান্ত সে জন্যই তারা নিয়েছিল।
বাংলাদেশের মানুষের নাগরিক অধিকার, তাদের মানবিক অধিকারকে যে আওয়ামী লীগ কানাকড়ি মূল্য দেয় না, ১২ মার্চ সেটা প্রমাণিত হয়েছে। কিন' সে জন্য তাদের কী মূল্য দিতে হবে, তারা ভেবে দেখেনি। নইলে এই চোরাবালিতে তারা পা দিতো না।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেকটি নাগরিকের নাড়ি রাজধানীর সাথে গ্রথিত। কাজকর্মে লোকে রাজধানীতে থাকে। তারা এবং তাদের পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে গ্রামের বাড়িতে যায়। কিন' আবার ঢাকায় ফিরে আসতে হয়। গ্রামীণ স্বাস'্যব্যবস'া নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি করছে। হাজারে হাজারে দলীয় কর্মী ও ক্যাডারকে তারা স্বাস'্য বিভাগে চাকরি দিয়েছে, কী স্বাস'্যব্যবস'া তারা দেবে? অতএব, অসুখ হলেই ঢাকায় নিতে হয় রোগীকে। সব ধরনের ব্যবসায়-বাণিজ্যের, এমনকি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতাদের ঘুষ দিতেও যেতে হয় ঢাকায়। প্রবাসী কর্মীদের কর্মস'লে ফিরে যাওয়ার বিমানও ছাড়ে ঢাকা থেকে।
শনি থেকে সোমবার- এই তিন দিন কোনো বাস, লঞ্চ এমনকি প্রাইভেট গাড়িও ঢাকায় আসতে দেয়া হয়নি। প্রবাসী কর্মীদের কতজন যথাসময়ে কাজে যেতে পারেননি বলে চাকরি খুইয়েছেন? চিকিৎসায় বিলম্ব হয়েছিল বলে কতজন হতভাগা প্রাণ হারিয়েছেন? তিন দিন অচল থাকা বাস, ট্রাক, লঞ্চগুলোর মালিকদের কত টাকা লোকসান হয়েছে? কত লোকসান দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা? কত মানুষ প্রতিদিন জেলাগুলো থেকে ঢাকায় আসেন?- তিন লাখ? পাঁচ লাখ? এক কোটি? নিজ দেশে অবাধে বিচরণ তাদের মানবিক অধিকার। সে অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার গুরুতর অপরাধ করেছে। ওপরে বর্ণিত তালিকার মানুষগুলোর আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের ওপর ক্রুদ্ধ না হওয়ার কোনো কারণ আছে?

সরকার বিএনপির হরতাল সফল করে দিয়েছে
অবরুদ্ধ রাজধানীর অবরুদ্ধ মানুষের ভোগান্তিও কম হয়নি। গণপরিবহন চলেনি ঢাকায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তারা কাজকর্মে যেতে পারেননি। পায়ে হেঁটে যারা গিয়েছিলেন কষ্ট করে পায়ে হেঁটেই তাদের ফিরতে হয়েছে। দোকানপাট বন্ধ ছিল। পরিবহন ব্যবসায়-বাণিজ্যের পূর্বশর্ত। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে পরিবহন বন্ধ ছিল বলে কত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের? রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ ছিল। এ সরকার শিক্ষাকে কেমন গুরুত্ব দেয় এই হচ্ছে তার নমুনা। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধ রেখে, রাজধানীকে দুই টুকরো করে আওয়ামী লীগ সরকার নাগরিকদের সবাইকে ক্রুদ্ধ, অপমানিত করেছে। তার ওপর সোমবার যে অভিজ্ঞতা সাধারণ নাগরিকদের হয়েছে তার তিক্ত স্বাদ দীর্ঘকাল তাদের মুখে লেগে থাকবে, আওয়ামী লীগের কথা মনে করে তারা থুথু ফেলবেন।
ঢাকাকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করার উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ১৯ দফা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সরকারের জ্ঞাত বিরোধীদের গ্রেফতার, যানবাহন তল্লাশি আর বিরোধী দলের সমর্থকদের যানবাহন হুকুমদখল (রিকুইজিশন) করার নির্দেশ সেই ১৯ দফার মধ্যে পড়ে। রাজধানীতেও সে দিন জনসমাবেশ বন্ধ করার জন্য পুলিশকে বহু নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সমাবেশের আগের সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ সমাবেশের অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে, রোববারের রাত বেশ খানিকটা বেড়ে যাওয়ার আগে মঞ্চ তৈরি করতে দেয়া হয়নি, কতগুলো মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যাবে তার সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়েছিল, এমনকি সমাবেশের লোক কোথায় দাঁড়াতে পারবে তারও একটা সীমারেখা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। 
‘অমৃত সায়রে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল’। আওয়ামী লীগের হয়েছে সে অবস'া। যতগুলো উদ্দেশ্যে তারা বিএনপির সমাবেশ বানচাল করতে চেয়েছিল তার প্রত্যেকটিরই হয়েছে উল্টো ফল। প্রকৃত প্রস্তাবে মাইক্রোফোনের অসুবিধা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার সমাবেশ আশাতিরিক্ত সফল হয়েছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা আমাকে বলেছেন, প্রায় তিন লাখ লোক সমাবেশে এসেছিলেন, সভা শুরু হওয়ার অনেক আগেই পুলিশের নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাবেশ।
খালেদা জিয়ার চারটি রোডমার্চ, বহু পথসভা ও জনসভা এবং আরো পরে বিভিন্ন জেলায় তার জনসমাবেশে কোথাও অশান্তি হয়নি। সোমবারও বিএনপি ও বিরোধী ১৬ দলের জোটের জোট থেকে কোথাও অশান্তি ঘটেনি। কিছু অশান্তি ঘটিয়েছিল ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা। তারা সমাবেশমুখী ছোটখাটো দলের ওপর হামলা করেছে। শেখ হাসিনার এই বরপুত্রদেরই আবার সরকার পুলিশের ভূমিকায় ব্যবহার করেছে। তারা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে লোকজনকে যানবাহন থেকে নামিয়ে এনেছে, তাদের দেহতল্লাশি করেছে।

বাক ও সংবাদের স্বাধীনতা হত্যা
লাখ পাউন্ড ব্যয়ে বিদেশে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে হাসিনা সরকার দাবি করেছে, বাংলাদেশে বাক ও সংবাদের স্বাধীনতা আদর্শস'ানীয়। কিন' এতকাল বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে অন্য ছবি। বিরোধী দলকে তারা সভা-সমিতি করতে দিতে নারাজ। সাংবাদিকদের ওপর বহু নির্যাতন হয়েছে। প্রায় এক ডজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে। খুনিরা অবশ্যই শাসক দলের কাছের মানুষ। নইলে এরা অবশ্যই ধরা পড়ত। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রুনি-সাগর দম্পতির হত্যা তদন্তের ভার নিয়েছেন, সে কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অন্য হাজারো ব্যর্থতার মতো এখানেও প্রধানমন্ত্রী চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। খুনিরা ধরা পড়েনি। শোনা যাচ্ছে, দুই খুনিকে নিরাপদে আমেরিকায় চলে যেতে দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সমাবেশের সরাসরি লাইভ সম্প্রচারের মধ্যেই একুশে টেলিভিশন, বাংলাভিশন ও ইসলামী টেলিভিশন চ্যানেল তিনটির সংযোগ কেটে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্বল্পবুদ্ধি নেতারা হয়তো নিজেদের ‘সাফল্যে’ বগল বাজাচ্ছেন। কিন' তারা ভুলে গেছেন যে, এই তিনটি চ্যানেলের লাখ লাখ দর্শক শা...বা... বলে সরকারকে গালি দিচ্ছেন, মনে মনে আওয়ামী লীগ নেতাদের মুণ্ডু চিবোচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষক দেশ ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি প্রীত হওয়ার মতো নয়। সোমবারের সমাবেশ সম্বন্ধে বিদেশী মিডিয়ার বিবরণ সে ভাবমূর্তিতে আরো কয়েক পোঁচ কালি লেপে দিয়েছে। লজ্জা-শরম বলে যদি কোনো কিছু এ সরকারের থেকে থাকে, তাহলে তাদের উচিত লম্বকর্ণ বিশিষ্ট একটি চতুষ্পদ জীবের মতো চিৎকার না করে সুস' মস্তিষ্কে বিএনপির ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে নিজেদের ভূমিকা খতিয়ে দেখা। খালেদা জিয়া ২৯ মার্চ হরতাল ডেকেছেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা না দিলে ১১ জুন আবার ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিলে নিজেদেরও অনেক কল্যাণ করবে।
(লন্ডন, ১৩.০৩.১২)
serajurrahman@btinternet.com

সংসদের ভাষা : অশালীনতার মাপকাঠিতে কে কোথায়



২০১২-০৩-২৩

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদে ফিরে গেছে, এটা ভালো কথা। সংসদে বসে তারা জাতির ও দেশের ভালোমন্দ বিবেচনা করবেন, সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন আর জাতিকে মহত্ত্বর, উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এসব উদ্দেশ্যেই ভোটদাতারা তাদের নির্বাচিত করেছিলেন। অন্তত নীতির দিক থেকে সেটা সত্যি কথা। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে নীতি আর বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান বঙ্গোপসাগরের মতোই দুস্তর। বাস্তবতা প্রায়ই নীতিকে খুঁজে পায় না।
সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট তাদের নিখুঁত আর সুগভীর তদন্তের জন্য বিশ্বব্যাপী সম্মানিত। ইকোনমিস্ট বলে দিয়েছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শের জোরে’। সে নির্বাচন যে ন্যায্য আর নিরপেক্ষ হবে না সেটা আগে থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনা নিজ মুখে স্বীকার করেছিলেন যে, ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদের বর্ণচোরা সামরিক স্বৈরতন্ত্র ছিল তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’। বিচিত্র নয় যে, সে সরকার শেখ হাসিনাকে গদিতে বসানোর জন্যই তৈরি হয়েছিল। তার ওপরেও বিএনপিকে ধ্বংস করার নানা চেষ্টা করেছে সে সরকার আর তাদের তৈরী নির্বাচন কমিশন। কমিশন বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করতে চেয়েছিল। নির্বাচনে বিএনপিকে হারানোর বহু কসরত হয়েছে, দু’টি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীও সে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিল।
ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। তা সত্ত্বেও বিএনপি গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাস্টারপ্ল্যানের পরাজয় মেনে নিয়েছিল এবং সংসদে যোগও দিয়েছিল। কিন' সেটাও বিদেশী সাহায্যে স'াপিত সরকারের সহ্য হয়নি। পরাজিত বিএনপির নাক মাটিতে ঘষে দেয়ার সব রকমের চেষ্টা করেছে ‘বিজয়ী’ দল। সংসদকক্ষে আসন বরাদ্দ, বিরোধী দলের কথা বলার অধিকার ইত্যাদি নিয়ে বহু নোংরামি হয়েছে। এমনকি সেসব ব্যাপারে স্পিকারও সব সময় নায্যতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেননি।
সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ছিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং ‘উজ্জ্বল নক্ষত্র’ তার কয়েকজন সহকারীর ভূমিকা। দিনের পর দিন তারা কদর্য ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে সংসদের পবিত্রতা নষ্ট করেছেন, সংসদকক্ষের প্রতিটি আনাচ-কানাচকে পূঁতিগন্ধপূর্ণ করে তুলেছেন। শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর দিল্লিতে ছিলেন। তারা খুব সম্ভবত নিজেদের স্বার্থের অনুকূল করে তাকে সহায়ক করে তুলেছেন। তিনি দেশে ফিরে এসেছেন এই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে যে, তার পিতা হত্যার পরের অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিসি'তিতে যারা রাষ্ট্রতরণীর হাল দৃঢ় হাতে ধারণ করে শিশুরাষ্ট্রকে অতলে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন, তারা সবাই তার পিতা ও পরিবারের হত্যাকারী এবং তাদের ক্ষমতা গ্রহণ চৌর্যবৃত্তিরই শামিল। লক্ষণীয় এই, শেখ হাসিনার এই চিন্তাধারা এসেছে তার এ বিশ্বাস থেকে যে, তার পিতা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সুতরাং বাংলাদেশ তার বংশানুক্রমে পাওয়া পৈতৃক সম্পত্তি।
শেখ মুজিব জীবিতাবস'ায় কখনো দাবি করেননি যে, তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। সত্যি বটে, স্বাধীনতা কথাটা তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে উচ্চারণ করেছিলেন। সে উচ্চারণ তার আগে মওলানা ভাসানী এবং অন্যরাও করেছেন। কিন' আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইত্যাদির জন্য যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন সে ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। শহীদ জিয়াকে সে কৃতিত্বটুকু দিতেও বর্তমান সরকার রাজি নয়, এমনই তাদের আক্রোশ।
জিয়াউর রহমান সংশয়পূর্ণ দেশ আর সেনাবাহিনীর আত্মঘাতী বিভ্রান্তির মধ্যে ক্ষমতায় এসে শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরেছিলেন। তিনি বাকশালী স্বৈরতন্ত্রকে উল্টে দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন, বাক ও সংবাদের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করেছিলেন, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দেশ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তার অবদান এত বেশি ছিল বলেই বোধ হয় তার বিরুদ্ধে হাসিনার ঈর্ষা ও ক্রোধ অন্তহীন। স্মরণীয় যে, ভারত থেকে হাসিনার দেশে ফেরার ১৩ দিনের মাথায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন। সে ষড়যন্ত্রে কে বা কারা জড়িত থাকতে পারে সে সম্বন্ধে তখন অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছিল। জিয়ার হত্যার পরও আওয়ামী লীগ নেত্রীর আক্রোশ প্রশমিত হয়নি। জিয়ার পত্নী ও পুত্রদের হয়রানি করার কোনো চেষ্টা তিনি বাদ দিচ্ছেন না।
খালেদার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর গালিগালাজ
নতুন সংসদে নতুন প্রধানমন্ত্রী গোড়া থেকেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার নির্বাসিত পুত্রদের বিরুদ্ধে কদর্য গালিগালাজ শুরু করেন। আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তাতে ধুয়া ধরেন। সংসদের পরিবেশ এমন পূঁতিগন্ধপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে, বিরোধী দল একাধিকবার সংসদ বর্জন করতে বাধ্য হয়। অবশ্যি সরকারি দলের তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তারা প্রায় বিনা আলোচনায় যদৃচ্ছ ‘আইন‘ পাস করেছে, সংবিধানকে তুলোধুনো করে ছেড়ে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছিলেন যে, ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে‘ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস'া অন্তত আরো দু’টি সাধারণ নির্বাচনে চালু রাখা উচিত। কিন' বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সংবিধান আর গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতির ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিতে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চায়। তারা প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি উপড়ে ফেলেছে, এই হাস্যকর যুক্তিতে যে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সে পদ্ধতি আর বজায় রাখা সম্ভব নয়।
বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে চলছিল বলে সংসদে প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ তাদের ছিল না। সে জন্যই গত রোববার (১৮ মার্চ) তাদের সংসদে প্রত্যাবর্তন সমুচিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ও গণতন্ত্রকামী অন্য দলগুলো সংসদের বাইরে আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার পক্ষে দুর্জয় জনমত গড়ে তুলেছে। এখন সংসদে ফিরে গিয়ে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সে দাবি উচ্চারণ করার উপযুক্ত সময়।
বিএনপির প্রত্যাবর্তনের প্রথম দুই দিন এ দলের দু’জন মহিলা সংসদ সদস্যের কিছু অশালীন উক্তি নিয়ে সংসদে তুমুল হট্টগোল সৃষ্টি হয়েছে। স্পিকার-সংশ্লিষ্ট অংশগুলো অসংসদীয় বলে কার্যবিবরণী থেকে ‘এক্সপাঞ্জ’ (মুছে ফেলা) করেছেন। সেটাই সঙ্গত ব্যবস'া। এর পূর্ববর্তী সময়ে সরকারি দলের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কদর্য উক্তিগুলো সম্বন্ধে যদি তিনি সমানে দৃঢ়তা দেখাতে পারতেন তাহলে পরিসি'তির হয়তো এত অবনতি হতো না।
সাধারণ মানুষের এটা মনে করা স্বাভাবিক হবে যে, আলোচ্য দু’জন মহিলা সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসহ আরো কিছু সংসদ সদস্যের উক্তির সামনে ‘আয়না’ তুলে ধরে সঠিক কাজই করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বহু উক্তিতে বিরোধী দলের নেত্রী অবশ্যই অপমান বোধ করেছেন, কিন' সাধারণ মানুষের অনুভূতিও খুবই আহত হয়েছে। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে পাল্টা অভিযোগ তাদের মুখের ওপর ছুড়ে দিলে প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীরা ভবিষ্যতে এ ধরনের কটু কথা বলা থেকে বিরত থাকবেন। ‘ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’- এ শিক্ষা তাদের হবে।
প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, খালেদা জিয়া ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোলে বসে’ ক্ষমতা পেতে চান। ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদ স্বৈরশাসনের সাথে আওয়ামী লীগ নেত্রীর হার্দিক সম্পর্কের আলোকে তিনি সে সরকারের কোলে বসে ক্ষমতা পেয়েছিলেন বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে তা থেকে যদি প্রধানমন্ত্রীর মনে এ উপলব্ধি আসে যে, এ জাতীয় মন্তব্য অপমানকর ও পীড়াদায়ক, তাহলে সেটা কল্যাণকর হবে। 
খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান ২০০১ সালের নির্বাচনে যে সাংগঠনিক প্রতিভা দেখিয়েছিলেন তা থেকে আওয়ামী লীগের ভীত হওয়া স্বাভাবিক। তার ওপর শহীদ জিয়াউর রহমানের পরিবারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত গাত্রদাহের ব্যাপার তো আছেই। শেখ হাসিনা একজন অর্ধশিক্ষিত ও অমার্জিত উকিলকে দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে (তার নিজের বিরুদ্ধে ১৫টি গুরুতর দুর্নীতির মামলাসহ) সাত হাজারেরও বেশি ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন, রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন খুনির দণ্ড মওকুফ করিয়ে নিয়েছেন। অপর দিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা সাজানো হচ্ছে, সুপ্রাচীন বহু মামলায় তারেক রহমানকে ‘পরিপূরক তালিকায়’ আসামি করা হচ্ছে। 

দুর্নীতি ও দুর্নীতির সম্ভাবনা
তারেকের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনায় আওয়ামী লীগ যে আতঙ্কিত এ কথা সবাই জানে। সুতরাং অনেকেই মনে করেন যে, শেখ হাসিনার পুত্র সম্বন্ধে কিছু বয়ান সংসদে উত্থাপনের প্রয়োজন ছিল। সজীব ওয়াজেদ জয় একটি মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছাপার জের ধরে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আদালত ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, কিন' তার পরও বাড়তি তিন মাস তাকে কয়েদ করে রাখা হয়েছিল। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে যদি মামলা হতে পারে তাহলে সজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগের কেন তদন্তও হবে না?
মাত্র কিছু দিন আগে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড. লিয়াম ফক্সকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তার অপরাধ : তার এক বন্ধু তার উপদেষ্টা বলে দাবি করে ভিজিটিং কার্ড বিলি করেছেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সরকারি সফরের সময় সেখানে হাজির ছিলেন। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ হয়নি, কিন' সে সুযোগে উপরিউক্ত ব্যক্তি হয়তো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে আর্থিক লাভবান হতে পারতেন এমন একটা ইঙ্গিত অবশ্যই ছিল। সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে যে, তিনি বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা দাবি করে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়েছেন এবং ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী মহলে সে কার্ড বিলি করেছেন। তা ছাড়া টেলি-সংবাদে অনেকেই নিশ্চয় দেখেছেন যে, জয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বিদেশসফরে তার সঙ্গী হয়েছিলেন।
আমার পরম সৌভাগ্য, বহু দেশ থেকে সহৃদয় পাঠকেরা আমাকে টেলিফোন করেন, ইমেইলে মন্তব্য খবর ও গুজব ইত্যাদি পাঠান। বিভিন্ন সময়ে তাদের কেউ কেউ আমাকে জানিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে জয়ের অন্তত দু’টি প্রাসাদোপম অট্টালিকা আছে এবং তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় আয়ের জ্ঞাত কোনো উৎস তার নেই। তা ছাড়া অসংলগ্নতার জন্য তার নাম পুলিশের নথিভুক্ত বলেও কেউ কেউ আমাকে জানিয়েছেন। অনুরূপভাবে কেউ কেউ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা-জামাতা কানাডায় অভিজাত জীবনযাপন করছেন, কিন' তারা কোনো চাকরি কিংবা ব্যবসায় করছেন বলে কেউ জানে না। এমন অভিযোগও আছে, যে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিরত থাকছে তার সাথে কানাডা প্রবাসী প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়দের কারো আচরণ জড়িত থাকতে পারে। বহু লোকের যখন এ ধরনের ধারণা আছে তখন বিষয়গুলো নিয়ে উপযুক্ত তদন্ত করে প্রধানমন্ত্রী পুত্র-কন্যাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন।
সংসদে বিএনপিদলীয় উপরিউক্ত মহিলা সংসদ সদস্যদ্বয়ের সংশ্লিষ্ট উক্তিগুলো অবশ্যই অশোভন ও অসংসদীয় ছিল। কিন' সংসদ জাতি ও দেশবাসীর জন্য। তারা যদি মনে করেন যে, এই দু’জন সংসদ সদস্যের উক্তি প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীদের দৃষ্টি উন্মোচনে সহায়ক হবে তাহলে সে উক্তিগুলোরও প্রয়োজন ছিল বলতে হবে। 
লেখক : বিবিসি খ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক 
লন্ডন, ২০.০৩.১২ 
serajurrahman@btinternet.com

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১২

আন্তঃনদী-সংযোগ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা


২০১২-০৩-০৯

সভ্যতার আদি ধ্যানধারণা অনুপ্রাণিত হয়েছিল শান্তিপূর্ণ পারস্পরিক সহাবস'ানের স্বপ্ন থেকে। তুমি বেঁচে থাকো, আমাকেও বাঁচতে দাও- এটা সভ্য সমাজের খুঁটি। এর ব্যতিক্রম করা হলে অশান্তি ঘটে। আমাকে আক্রমণ করা হলে আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা আঘাত হানার অধিকার আমার থাকবে- এ বিশ্বাস সব সভ্য সমাজের আইনেও স্বীকৃত। দুর্ভাগ্যবশত মানবজাতি সব সময় সুসভ্য আচরণ করেনি, পরের অধিকারকে সম্মান করতে শেখেনি। তার পরিণতি কখনো মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হয়নি। জ্ঞাত ইতিহাসের অজস্র হানাহানি আর যুদ্ধবিগ্রহ তারই পরিণতি।
অথচ মানবজাতি সাধারণভাবে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। মানবজাতিকে শান্তির পথে চলতে সাহায্য করার আশায় প্রথম মহাযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সংস'া যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করতে পারেনি। জাতিগুলো সংস'ার বিধিমালা মেনেও চলেনি। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রথমে ইউরোপ ও পরে গোটা বিশ্বের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে চেয়েছিল। একপর্যায়ে জাপানও এই উন্মাদ উচ্চাভিলাষে শরিক হয়। কয়েক কোটি লোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল, মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা কয়েক যুগ পিছিয়ে গেছে সে যুদ্ধে। জাতিসঙ্ঘের পত্তন হয়েছে সব দেশ ও জাতির গ্রহণযোগ্য বিধিমালা প্রণয়ন করে যুদ্ধবিগ্রহের প্রয়োজনীয়তার অবসান করা এবং বিশ্বশান্তি নিরাপদ করার লক্ষ্যে।
‘পরস্য অপহরণ’- অন্যের যা আছে আমি নেব, অন্যের ভাগটা আমি ভোগ করব, এই প্রলুব্ধতা সর্বকালেই সভ্যতার প্রতি প্রধান হুমকি হয়ে রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ সনদের মোটামুটি সাধারণ স্বীকৃতি-সমর্থনের কারণে পরের দেশ দখলের প্রবণতা হ্রাস পেলেও পরের সম্পদ অপহরণের স্পৃহা বরং বেড়েই চলেছে।
এ প্রবণতা সবচেয়ে লক্ষ্যমান নদীর পানির ব্যাপারে। নদীগুলো অনাদিকাল থেকে পাহাড়-পর্বত ও উচ্চভূমি থেকে বহু দেশ পেরিয়ে সমুদ্রে পড়ে। জনবসতি বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে চাষবাসে সেচ এবং পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীর পানির ব্যবহার অভাবনীয় রকম বেড়ে গেছে। উজানের দেশগুলোর অত্যধিক চাহিদার কারণে ভাটির দেশ প্রায়ই তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পানিও পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বিগত তিন দশক থেকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছেন যে, ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধগুলোর কারণ হবে নদীর পানির হিস্যা নিয়ে বিরোধ।
জাতিসঙ্ঘ এ দিকেও মনোযোগ দিয়েছে। একাধিক দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদনদী সম্বন্ধে জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের (চুক্তি) পঞ্চম ধারাটি ১৯৯৭ সালের ২১ মে ১০৪-৩ ভোটে গৃহীত হয়েছে। এতে নদীর পানিসম্পদের সুষম ব্যবহার তীরবর্তী দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কনভেনশনের ৭ নম্বর ধারায় নদীতীরবর্তী অন্য দেশগুলোর ‘উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস'া নেয়া’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নদীর পানি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের বর্তমান স্বার্থের সঙ্ঘাতকে জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের পঞ্চম ও সপ্তম ধারার আলোকে বিবেচনা করতে হবে। ভারত দ্রুত উন্নয়নমুখী দেশ। কৃষির জন্য সেচ, কলকারখানার প্রয়োজন আর পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে অবিরাম বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে। অভিন্ন নদীগুলোতে ভারত এযাবৎ ৫০টিরও বেশি বাঁধ তৈরি করেছে। মাত্র গত সপ্তাহে বৃহত্তর সিলেটের ভেতর দিয়ে প্রবহমান সারি নদীর উজানে নতুন তৈরী পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের (সরকারের নয়) প্রবল প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির ওপর ভারতের এসব প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া হবে অভাবনীয়। বাংলাদেশ সীমান্তের উজানে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধের প্রভাব বিবেচনা করলেই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া পরিষ্কার হয়ে যাবে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ষাটের দশক থেকে সাবেক পাকিস্তানের সরকার প্রবল প্রতিবাদ করে আসছিল। সে কারণে বাঁধটি তৈরি হলেও চালু হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১৪ দিনের জন্য ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাবে সম্মত হন। কিন' সে ১৪ দিন এখন চিরস'ায়ী হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সাথে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। চুক্তিতে সি'র হয়েছিল যে, খরার মওসুমে বাংলাদেশকে ৩০ হাজার কিউসেক (বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম) পানি দেয়া হবে। কিন' সে পরিমাণ পানিও বাংলাদেশ কোনো বছরই পায়নি।

শুকনো পদ্মা আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা
পরিণতিতে গঙ্গার বাংলাদেশ অংশ পদ্মার বেশির ভাগ শুকনো মওসুমে স্রোত থাকে না। পলি জমে জমে নদীর তলা উঁচু হয়ে শুকিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে/পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার/ ঢালু তার পাড়ি।’ পদ্মা ছোট নদী নয়। প্রমত্তা পদ্মাকে নিয়ে বহু কবিতা, গান ও কাহিনী লেখা হয়েছে। কিন' এখন পদ্মায় সব সময় ‘হাঁটুজলও’ থাকে না। মানুষ, গরু আর গাড়ি অনায়াসে এ নদী পার হয়। পানির অভাবে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে তৈরী গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প অকেজো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল শুকনো মওসুমে মরুভূমির মতোই উষর। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের নদী মোহনাগুলো পলি জমে জমে উঁচু হয়ে গেছে। জোয়ারে আর সামুদ্রিক বানে বঙ্গোপসাগরের নোনা পানি নদীর উজানে এলে আর নামতে পারে না। লবণাক্ততার কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার একর উর্বর জমি অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে।
বর্ষায় ভারতীয়রা তাদের বাঁধ রক্ষার জন্য স্লুইস গেটগুলো খুলে দেয়। বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টি আর স্‌্েরাতের সাথে এই বাড়তি পানি যুক্ত হয়ে ধেয়ে আসে পদ্মা, মেঘনা প্রভৃতি বাংলাদেশের নদীগুলোতে। শুকিয়ে যাওয়া নদীতল সে পানি ধরে রাখতে পারে না। নদীর পার ভাঙে, হাজার হাজার একর উর্বর জমি হারিয়ে যায়। নদীর দুই তীর বন্যায় ডুবে যায়। নদীতল ক্রমেই উঁচু হচ্ছে বলে প্রতি বর্ষায় বন্যা বেশি থেকে আরো বেশি এলাকা ডুবিয়ে দিচ্ছে, সে পানি নেমে যেতেও বেশি থেকে বেশি সময় লাগছে। বন্যায় বার্ষিক ফসল হানি অপরিমেয়। অর্থাৎ ভারতের তৈরী বাঁধগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য শাকের করাত, যেতেও কাটে, আসতেও কাটে। খরা ও বর্ষা- উভয় মওসুমেই বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
এই হচ্ছে একটি নদী-পদ্ধতির মর্মান্তিক দুর্দশা। তিস্তা-পদ্ধতির অবস'াও এখন সমানেই মর্মান্তিক। টিপাইমুখ বাঁধ চালু হলে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অঞ্চলও একই রকম ঊষর হয়ে যাবে। শুধু যে ইলিশ মাছ আর আসবে না বাংলাদেশে তাই নয়, বাংলাদেশের পূর্বাংশের পরিবেশ প্রাণী উদ্ভিদ সব কিছু বদলে যাবে।
অর্থাৎ নদীর পানিসম্পদের ‘সুষম ব্যবহার’ করার জন্য জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের পঞ্চম ধারার এবং ‘অন্য দেশের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস'া নেয়ার’ যে বিধান সে কনভেনশনের সপ্তম ধারায় আছে ভারত ইতোমধ্যেই তা অমান্য করে চলেছে। তার ওপর ১৯৮২ সালে ভারত একটা ‘মেগা প্রকল্প’ তৈরি করেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোকে একটি খাল দিয়ে সংযুক্ত করে সেসব নদীর পানি মধ্য ভারতের ঊষর অঞ্চলে সেচের জন্য নিয়ে যেতে। ভারতের সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মানুষ এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। এত বছর পর সুপ্রিম কোর্ট গত সপ্তাহে সে মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন। রায়ে মেগা প্রকল্পকে বৈধ ঘোষণা করে পরিবেশ-সংক্রান্ত সব ভারতীয় আপত্তি বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতের আইন ও ভারতের স্বার্থ বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন। কিন' সে রায়ে যে আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসঙ্ঘ কনভেনশনের পঞ্চম ও সপ্তম ধারার বিরোধিতা করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট সেটা অগ্রাহ্য করেছেন। মেগা প্রকল্পটি নির্মাণ শুরু হলে সেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল হবে।

ভারত যে কারণে সাহস পায়
কথা হচ্ছে বাংলাদেশ কি বেঁচে থাকতে চায়? এবং বেঁচে থাকতে হলে বাংলাদেশীদের কী করতে হবে? সাদা চোখেই আমরা দেখতে পাচ্ছি- স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই দেশের জীবন-মরণের এ প্রশ্নটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। স্বাধীনতার সময় থেকেই নাগরিকদের একাংশ সুশীলসমাজের ছত্রছায়ায় এবং ভারতীয় দালালদের সহায়তায় বাংলাদেশকে আবারো ভারতের সাথে সংযুক্ত করার প্রস'তি হিসেবে ‘বাঙালি জাতীয়তার’ ধ্বনি তুলেছে। ‘ওপারের বাঙালিরা’ আমাদের যতই পদাঘাত করুক ‘বাঙালি জাতীয়তার’ পূজারীরা সেসব অগ্রাহ্য করে দাদা-দিদিদের পদলেহন করে চলেছে। বাংলাদেশের স্বার্থ সম্যক উপলব্ধি করার সময় ও সুযোগ দেশের মানুষ পায়নি।
অপেক্ষাকৃত সামপ্রতিককালে বড় দল দুটোর একটা বাকশালী স্বৈরতন্ত্র ফিরিয়ে এনে গদি চিরস'ায়ী করার উন্মাদ স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। সে লক্ষ্যে তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত হয়েছে এক দিকে সব প্রকারের গণতান্ত্রিক বিরোধিতাকে নির্মূল করা, অন্য দিকে পাশের বড় দেশের অনুগ্রহ লাভের যথাসাধ্য চেষ্টা করা। রাজনৈতিক বিরোধীদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। দাড়ি ও টুপি পরিহিত কোনো লোক রাজনীতির কথা বললেই তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে জেলে পোরা হয়, ঐক্য-সংহতি বলে যে একটা কথা অভিধানে আছে, আজকের বাংলাদেশে এলে সেটা মনে হয় না।
ভারতের অনুগ্রহ লাভের জন্য এমন কিছু নেই, যেটা বাংলাদেশের বর্তমান সরকার করছে না। আমাদের পররাষ্ট্র-স্বরাষ্ট্র সব নীতি ভারতের মর্জির ওপর নির্ভর করছে। বিদেশী উসকানি ও সহযোগিতায় বিডিআরে বিদ্রোহ ঘটিয়ে ৫৭ জন উচ্চপদস' সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে, বিডিআরকে অবলুপ্ত করা হয়েছে, এমনকি সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিএসএফ এখন খেয়ালখুশিমতো বাংলাদেশীদের হত্যা করছে, বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে আমাদের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদের কৃষকদের ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের রেল, সড়ক ও সমুদ্রবন্দরগুলো ভারতের করিডোর ও বহির্বাণিজ্যের জন্য বিনামূল্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আর ভৌগোলিক এলাকা যেন এখন ভারতের খেলার সামগ্রী। তারা আমাদের নদী-উপনদী আর খালে বাঁধ নির্মাণ করে ১৩৪ চাকার ট্রাক ও ট্রেইলার চালায়। টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর সাহস বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের নেই।
ভারতের সংযোগ খালটি তৈরি হলে নদীর পানির প্রাপ্যতা আর পরিবেশের ওপর কুপ্রভাবের ভয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগরিকরাই উদ্বিগ্ন। সে জন্যই তারা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল। বাংলাদেশের আশু কর্তব্য জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা, কেননা; আগেই বলেছি, এ রায় জাতিসঙ্ঘের নদীর পানিসংক্রান্ত কনভেনশনের পঞ্চম ও সপ্তম ধারার বিরোধী। কিন' শেখ হাসিনার সরকার সে আপিল করবে কি? মোটেই মনে হয় না। কেন না শেখ হাসিনা আশা করছেন, ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শেই’ তিনি গদি আঁকড়ে থাকতে পারবেন।
প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য
জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সাহায্য চাওয়ার জন্য দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পরবর্তী সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দুর্ভাগ্য এ জন্য বলছি যে, ভারতীয়রা সংযোগ খালটি তৈরি করে ‘ফেইট একম্পলি’ (প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা সৃষ্টি) করে ফেললে সেটার পরিবর্তন সব সময়ই কঠিন হয়। কিন' আমাদের বা নাগরিকদেরও অনেক কিছু করণীয় আছে। সরকার নীরব থাকলেও সব গণতান্ত্রিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের উচিত ভারতকে এবং বিশ্বসংস'া ও বিশ্বসমাজকে জানিয়ে দেয়া যে, ভারতের পানি আগ্রাসনের দরুন বাংলাদেশের যে পরিমাণ ভূমি চাষাবাদ ও মনুষ্য বসতির অযোগ্য হয়েছে, সে পরিমাণ ভূমি বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে দাবি করবে।
সরকার যখন নিষ্ক্রিয় তখন দেশকে বাঁচানোর, দেশের ভবিষ্যৎকে বাঁচানোর দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিককে হাতে তুলে নিতে হবে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের একখানি ট্রেন, একটি ট্রাক কিংবা একখানি জাহাজও যাতে যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা প্রত্যেকটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য হবে। আর এক বোতল ফেনসিডিলও যাতে বাংলাদেশে না আসে সে দিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশে আজকাল চমৎকার শাড়ি ও জামাকাপড় তৈরি হয়। তার পরও ভারতীয় শাড়ি পরার বিলাসিতা বর্তমান অবস'ায় গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতীয় শাড়ি-কাপড় বর্জন করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নারীর কর্তব্য হবে। কোনো নারীকে ভারতীয় শাড়ি পরতে দেখা গেলে তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে।
ইতোমধ্যে অবৈধভাবে যেসব ভারতীয় বাংলাদেশে বাস করছেন, চাকরি করছেন, পেছনে থেকে আওয়ামী লীগ গুণ্ডাদের উসকানি দিচ্ছেন, এমনকি ভোটও দিচ্ছে আওয়ামী লীগকে, ‘সিটিজেন্স অ্যারেস্ট’ বিধির আওতায় তাদের সবাইকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করতে হবে। আর ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ কথা এর পরেও যারা উচ্চারণ করবে, তাদের ধরে জিজ্ঞেস করতে হবে- শেখ হাসিনা ও দীপুমণির বন্ধু মমতা ব্যানার্জি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন কি না, করলে তিনি কেন শুধু সর্বনাশা বর্ষাকালেই বাংলাদেশকে নদীর পানি দেবেন, তিনি কেন বাংলাদেশের পাওনা জমি বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেবেন না? তাতেও যদি কারো চৈতন্যের উদয় না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, তিনি বাংলাদেশকে বিলুপ্ত করে আবারো অখণ্ড ভারত গড়তে চান। তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেয়া সবার অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে।
লন্ডন, ০৫.০৩.১২
serajurrahman@btinternet.com