বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

সুরঞ্জিতের পদত্যাগ ও পুনর্বহালের পেছনে বহু প্রশ্ন

সুরঞ্জিতের পদত্যাগ ও পুনর্বহালের পেছনে বহু প্রশ্ন


॥ সিরাজুর রহমান ॥

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন আর অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন একমত হয়েছেন যে জ্যেষ্ঠ ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের আয় আর তারা কত কর দিয়েছেন তার বিবরণ প্রকাশ হওয়া উচিত। ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথায় তাদের এই স্বচ্ছতার সিদ্ধান্তের দুটো কারণ আছে। প্রথমত, অর্থমন্ত্রী গত ২১ মার্চের বাজেটে আয়করের স্তরভেদের যেসব বিধান করেছেন সে সম্বন্ধে এখনো তুমুল বিতর্ক চলছে। দ্বিতীয়ত, আগামী ৩ মে লন্ডনের মেয়র নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রীর পরেই এটা ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ বলে বিবেচিত। বড় দুটো দলের প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। তার জের ধরে তারা এখন নিজ নিজ ট্যাক্স রিটার্নের বিবরণ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিকদের সম্পদের ব্যাপারে কিছুকাল অগ্রবর্তী ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি বলেছিলেন, তার দল জয়ী হলে মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে। সবাই এখন জানে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিগুলো অর্থহীন, নিছক রাজনীতির কলাকৌশল মাত্র। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানো, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়া, রাতারাতি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলা ইত্যাদি আরো বহু প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন গদি পাওয়ার আশায়। গদি তিনি পেয়েছেন, কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতিটি তিনি পালন করেছেন?
গদি লাভের তিন বছর পর শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাবের কথা উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু সে হিসাব প্রকাশের কথা তিনি আর বলেননি, শুধু বলেছেন মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব তার কাছে জমা দিতে হবে। ২০০৮ সালের প্রতিশ্রুতি আর ২০১১ সালের নির্দেশের মধ্যে এই আকাশ-পাতাল গরমিল কেন? এ সরকারের আমলে দেশজোড়া দুর্নীতি ১৯৭২-৭৫ সালের মহাদুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্যÑ এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। দুর্নীতি প্রমাণ করা কখনোই সহজ নয়। যারা দুর্নীতি করে তারা এত বোকা নয় যে সাক্ষী-প্রমাণ রেখে দুর্নীতি করবে। কিন্তু দেশের সব মানুষের উপলব্ধি এই যে দিনদুপুরে পুকুর চুরিই নয়, রীতিমতো দীঘি চুরি; এমনকি বঙ্গোপসাগর চুরিই চলছে এখন। নির্বাচন যখন হবে ভোটদাতারা তখন প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করবে না, উপলব্ধি থেকে তারা ভোট দেবে; উপলব্ধিই তাদের প্রার্থী এবং দল নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট হবে। 

ভেবে দেখুন! এ সরকার ক্ষমতা পাওয়ার পর লে. ক. ফারুক খান যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন চাল-ডাল-তেল-নুন-আটা থেকে শুরু করে পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কার দামেও যে ফটকাবাজি চলেছে, সেসব কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যেতে পারবে? তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে যেসব সিন্ডিকেট আর গ্রুপকে ২০ হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট বিনা টেন্ডারে দেয়া হয়েছে এবং চুরির দায়দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার আগাম মুচলেকা দেয়া হয়েছে, তাদেরও কোনো কোনোটির মালিক সরকারের উচ্চপদে আসীনদের আত্মীয়স্বজন অথবা দলের ভেতর ক্ষমতার খুঁটি বলে বিবেচিত কয়েকজন।

আরো দেখুন! দেশের ৩২-৩৩ লাখ স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যেকোনো প্রকারেই হোক কিছু টাকা সংগ্রহ করে সুদিনের মুখ দেখার আশায় শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিল। সেসব টাকা কুমিরে খেয়েছে। তারা এখন পথে বসেছে, তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে। সরকারের ভেতরের কিছু লোক এবং সরকারের দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষকেরা এই ৩২-৩৩ লাখ লোকের যথাসর্বস্ব লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে বলেই সবার বিশ্বাস। সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটা জরুরি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি নাম ধরে দুর্বৃত্তদের তালিকাও সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এমনকি তস্করদের নামের তালিকা প্রকাশ করতেও তারা সাহস পায়নি। 

দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের এই অনীহা থেকে দেশের মানুষ ঠিকই বুঝে গেছে এ সরকার তাদের কল্যাণ সাধনের জন্য নয়, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতেই গদিতে এসেছে। আর হাসিনা কেন মন্ত্রীদের সম্পদের তালিকা চেয়েছেন? তারও কারণ আছে। সরকার এখন চতুর্থ বছরে পড়েছে। মন্ত্রীদের চাকরির মেয়াদ আর মাত্র দেড় বছর। আখের গুছিয়ে নিতে তাদের আর ধৈর্য সয় না। লুটপাটের ব্যাপারে তাদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে উচ্ছৃখলতা আর অবাধ্যতার ভাবও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর টাকার পাহাড়ের খোঁজখবর হাতে থাকলে রাশ টেনে ধরতেও সেই হিসাবকে ব্যবহার করা যাবে।

মন্ত্রীদের পেট এখন অনেকটা ভরে এসেছে। এ দিকে নির্বাচনের সময়ও এগিয়ে আসছে দ্রুত। সংসদ সদস্যদের পেটও এখন ভরানো দরকার। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাড়া আগামী নির্বাচনে ভোট পাওয়ার উপায় নেই। যেকোনো প্রকারেই হোক তাদের খুশি করা না গেলে তারা বহু হাঁড়ি হাটেই ভেঙে দেবেন, শেষমুহূর্তে হয়তো ভাঙা নৌকা থেকে লাফিয়ে অন্য দলে চলে যাবেন কেউ কেউ, যেমন করে ডুবন্ত জাহাজ কিংবা নৌকা থেকে ইঁদুর-ছুঁচো লাফিয়ে পড়ে। তাদের বেশ কয়েকজনকে এখন ব্যাংক করার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক করার পুঁজি তারা কোথায় পেলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কি একবারও তার খোঁজ নিয়েছেন? জোর গুজব, ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে দেদার টাকার হাতবদল হয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিকম লাইসেন্সের ব্যাপারেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারের মন্ত্রীরা। শোনা যাচ্ছে নতুন নতুন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি খোলার জন্যও লাইসেন্স দেয়া হবে। সন্দেহ নেই যে সরকারের ভেতর মহলের কেউ কেউ আরো বহু কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন সেই সুবাদে।

দুর্নীতি তদন্তে সরকারের অনীহা
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বহু অভিযোগ মিডিয়ায়ও প্রচার হয়েছিল। এমনকি পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তখনো আমরা বলেছিলাম, সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করার সাহস সরকারের হবে না। আসলেও হয়নি। একাধিক কারণ আছে তার। দেশে ব্যাপক সন্দেহ আছে, যেকোনো কারণেই হোক ‘ওপরের’ শক্তিশালী সমর্থন আছে আবুল হোসেনের পেছনে। প্রচার-প্রচারণায় কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার পর তাকে অন্য এমন একটি দফতরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি বৈ কম নয়। বিশ্বব্যাংক এখন কানাডার একটি নির্মাণ কোম্পানিকে দুর্নীতির দায়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। 
অনেক প্রবাদ আছে চোর ও চুরি সম্বন্ধে। একটা হচ্ছেÑ চোরেরও ধর্ম আছে। আরেকটা চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। আসল কথা হচ্ছে, এক চোর অন্য চোরকে ধরিয়ে দেয় না। এবং আগেই বলেছি চোরেরা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে চুরি করতে চায় না। আরেকটা প্রবাদÑ চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্ভাগ্য। তিনি ধরা পড়ে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলেই সবার ধারণা। 
অত্যন্ত নাটকীয় কিছু ঘটনা ঘটেছে ৯ এপ্রিল দিবাগত শেষ রাতে। চলমান একখানি গাড়ি হঠাৎ করে মোড় নিয়ে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বাহিনীর সদর দফতরে ঢুকে পড়ে। সেই গাড়ির আরোহীরা ছিলেন গাড়ির মালিক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার, বাংলাদেশ রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা আর রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডেন্ট এনামুল হক। গাড়ির চালক ছিলেন আজম খান। পিলখানায় ঢুকেই আজম খান নাকি চিৎকার করে বলতে থাকেন গাড়িতে অনেক টাকা আছে। বিজিবির লোকেরা তল্লাশি করে নাকি ৭০ লাখ টাকা পান। এত রাতে তারা কোথায় যাচ্ছিলেন, এ প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভার ও যাত্রীরা সবাই বিজিবিকে বলেন যে তারা রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পরদিন মিডিয়াকেও তারা একই কথা বলেন। কিন্তু রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরে দাবি করেন ওই তিনজন যাত্রী আজম খান চালিত গাড়িতে তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন না, যাচ্ছিলেন তার একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদারের বাড়িতে।

সঠিক চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি
অনেক কারণে সেই রাতের ঘটনাবলির একটা স্বচ্ছ চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি। জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা বলেছিলেন, একটা স্টেশনে (শায়েস্তাগঞ্জ?) ট্রেন থামবে কি না আলোচনার জন্য তিনি রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তাহলে গাড়িতে যে বস্তা বস্তা টাকা ছিল তার ব্যাখ্যা কী? একটা কথা তখনো শোনা গিয়েছিল গাড়িতে ৭০ লাখ নয়, চার কোটি ৭০ লাখ টাকা ছিল। অবশিষ্ট চার কোটি টাকা তাহলে গেল কোথায়? চার কোটি ৭০ লাখ অঙ্কটার কিছু প্রাসঙ্গিকতা আছে। মোটামুটি একই সময়ে খবর পাওয়া যায়, সুরঞ্জিতের পুত্র সৌমেন পাঁচ কোটি টাকায় একটা টেলিকম লাইসেন্স কিনেছেন। তার টাকার উৎসই বা কী? আরেকটা প্রশ্ন : ড্রাইভার আজম খান কি টাকার বখরার কারণে পিলখানায় ঢুকে পড়েছিলেন, নাকি দুর্নীতি দমনের নাগরিক দায়িত্ব থেকে যাত্রীদের তিনি বিজিবির হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? শোনা যাচ্ছে আজম খানকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না, তার পরিবার তার নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন। কোথায়, কেমন আছেন আজম খান?
গা বাঁচানোর জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চেষ্টাগুলো প্যাথেটিক। মূল অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে তিনি দুটো ‘এক ব্যক্তির’ তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন তারই অধীনস্থ দু’জন কর্মকর্তার অধীনে। এপিএস ফারুক সম্বন্ধে তদন্তের ভার দেয়া হয়েছিল তারই সহকর্মী পিএস (একান্ত সচিব) আখতারুজ্জামানকে। আর জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শশী কুমার সিংকে, যিনি মোটামুটি জেনারেল ম্যানেজারের সমমর্যাদার কর্মকর্তা। বর্তমান সরকারের আমলে ‘তদন্ত’ ব্যাপারটাই মূল্যহীন। কোনো তদন্তেই প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয় না। 

সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর তার স্বামী সাগরের হত্যার তদন্ত তদারকির ভার নিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সেই হত্যারও কোনো সুরাহা হয়নি। শোনা গিয়েছিল বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কন্ট্রাক্টে ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে তারা তদন্ত করছিলেন। আরো শোনা গিয়েছিল যে খুনিদের তাড়াতাড়ি আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন শাসক দলের কাউকে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেনি। এ সরকারের আমলে তদন্তের অন্য অর্থ হচ্ছে সময়ক্ষেপণ এবং সত্য উদঘাটন না হওয়া।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে অস্বীকার করছিলেন। রাতের বেলায় প্রধানমন্ত্রী তাকে তলব করার পরের দিন সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় এই প্রথমবার একজন মন্ত্রী বরখাস্ত হলেন। শেখ হাসিনার অনুগত রাজনীতিক ও লেখকেরা চমৎকৃত হয়েছেন তাতে। সরকারের গৃহপালিত মিডিয়া এই পদত্যাগকে পুঁজি করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ ঘষামাজা করার কাজে লেগে গেছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর নবজাগ্রত কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় আমি দেখতে পাই না। প্রকৃত ব্যাপার এই, সরকারের মধ্যে দুর্নীতির একটা সিন্ডিকেট আছে। ধারণা করা হয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ধরা পড়ে গিয়ে গোটা সিন্ডিকেটকেই বিপদগ্রস্ত করেছেন। 
গত সাড়ে তিন বছরে রেলওয়ে বিভাগে সাড়ে সাত হাজার জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রেল কর্মচারী, ইউনিয়ন সদস্য ও নেতা এবং চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রতিটি নিয়োগের বেলায় নিয়োগকর্তারা দুই থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এই নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ তারা কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। কেন হয়নি এখন আর কারো বুঝতে বাকি রইল না। 

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম
মিডিয়ায় এবং অন্যত্র তার পদত্যাগের দাবিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছেন। সুরঞ্জিত বাবু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গা ঘিনঘিন করা দাঁত খিঁচানো ব্যঙ্গ দিয়ে এতকাল শুধু নিজেকেই আমোদিত করছিলেন। তার এই দাবিতে বহু মহলেই বিদ্রƒপের হাসি দেখা দেবে। এ সরকারের কাজে এবং কর্মে সুরঞ্জিত বাবু গণতন্ত্র কোথায় দেখলেন? কোন গণতন্ত্রের কথা বলছেন তিনি? ক্ষমতা পাওয়ার প্রথম দিন থেকে এ সরকার গদি চিরস্থায়ী করার জন্য ফ্যাসিস্ট পন্থায় সব রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নির্মূল করার পরিকল্পিত অভিযান শুরু করেছে। 
হত্যা, ধরপাকড় এখনো অব্যাহত গতিতে চলছে। জেলখানায় এদের স্থান করার জন্য ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের মুক্তি দিচ্ছে সরকার। বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম করে ফেলা। ঢাকার কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে দিয়ে এই গুম করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ গুম হয়েছেন বিএনপির সংসদ সদস্য, সিলেট জেলা বিএনপির প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। দেশব্যাপী জোর গুজব এবং বিএনপি সরাসরি অভিযোগ করেছে যে সরকারই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে।
বিরোধী দলকে সভা-সমিতি ও মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। গত ১২ মার্চ বিএনপির আহূত ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করতে সরকার যা করেছে সেটা রীতিমতো ন্যক্কারজনক। প্রধান বিরোধী দলের সদর দফতরকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখার দৃষ্টান্ত সম্ভবত নাৎসিরাও দেখাতে পারেনি। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হয়েছে। এই তিনটি বিভাগকে বিরোধী দলের নির্যাতনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ সরকারের আমলে যে ক’টি মেয়র নির্বাচন হয়েছে প্রতিটিতে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। রাজধানীতে পরাজয়ের গ্লানি এড়ানোর জন্য এখানের মেয়র নির্বাচন সরকার তিন বছর ঠেকিয়ে রেখেছিল। রাজধানীকে দুই টুকরো করে নির্বাচন আবারো পেছানো হয়েছে। তার পরও নির্বাচন কমিশন বিভক্ত ঢাকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল। আসন্ন নির্বাচন আরো তিন মাসের জন্য মুলতবি করেছেন আদালত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কটূক্তি করে বিরোধী দলের সংসদে উপস্থিতি অসম্ভব করে তুলেছেন। সুরঞ্জিত স্বয়ং যে ভাষায় বিরোধী দলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন সেটাকেও গণতন্ত্রের ভাষা বলা যায় না। এই যদি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয় তাহলে সেই গণতন্ত্র কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষের কাম্য হতে পারে না। 

ভারতের চাপে সুরঞ্জিত আবার মন্ত্রী
পদত্যাগ করেও মাত্র ৩০ ঘণ্টা পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবার ক্যাবিনেটে স্থান পেয়েছেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। তার পদত্যাগে সরকারের ইমেজ বেড়েছে বলে যেসব পত্রিকা নাচানাচি করছিল তারা এখন কী ব্যাখ্যা দেবে? বরং এটাই মনে হয় যে এ সরকার আপন স্বার্থে আপনজনদের ক্ষমতা-বলয়ের বাইরে যেতে দেবে না। তাহলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি ইতোমধ্যেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন? সত্যি সত্যি যদি তিনি নির্দোষ হন তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন কেন?
আসল ব্যাপার সেটা নয়। দেশব্যাপী জোর গুজব সুরঞ্জিতকে আবার মন্ত্রী করা হয়েছে ভারতের চাপে। আমরা আগেও অনেকবার লিখেছি, এ সরকারের আমলে বাংলাদেশে কী ঘটবে না ঘটবে সেটা স্থির হয় দিল্লিতে। আমরা বলেছি এবং বিশ্বব্যাপী আরো অনেকে বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। বর্তমান সরকার গায়ের জোরে প্রমাণ করতে চায় যে তিন মিলিয়ন, অর্থাৎ ৩০ লাখ নিহত হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। সঠিক সংখ্যা যা-ই হোক সে যুদ্ধে অজস্র প্রাণহানি হয়েছে। ভারতের অঙ্গুলি তাড়নে পরিচালিত হওয়ার জন্যই কি মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন? 
বাংলাদেশের মানুষ জানে বিনা মেঘে বজ্রপাত কিংবা বিনা আগুনে ধোঁয়া হয় না। তারা এই সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলে ভাবতে শিখেছে। তারা ধরে নিয়েছিল যে সুরঞ্জিতের পদত্যাগের ফলে অন্তত একটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেল। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যও শ্রী সেনগুপ্তকে আবার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এত 
বোকা নয়। এত সহজে তাদের সাথে প্রতারণা করা যাবে না। 
(লন্ডন, ১৮.০৪.১২) 
serajurrahman@btinternet.com

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

জার্মান সমরবাদের ভূত এখন ইসরাইলের কাঁধে : গুন্টার গ্রাস


সি রা জু র র হ মা ন


গুন্টার গ্রাস কৈশোরে জার্মানির আর-আর কিশোরদের মতোই হিটলারের কুখ্যাত এসএস বাহিনীর যুব শাখায় যোগ দিয়েছিলেন। নািসবাদের স্বরূপ এবং তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ভেতর থেকে দেখার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তাঁর কবিতা ও রচনায় সে ফ্যাসিবাদের প্রতি ঘৃণা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সেজন্যই তিনি আন্তর্জাতিকভাবে ‘জার্মানির বিবেক’ বলে বর্ণিত।
হিটলার ইউরোপের ওপর এবং তার জের ধরে বিশ্বব্যাপী যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন তাতে ১০ কোটি লোক মারা গেছে বলে অনুমান করা হয়। জায়নিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তখন থেকেই দাবি করে আসছে যে, নািসরা ছয় মিলিয়ন (৬০ লাখ) ইহুদিকে হত্যা করেছিল। তখন থেকে বিশ্বে আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা তাদের ৬০ লাখ নিয়ে এমনই প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে যে, সেই যুদ্ধে নিহত অবশিষ্ট প্রায় সাড়ে নয় কোটির কথা বিশ্ববাসী ভুলেই গেছে বলা চলে।
ইহুদিদের হিটলারের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ পাঠানোর ব্যাপারে ফ্রান্সসহ কোনো কোনো দেশ নািসদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলো। ব্রিটেনসহ অন্য দেশগুলো নািসবাদের বিবর্তন ও ইহুদি নির্যাতন দেখেও দেখেনি। বস্তুত জার্মানি যখন চেকস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে তার আগে পর্যন্ত ব্রিটেনও হিটলারকে তোষণ করেছে। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের আগে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
যুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব আধিপত্যবাদী জায়নিস্টরা হিটলারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার জন্য ইউরোপের দেশগুলোর কাছ থেকে খুবই উচ্চমূল্য আদায় করতে শুরু করে। গোড়াতেই সব ব্যাপারে ইহুদিদের সঙ্গে সহযোগিতা করা এ মহাদেশে যেন রাষ্ট্রধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। ইহুদি-বিদ্বেষকে দণ্ডনীয় অপরাধ করা হয় প্রায় সব ইউরোপীয় দেশে। ইউরোপ-আমেরিকার বাধ্যতামূলক সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ইহুদিরা ফিলিস্তিনি আরবদের (মুসলিম ও খ্রিস্টান) ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করে।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য যে পরিমাণ ভূমি নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো, আজকের ইসরাইল রাষ্ট্রের আয়তন তার প্রায় তিনগুণ। প্রথমেই ইরগুন, স্টার্ন গ্যাং প্রভৃতি মূলত পোলিশ ইহুদি সন্ত্রাসীরা প্রায় আট হাজার বর্ধিত আরব পরিবারকে উচ্ছেদ করে তাদের ভিটেবাড়ি ও আবাদি জমি দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অবশিষ্টাংশও দখল করে। জাতিসংঘ তখন থেকে এই দখল করা আরব ভূমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়ে বহু প্রস্তাব পাস করেছে, কিন্তু আরবদের ভিটেবাড়ি, আবাদি জমি ও ফলের বাগান উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি নির্মাণ অবিরাম চলছে। জাতিসংঘ অনেক প্রস্তাব পাস করে এসব বসতিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
এসব প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না এ কারণে যে, ইসরাইলকে বাধ্য করার কোনো প্রস্তাবে সম্মতি দিতে ইউরোপের দেশগুলোকে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানো যাচ্ছে না। জায়নিস্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ইহুদিরা এসব দেশে সব গুরুত্বপূর্ণ পেশায় ঢুকে পড়েছে। ইউরোপের কোনো দেশে ইহুদিদের সংখ্যা তিন-চার শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু সেসব দেশের পার্লামেন্টে এবং সরকারে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিকভাবে বেশি। তেমনি এই দেশগুলোর অর্থনীতি এবং মিডিয়াকেও তারা মুঠোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি প্রভাব আরও প্রকট। ইহুদি ও ইসরাইলি লবিগুলোর অনুমোদন ছাড়া এখন মার্কিন কংগ্রেসে কোনো আইন পাস করা অথবা কোনো রাজনীতিকের কোনো গুরুত্বত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কথা উঠলেই সারাবিশ্বের ইহুদিরা ‘অ্যান্টিসেমিটিজমের’ (ইহুদি-বিদ্বেষের) জিগির শুরু করে দেয়, নািসদের হাতে নিহত ৬০ লাখ ইহুদির কথা তুলে কান্না জুড়ে দেয়। অর্থাত্ ত্রিশের দশকে নািসদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার দরুন জায়নিস্টরা এখনও পশ্চিমা বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে, বাকি বিশ্বকেও ব্ল্যাকমেইল করে।
পশ্চিমা সাহায্যে ক্ষুদে হিটলার
ইহুদি-বিদ্বেষ নিষিদ্ধ করার পেছনে আদি যুক্তি ছিল নািসবাদের পুনরাবির্ভাব অসম্ভব করে তোলা। জার্মান ‘মিলিটারিজমের‘ (সামরিক মনোভাবের প্রাবল্য) কারণে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দখলদার শক্তিগুলো (ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ফ্রান্স) এ জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বহু নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু অন্যদিকে ‘শত্রু-পরিবেষ্টিত ইসরাইলের আত্মরক্ষার ‘অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য দান এবং সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে। তার অস্ত্রভাণ্ডারে এখন ৪০০টি পারমাণবিক বোমা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কবি গুন্টার গ্রাস এখন ফাঁস করে দিলেন যে, জার্মানিও ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে এবং বর্তমানে ইসরাইলের জন্য দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি করছে।
অবিসংবাদিত সত্য এই যে, ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান সামরিক শক্তি। নিজেরও অত্যন্ত আধুনিক একটা যুদ্ধাস্ত্র তৈরির শিল্প সে গড়ে তুলেছে। ভারতসহ কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের কাছ থেকে সমরাস্ত্র আমদানি করে। বস্তুত ভারতেও ইসরাইলের সহযোগিতায় একটা অস্ত্র নির্মাণশিল্প গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তির অবস্থান স্থায়ী করতে তেলআবিব সর্বদা উদগ্রীব। এ অঞ্চলের অন্য কোন দেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে ইসরাইল স্বয়ং কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সে দেশকে শক্তিহীন করে দেয়া তেলআবিবের পরিচিত কৌশল। ইসরাইল গোড়া থেকেই দাবি করে এসেছে, যে কেউ তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করলে আগেই তাকে আক্রমণ করার অধিকার ইসরাইলের আছে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে সে অভিযোগকারী, জজ ও জুরির ভূমিকা একাই পালন করছে। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র তারপর অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি নীরবে তেলআবিবের সে অন্যায় আবদার মেনে নিয়েছে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর সম্ভাবনা দেখা দেয় নতুন আদর্শে উজ্জীবিত ইরান ইসরাইলি আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনা ও অস্ত্র সাহায্যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেন। সেই যুদ্ধ আট বছর ধরে চলে। কিন্তু সে সাদ্দামই যখন বাগদাদের উপকণ্ঠে অসিরাকে একটা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন তখন ১৯৮১ সালে ইসরাইল ভোল-পাল্টানো মার্কিন বোমারু বিমান ব্যবহার করে কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়।
আট বছরের যুদ্ধের পর ইরান সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। তখন থেকে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদ প্রচার চালাতে থাকে, সাদ্দাম হোসেন গোপনে গণবিধ্বংসী (পারমাণবিক ও রাসায়নিক) অস্ত্র তৈরি করছেন। গোড়ায় ওয়াশিংটন কিংবা লন্ডন এসব প্রচারণায় বিশেষ কান দেয়নি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন-ইলেভেন) নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদা সন্ত্রাসের পর মার্কিন জনমত ভয়ঙ্কর রকম ইসলামবিদ্বেষী হয়ে দাঁড়ায়। সে বছরের ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। ইসরাইল সাদ্দামের কল্পিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের স্তূপের প্রচারণা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে মোসাদ এ মর্মে ভুয়া প্রমাণ দাঁড় করায় যে, সাদ্দাম হোসেন আল কায়েদাকে সাহায্য দিচ্ছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
ইরান ওদের লক্ষ্য কেন?
সাদ্দাম ও তার ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে। ইরাক দেশটির ধ্বংস এতো ব্যাপক ও সাংঘাতিক হয়েছে যে, আগামী ৫০ বছরে এ দেশটির আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পাশের দেশ ইরানের বৈশিষ্ট্য তার উদ্ভাবনী প্রতিভা ও কঠোর পরিশ্রম। ইসরাইলি উস্কানিতে ইউরোপ-আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশটি আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, বিজ্ঞানে-প্রকৌশলে অনেক উন্নতি করেছে। বিশেষ করে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে তার অগ্রগতিকে বন্ধুরা প্রশংসার আর শত্রুরা শঙ্কার চোখে দেখছে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, ইরান এখনও পর্যন্ত ইউরেনিয়াম জ্বালানি সমৃদ্ধিকরণের কাজেই অগ্রগতি লাভ করেছে কিন্তু বোমা তৈরির কোনো চেষ্টা সে এখনও করেনি। ইরানের নেতারা বার বার বলছেন—তারা বোমা তৈরি করতে চান না; শুধু পারমাণবিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের উন্নত জ্বালানি তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। ইরানের জন্য সমস্যা এই যে, সর্বোচ্চ গ্রেডের ইউরেনিয়াম দিয়ে যেমন সফলভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়, তেমনি সে ইউরেনিয়াম আবার বোমা তৈরির কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে—যদি সে প্রযুক্তি ইরান আয়ত্ত করতে পারে।
ইসরাইলি গোয়েন্দারা এটা প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যে, বোমা তৈরির প্রযুক্তি ইরান এরই মধ্যে আয়ত্ত করে ফেলেছে এবং আগামী ক’মাসের মধ্যেই তেহরান পারমাণবিক বোমার অধিকারী হবে। মার্কিন সরকারের মূল্যায়ন কিন্তু তেমন নয়। ইচ্ছা করলেও ইরান এত শিগগির বোমা তৈরি করতে পারবে বলে তারা মনে করে না। তা সত্ত্বেও তেলআবিব বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পীড়াপীড়ি, এমনকি ব্ল্যাকমেইল করারও চেষ্টা করছে। ইসরাইলিরা বলছে, ওয়াশিংটন কিছু না করলে তারা নিজেরাই কেন্দ্রগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে। তেমন অবস্থায় ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, ওয়াশিংটনও সে যুদ্ধে না জড়িয়ে পারবে না। মোসাদের লোকেরা এরই মধ্যে ইরানের একাধিক স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা চার ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে খুনও করিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার হয়েছে মহাসমস্যা। যদিও তিনি মনে করেন না ইরানের বোমা তৈরির সময় আসন্ন, তবুও ইসরাইলের চাপ এড়িয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন। আর ৭ মাস পরই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ওবামা আরও চার বছরের জন্য ক্ষমতা পেতে চান। ইসরাইলি লবিগুলোকে অসন্তুষ্ট করে নির্বাচিত হওয়া তার জন্য সহজ হবে না। অন্যদিকে ইরাক আর আফগানিস্তানে যুগপত্ যুদ্ধে মার্কিন অর্থনীতি কাবু হয়ে পড়েছে। এ দুটি দেশে ওয়াশিংটন যতদিন জড়িত, সেটা দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের মোট মেয়াদের চেয়েও বেশি। মার্কিন ভোটদাতারা এখন যুদ্ধক্লান্ত।
সমরবাদের কথা পশ্চিমারা ভুলে গেছে
আগেই বলেছি, জার্মানিতে অ্যান্টিসেমিটিজম নির্মূল করতে গিয়ে আমেরিকা আর ইউরোপ জার্মান মিলিটারিজমের অভিশাপের কথা ভুলে গেছে। গুন্টার গ্রাস সম্প্রতি একটি জার্মান সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘যে কথা বলতেই হবে’ শীর্ষক কবিতায় সে কথাটা আবার বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—‘যে যুদ্ধবাজ জার্মানিকে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত করেছে, সে ভূত এখন ইসরাইলের ঘাড়ে চেপেছে।’ নাম না করে তিনি বলেছেন, ইরান এখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করেনি, তবুুও তার ‘প্রথম আক্রমণের’ অধিকারের জোরে ইসরাইল ইরান আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে; অথচ ইসরাইল নিজেই গোপনে তৈরি করেছে সে বোমা।
গুন্টার গ্রাস ‘যে কথা বলতেই হবে’ কবিতায় লিখেছেন : ‘এতকাল কেন আমি নীরব আর আটকা পড়ে ছিলাম/এমন একটি বিষয়ে যেটা প্রকাশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়/আমরা যারা বেঁচে থাকব সে যুদ্ধের পরে/বড়জোর পাদটীকা হয়েই থাকব আমরা।’
‘প্রথমেই আক্রমণের কথিত অধিকার/ধ্বংস করে দিতে পারে ইরানি জাতিকে/যারা কে গলাবাজ আর সাজানো জলসার পদানত/কেননা তার অধীনে নাকি অ্যাটম বোমা তৈরির কাজ চলছে।’
‘তবু অন্য সে দেশটির নাম নিতে কেন আমার ভরসা হচ্ছে না/বহু বছর ধরে যারা অ্যাটম বোমা গোপন রেখেছে ও বাড়াচ্ছে/আর সবার নজরদারি আর তদারকির বাইরে।’ লিখেছেন গুন্টার গ্রাস।
যে ইহুদিরা একদা নির্যাতিত ছিল, তারা এখন নির্যাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইঙ্গিতে গুন্টার গ্রাস বলতে চেয়েছেন, জার্মান সমরবাদ প্রথমে ইউরোপে এবং তার জের ধরে বাকি বিশ্বে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, ইসরাইলি সমরবাদও তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ডেকে আনতে চায় এবং সে অশান্তি খুব সম্ভবত বৃহত্তর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
গুন্টার গ্রাস এতকাল ইসরাইলসহ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিলেন। বহুবার তিনি ইসরাইল সফরও করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন—তাকে আর ইসরাইলে আসতে দেয়া হবে না। বিশ্বব্যাপী ইসরাইলি লবিগুলো তার সমালোচনার প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে বলেই মনে হয়। এতকাল যিনি ‘হিরো’ ছিলেন, মাত্র একটি কবিতা লিখে তিনি জায়নিস্ট জগতে ‘ভিলেন’ হয়ে গেলেন।
কালো মেঘের রুপালি বর্ণচ্ছটার মতো একটা আশার আলো আছে জার্মান চিন্তানায়ক গুন্টার গ্রাসের এই সাময়িক বিপত্তির মধ্যে। ইসরাইল যে সত্যি সত্যি বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কথা এখন অনেকেই ভাবতে শুরু করবেন। গুন্টারের সাহিত্য অনেকেই পড়েননি কিন্তু তার এই বহু আলোচিত কবিতাটি বহু দেশে, বহু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। (লন্ডন, পহেলা বৈশাখ, ১৪১৯)

serajurrahman@btinternet.com

প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতা বাংলাদেশের জন্য নয়



২০১২-০৪-১৩

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দয়ার শরীর। তার দয়াদাক্ষিণ্য আর বদান্যতার তুলনা নেই। সমস্যা হচ্ছে সব বদান্যতাই তিনি রিজার্ভ রেখেছেন পাশের দেশের জন্য। নিজের দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে তার যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
বাংলাদেশ ধুঁকছে। মধ্যবিত্ত স্বভাবতই সুজন। উপোস থাকলেও ভিক্ষা করা তার ধাতে সইবে না। সস্তা বলে বাজারের সবচেয়ে খারাপ জিনিস কিনবে সে। যৎসামান্য সঞ্চয় অনেক আগেই বিক্রি করে খেয়েছে। সাততাড়াতাড়ি সমৃদ্ধির মুখ দেখার আশায় গ্রামের বাড়ির জমি এবং গিন্নির বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগাঁটি বিক্রি করে শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিল। সরকারি দলের তস্কররা সেটা লুটেপুটে খেয়েছে। ছেলেপুলে ছেঁড়া কাপড় পরে স্কুলে যায়। যাদের চাকরি আছে, তারা সম্বল মাত্র একজোড়া ট্রাউজার ধুয়ে বালিশের নিচে ভাঁজ করে রাখে। সকালবেলা সেটি পরে আপিসে যাবে।
কেউ কেউ এখনো ঘুষ-উৎকোচ আর দুর্নীতির পথে যাননি। সব মানুষই স্বভাবত দুর্নীতিপরায়ণ নয়। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে কেউ কেউ দুর্নীতির পথ ধরেছেন। ইংরেজি প্রবাদ অনুযায়ী ‘দুর্নীতিপরায়ণ সমাজ নৈতিক দেউলিয়া।’ ছেলেপুলের শুকনো মুখ দেখে কেউ কেউ নীতি-নৈতিকতার কাছ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন' তারাও ভালো নেই। অস্বাভাবিক ভ্যাপসা গরমে রাতে ঘুমুতে পারেন না। সিলিংয়ের পাখাটা চালাবেন কী করে? বিদ্যুতের লোডশেডিং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ১৬ ঘণ্টা। শিশুদের স্কুলের পড়া পড়তে হয় টিমটিমে মোমবাতির আলোতে। এ অবস'া চলতে থাকলে তাদের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দেবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একবার নয়, বহুবার বলেছেন যে, অর্থনীতি সঙ্কটে আছে। আরো বলেছেন, ব্যাপক দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন ও অর্থনীতির বিকাশ হতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন অন্য কথা। তিনি বলেন, অর্থনীতির কোনো সমস্যা নেই, অর্থনীতি ভালো অবস'ায় আছে। তাদের মধ্যে কে সত্য কথা বলছেন? কার কথা লোকে বিশ্বাস করবে?
মাঝে মাঝে কলে পানি থাকে না। অন্য সময়ে পাওয়া যায় দুর্গন্ধময় দূষিত পানি। বহু পরিবারে সবাই পেটের অসুখে ভুগছে। যারা মারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে শিশুরাই বেশি। পানি ফুটিয়ে খাবে, তারও উপায় নেই। চুলায় গ্যাস নেই। গিন্নিকে শেষ রাতে উঠে সামান্য কিছু রান্না করে রাখতে হয়। ও সময়ে গ্যাস আসে। সেচের অভাবে ফসল কম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্যের দাম তাতে বেড়ে যাবে। দুর্ভিক্ষ ঘটারও আশঙ্কা বাদ দেয়া যায় না। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, শিগগিরই তিনি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। মানুষ দেখছে উল্টোটা। বিদ্যুৎসঙ্কট এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শোচনীয়। প্রধানমন্ত্রী সে দিন বলেছেন, ‘এত বিদ্যুৎ উৎপাদন করলাম তা যেন চোখেই পড়ে না।’

বিদ্যুৎ ঘাটতির অন্তরালে
মন্ত্রীরা বলেছিলেন, মানুষ বেশি করে, তিনবারের বদলে চারবেলা খাচ্ছে বলেই খাবারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ তো আর খাবার জিনিস নয় যে, বেশি করে খাবে! আর মওজুদ করে রাখার সামগ্রীও নয় বিদ্যুৎ। তা হলে ‘এত বিদ্যুৎ’ গেল কোথায়? লোকে কিন' বলে অন্য কথা। আসলে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কতগুলো বাণিজ্যিক গ্রুপকে ২০ হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে বিনা টেন্ডারে। জানা গেছে, এসব গ্রুপের কোনো কোনোটির মালিক প্রধানমন্ত্রীর কাছের আত্মীয়, অন্যরা আওয়ামী লীগের মহারথী। সরকারি কোষাগার ফতুর করে দেয়া সে টাকা এরাই লুটেপুটে খাচ্ছে। এদের জন্য মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর দয়ার সীমা নেই। আকাশচুম্বী দুর্নীতি চলছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেলায়। জোর গুজব, এই দুর্নীতি সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন বলেই সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর সাগর খুন হয়েছেন। খুনিদের গ্রেফতারে সরকারের অনীহা এসব গুজবকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে। খুনিদের ধরার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে নিয়েছেন। তাতে ফল হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন চা-বিস্কুট খাইয়ে সাংবাদিকদের আর কত দিন শান্ত রাখবেন?
মজার ব্যাপার দেখুন! তিতাস নদীর স্রোত বন্ধ করে সে নদী আর শাখা নদী ও খালগুলোতে বাঁধ দেয়া হলো। কারণ? কারণ এই যে, ভারত আগরতলায় বড় আকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা তৈরি করবে, সে কারখানার জন্য বিরাট আর ভারী যন্ত্রপাতি নিতে হবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। ১৩৪ চাকার বিশাল ট্রেইলারে করে সেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন' বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করা হয়নি। তারপর শোনা গেছে, বাংলাদেশ সে কারখানা চালু রাখার জন্য গ্যাস দেবে আর সে কারখানা থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেবে। সে রকম কারখানা কি বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব ছিল না? বিশেষ করে জ্বালানি যখন দিতে হবে বাংলাদেশকে? একসময় বর্তমান বাংলাদেশ থেকে পাট নিয়ে ব্রিটেনের ডান্ডিতে চট তৈরি হতো, আর সে চটের থলির চালান যেত বাংলাদেশে। নব্য উপনিবেশবাদ দেখছি কি আমরা? 
ভারতের প্রতি হাসিনার ঔদার্যের অবধি নেই। সে দেশের উত্তর-পূর্বের সাতটি অঙ্গরাজ্য বঞ্চিত এবং ক্রুদ্ধ। পাকিস্তানি আমলে আমাদের যেমন বঞ্চিত ও শোষণ করা হয়েছে, তারাও অনুরূপ শোষণের শিকার হচ্ছে দিল্লির হাতে। তাদের রকমারি প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে পশ্চিম ভারতের কেরালা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও পাঞ্জাবকে শিল্পোন্নত করা হয়েছে। কিন' বিনিময়ে তারা পাচ্ছে যৎসামান্য। তারা এই শোষণযন্ত্র থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে চার দশকেরও বেশি আগে। বস'ত তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও পুরনো। 
ভারত সামরিক শক্তি দিয়ে (পাকিস্তানিদের মতো) ন্যায্য অভিযোগ ও অসন্তোষকে টুঁটি টিপে মারার চেষ্টা করছে। সে রাজ্যগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র আর সৈন্য পাঠানোর সহজ পথ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। ওদিকে অরুণাচলে বিস্তীর্ণ বিবদমান এলাকা দখলের জন্য চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাঁয়তারা হচ্ছে ভারতে। চীন যদি শিলিগুড়ি হয়ে সরু সংযোগ পথটি বন্ধ করে দেয় তাহলে উত্তর-পূবের সাতটি রাজ্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তখন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ছাড়া এ রাজ্যগুলোতে যাতায়াতের অন্য কোনো পথ থাকবে না।

যা যা দেয়া হচ্ছে ভারতকে
হয়তো সে জন্যই ‘বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শ’ দিয়ে ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করেছিল। হাসিনাও সুদে-আসলে সে ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করেননি। এশিয়ান হাইওয়ে যাওয়ার কথা ছিল টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ চীন পর্যন্ত। কলমের এক টানে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সে পরিকল্পনা উল্টে দিলেন; বললেন যে, এশিয়ান হাইওয়ে দুই শাখায় বিভক্ত হবে; একটি যাবে বুড়িমারী থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আসামে; আবার দ্বিতীয় শাখাও শেষ হবে আসামে গিয়ে, বেনাপোল থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। যেন বাংলাদেশের জন্য এশিয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে আসামে গিয়েই।
হাসিনা দিল্লিতে গিয়েছিলেন ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। বাংলাদেশের মানুষ শুনেছে, সেখানে অনেক চুক্তি করে এসেছেন তিনি। কিন' চুক্তির বিষয়বস', এমনকি সংখ্যাও বাংলাদেশের মানুষকে জানতে দেয়া হয়নি, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদেরও নয়। ভবিষ্যতেও যাতে কেউ জানতে না পারে, তার ব্যবস'া করার জন্য সংবিধানও পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে সরেজমিন যা ঘটছে, তার থেকে কিছু আঁচ-অনুমান বাংলাদেশের মানুষ করতে পারছে, অনেক কিছু দেখছেও তারা। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল, সড়ক ও নদীপথে উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়ার করিডোর এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর অবাধে ব্যবহারের অধিকার দিতে হাসিনা রাজি হয়ে এসেছেন। প্রয়োজনবোধে তিতাসের মতো অন্য নদীতেও তারা বাঁধ তৈরি করবে বৈকি! বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছু পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান বলেছেন, ভারতের কাছে টাকা চাইলে আমরা অসভ্য হয়ে যাবো।’ ভারতের কাছ থেকে ‘বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শ‘ পাওয়ার এখতিয়ার শুধু শেখ হাসিনার।
কিছুকাল আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সফররত এক কর্মকর্তার কাছে প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করা হয়। প্রমাণ হয় যে, সারা বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস'া তদারকির জন্য তিনি ড. ইউনূসকে উপযুক্ত ব্যক্তি মনে করেছিলেন। ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী সম্মানিত। প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতার (তার ও বাকি বিশ্বের জন্য) জন্য তিনি তাকে যথাযোগ্য ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। তবে ইউনূস বাংলাদেশের সেবা করাকেই শ্রেয় বিবেচনা করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, বদান্যতার বেলায় বিদেশীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষপাতিত্ব। 
ইউনূসকে তিনি বাংলাদেশে তারই স'াপিত ও পরিচালিত গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার উপযুক্ত বিবেচনা করেননি। তাকে অত্যন্ত অশোভনভাবে নিজের গড়ে তোলা ব্যাংক থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। তখন শোনা গিয়েছিল, গ্রামীণফোনের ওপর প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তার পৃষ্ঠপোষকদের কারো কারো লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগের জন্য উপযুক্ত প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করতে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সে কমিটির সদস্য হওয়ার জন্যও ইউনূসকে যোগ্য বিবেচনা করেন না। শেখ হাসিনা শাসিত বাংলাদেশে গ্রামের যোগী ভিখ্‌্ পাবে না। 

বিদেশে মর্যাদাহানি 
একটা কথা মনে রাখতে হবে, ড. ইউনূসের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর গাত্রদাহ শুরু হয় ইউনূস যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার পান তখন থেকেই। শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার কর্মকর্তারা তার জন্য এক ডজনেরও বেশি ডক্টরেট খরিদ করেছিলেন। বর্তমান দফায় ক্ষমতা পাওয়ার পর তিনি তার জন্য একটা নোবেল পুরস্কার সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে কূটনীতিক পাঠিয়েছিলেন দেশে-বিদেশে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে তার পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেন, তার মতে নোবেল পুরস্কারসহ এ দেশের প্রাপ্য সব কিছু তার নিজের হওয়া উচিত। অন্য কেউ বাংলাদেশের জন্য সম্মান নিয়ে এলে সেটাকে গৌরব ভাবতে তার কষ্ট হয়। ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিতে নিজের মর্মবেদনা প্রধানমন্ত্রী এখনো ভুলতে পারেননি মনে হচ্ছে।
ইউনূসের প্রতি শেখ হাসিনার অন্যায্য আচরণ বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদায় যেন এক বোতল কালি ঢেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের তিন নম্বর প্রধান কর্মকর্তা ওয়েন্ডি আর শেরম্যান ঢাকা সফরে এসেছিলেন। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল ড. ইউনূসের প্রতি সরকারের আচরণ। অতি সত্বর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তা নিয়োগের তাগিদ দিয়েছেন শেরম্যান। ওয়াশিংটন স্পষ্টতই ভয় করছে, এই আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে শেয়াল-কুকুরে কামড়াকামড়ি হতে পারে। ইউনূসকে যথাযোগ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধও মিজ শেরম্যান প্রধানমন্ত্রীকে করে গেছেন বলে মনে করা হয়।
মিজ শেরম্যান প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে গোপন বৈঠকে আর যে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন বলে মনে হয়, সেগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশে সব দলের যোগদানের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সুনিশ্চিত করা। এটাও তিনি টের পেয়ে গেছেন যে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ একদলীয় নির্বাচন করলে তাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন হবে। তেমন অবস'ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন অথবা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশও স্বীকৃতি দিতে চাইবে না। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারকে এ বিষয়টা গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।
আগেও জানা গিয়েছিল, বর্তমান সরকারের আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সম্বন্ধে ওয়াশিংটন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিএনপি ও সমমনা গণতান্ত্রিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকারে সরকার যেভাবে বাধা দিচ্ছে, সে বিষয়ে মার্কিন সরকারের অসন'ষ্টির কথাও ওয়েন্ডি শেরম্যান প্রধানমন্ত্রীকে বলে গেছেন। এই মার্কিন কর্মকর্তার সফরের কী প্রতিক্রিয়া হবে, সবাই সে দিকে দৃষ্টি রাখবে। 
লন্ডন, ০৮.০৪.১২
serajurrahman@btinternet.com