বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব


॥ সিরাজুর রহমান ॥

১.
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, সরকার যদি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠির বিবরণ প্রকাশ করতে চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক আপত্তি করবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ 
করে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সে চিঠির বয়ান প্রকাশ করবে না।
ইদানীং সরকার যেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। এমন দিন যায় না যেদিন শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন না। বহু বিবৃতির মধ্যে একটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক (তার সরকারকে) প্রতারণা করেছে। অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য এই ব্যাংক সম্বন্ধে অডিট করতে হবে। তার খাদ্যমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী আর মতিয়া চৌধুরী আত্মপ্রতারণা করছেন। তারা কি এতই শক্তিধর যে তাদের কথায় বাকি পৃথিবী বিশ্বব্যাংক সম্বন্ধে তদন্ত করবে? বিশেষ করে যখন বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ইমেজ ‘নেগেটিভ’। প্রকৃত ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বাংলাদেশের দিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ব্যাংক তারপর এ ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির বিবরণ সরকার গোপন রেখেছে, কিন্তু এক প্রতিবেদনে নাম ধরে এক মন্ত্রী, এক সচিব ও এক ডিরেক্টরের এবং নামোল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। ব্যাংক বলেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেন, অভিযোগ সম্বন্ধে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক হতাশ। অর্থাৎ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংক মঙ্গলবার আরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রতিবিধান করেনি বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্বন্ধে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সম্ভব নয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটা কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, অভিযুক্তরা এতই উচ্চাসনে উপবিষ্ট ও এতই শক্তিধর যে তাদের শাস্তিদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরং সে জন্য সরকার পদ্মা সেতুটি বিসর্জন দিতেও রাজি আছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার ও অন্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন।
‘নিজেদের সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের বহু আয়োজনও একই উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, দেশে নাকি ‘উদ্দীপনার‘ ঢল শুরু হয়েছে। কোন বালক নাকি তার টিফিনের পয়সা সেতু তৈরির জন্য দিতে চেয়েছে। নোয়াখালীর কোন স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। বিলম্ব না করে দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। এগুলোর একটি আবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকার আশা করছে যে প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে বিদেশী মুদ্রা জমা দেবেন।
২.
উদ্দীপনা কিংবা এক বালকের টিফিনের পয়সায় পদ্মার মতো জটিল নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা যায় না। লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে যেটুকু লক্ষ করেছি, আগাগোড়া দুর্নীতির চাদরে আবৃত বর্তমান সরকারের হাতে নিজেদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা তুলে দিতে প্রবাসীরা রাজি হবেন না। তারা জানেন সরকারকে দেয়া অর্থের বেশির ভাগই দুর্নীতির খোরাক জোগাতে লাপাত্তা হয়ে যাবে। সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ যে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর পকেটে যাবে, তার নমুনা দেখা গেছে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার এখন পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করেছে। তাতে বর্তমানে দেশজোড়া যে চাঁদাবাজি চলছে সেটাকেই বৈধতা দেয়া হবে। সে চাঁদাবাজির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র মারা গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে সেতুর অর্থায়ন সম্ভব হবে। শত দুঃখের মধ্যেও এ প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের হাস্যোদ্রেক করবে। পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের যথাসর্বস্ব শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। বহু হাজার কোটি টাকার সে লগ্নি সরকারের পৃষ্ঠপোষকেরা লুটেপুটে খেয়েছে। বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বাবদ জ্বালানি খাত থেকে আরো বহু হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। তেমনি লুটপাট করেছে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারের আওয়ামী লীগপন্থী সিন্ডিকেটগুলো। যদ্দুর জানা যায়, এই টাকার পাহাড় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেসব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সেতুর অর্থায়নের একটা অংশ সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে সেতু নির্মাণের জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে শেয়ারবাজারে লগ্নি করবে।
বলা হচ্ছে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অন্য মন্ত্রী দফতরগুলো থেকেও একই রকমভাবে টাকা নিয়ে সেতু নির্মাণ তহবিলে দেয়া হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সরকারের তহবিলে টাকা নেই। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্যও সরকারকে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হয়। শুনেছি, সরকারের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারীরা নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে সে টাকা ফেরত দেয়ার মতো তারল্য নাকি কোনো কোনো ব্যাংকের নেই। প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলে আমাদের প্রতিরক্ষা, আমাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করার কাজ অবশ্যই বিঘিœত হবে। 
৩.
মাত্র দু-তিন দিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, দুই শ’রও বেশি ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশ এলাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কোস্ট গার্ডকে দেখা যায়নি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও সমানেই সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু মেরামত হয় না। মেঘনা সেতু ধসে পড়েছে বলে দক্ষিণ বাংলাদেশ ও চাঁদপুরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট আঘাত। বরাদ্দ অর্থের একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে ছিনিয়ে নেয়া হলে সড়ক আর সেতুগুলো চলাচলের উপযোগী থাকবে না। 
সবচেয়ে বড় কথা দেশী টাকা বড়জোর মাটি কাটা ও জমির ক্ষতিপূরণ দানের কাজেই লাগতে পারে। মোট ব্যয়ের গরিষ্ঠ অংশই ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি বাবদ। সেই বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়া না হলে তারা টাকা দেবে না। তারা না দিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশও টাকা দিতে রাজি হবে না। ফলে দেখা যাবে যত টাকাই সরকার তুলুক না তাতে সেতু তৈরি হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সন্দেহ করেছেন, সংগৃহীত অর্থ আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার এবং ভোট কেনার কাজেই ব্যয়িত হবে।
পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, সেতুর আনুমানিক ব্যয় দুই হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেবে চীন এবং তারা তিন বছরের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে। চীন সাম্প্রতিক অতীতে উপহার হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একাধিক মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে, তাতে নদীর ওপারেও রাজধানীকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। চীনারা রাজধানীতে বিশাল চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রটিও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সর্বগ্রাসী দৃষ্টি পড়েছিল এই সম্মেলন কেন্দ্রের ওপর। তার কপালেও পাল্টানো নাম লিখে দিয়েছেন।
৪.
যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক চীনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা কারণ, নির্মাণব্যয়ের ১০ শতাংশ দক্ষিণা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হয়নি, চীনারা তো মোটেই দেবে না। আরো বড় কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা সে অনুমতি বর্তমান সরকারকে দেবে না। অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ পুরনো। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধও হয়েছিল। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিস্টরা’ (রণকৌশলবিশারদ) প্রায়ই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে অরুণাচলে চীনের সাথে বড় যুদ্ধ আসন্ন।
পলাশীর মতো ষড়যন্ত্র করে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্র্যানজিট, করিডোর ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দর দু’টি ব্যবহারের অধিকারও বর্তমান সরকার ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভারত এখন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতের দৃষ্টি মূলত চীনের সাথে বিরোধ। দুই দেশে যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যিই শুরু হয়, একমাত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ রণাঙ্গনে পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়। ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন যুদ্ধ শুরু হলে চীন প্রথম চোটেই জলপাইগুড়ির বাগদোগরা বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করবে এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের সরু সংযোগ পথটি বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত তার জঙ্গিবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ঘাঁটি চাইতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান সরকার যে আরো একটি ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নির্মাণ করতে উৎসাহী, তার কারণও ভারতের এ চাহিদা মেটানো।
চীন এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নম্বর পরাশক্তি। অদূর ভবিষ্যতে সে সমরশক্তিতেও এক নম্বরে উঠবে। ভারত আর তার নতুন পাওয়া মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই চীনকে ঘিরে একটা ব্যূহ রচনা করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে একটা নৌঘাঁটি লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এই হচ্ছে কারণ। চীন যদি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত পদ্মা সেতুিট তৈরি করে দেয় তাহলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা অঞ্চলে চীনের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সেটা ওয়াশিংটন কিংবা নয়াদিল্লির মুখরোচক হবে না। 
(লন্ডন, ১৭.০৭.১২) 
serajurrahman34@gmail.com

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

বাংলাদেশী মহাসম্মেলন দেখে এলাম নিউ ইয়র্কে

বাংলাদেশী মহাসম্মেলন দেখে এলাম নিউ ইয়র্কে


॥ সিরাজুর রহমান ॥

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বছর যাওয়া হয়নি। একটা কারণ অবশ্যই ছিলÑ জর্জ ডব্লিউ বুশের আট বছরের শাসন। একঝুড়ি মিথ্যা কারণ দেখিয়ে তিনি ও তার আজ্ঞাবহ বন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। বারো-তেরো লাখ মানুষ নিহত হয়েছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত আর স্থিতিশীল দেশটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর জীবনযাত্রার সঙ্কট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি স্থির করেছিলাম, বুশ যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন আমি সে দেশে যাবো না। তারপর অবশ্য আরো বহু কারণ অন্তরায় ঘটিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানা নিয়মিত আমার কলাম ছাপে। বিদেশে আজকাল বহু বাংলা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। সেটা বাংলাভাষীদের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তির একটা বড় অবদান। ঠিকানা তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। এ পত্রিকার বয়স ২৩ বছর পেরোল এবং নিয়মিত পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০।
সাপ্তাহিক ঠিকানার কর্তৃপক্ষ (তারা বলেন ঠিকানা পরিবার) এবার নিয়ে পরপর তিনবার উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশীদের মহাসম্মেলন উদ্যাপন করলেন। তাদের আমন্ত্রণে স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক ঘুরে এলাম। কর্তৃপক্ষ মহাসম্মেলনের নাম দিয়েছে এবিসি (আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা) কনভেনশন। সঠিক কত লাখ কিংবা কোটি হবে বলতে পারব না, তবে উত্তর আমেরিকায় এখন বহু বাঙালির অধিবাস। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বাংলাদেশী অভিবাসীর সাথে তাদের অনেক তফাৎ। বাংলাদেশীরা ইউরোপে প্রথম এসেছিলেন অর্থনৈতিক ভাগ্য ফেরানোর আশায়। অন্য দিকে সাধারণত উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাজীবীরাই উত্তর আমেরিকায় এসেছেন। 
অনেকে এসেছিলেন প্রযুক্তি-প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং মানবিকবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাসমাপন করে অনেকেই দেখলেন, তাদের শিক্ষা ও যোগ্যতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করার আয়োজন দেশের নেতারা এখনো করে উঠতে পারেননি। একই সাথে উত্তর আমেরিকায় খুবই সহজে এবং উঁচু বেতনে চাকরি পেতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এই মহাদেশের দেশগুলো উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নতিকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আরো বহু দক্ষ ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন। বহিরাগত ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা পেয়ে সে চাহিদা পূরণ করেন। 
প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দশ-বারো হাজার মাইল দূরে থাকেন বলেই বোধ করি স্বদেশকে তারা এমন গভীরভাবে ভালোবাসেন। দেশের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে, দেশবাসীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এবং দেশের উন্নতি-প্রগতির পন্থা নিয়ে ভাব-বিনিময়ে তাদের আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশাল-বিস্তীর্ণ দু’টি দেশ। কেউ কেউ দুই কিংবা তিন হাজার মাইল দূর থেকেও স্বদেশীদের সভা-সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। সৌভাগ্যবশত আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে তারা ভোগেন না। এবিসি কনভেনশনের মতো মহাসম্মেলনগুলো সে কারণেই খুবই জনপ্রিয় এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর আমেরিকায় ফোবানা (ফেডারেশন অব বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) নামে আরো একটা সংস্থা আগে এ জাতীয় সভা-সম্মেলন করত। বেশ কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে তাদের একটা মহাসম্মেলনে যোগদানের সুযোগ আমারও হয়েছিল। কিন্তু ফোবানা এখন বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নির্জীব হয়ে পড়েছে। শুনেছি বাঙালিদের স্বভাবজাত পরশ্রীকাতরতা এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে অর্থহীন দলাদলি এর কারণ। এবিসি মহাসম্মেলনে উপস্থিত দু-একজন বলছিলেন, এ সম্মেলন ফোবানার শূন্যতা অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছে।
এবিসি সম্মেলন সম্বন্ধে প্রথমেই বলতে হয় তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। এই সুদূর থেকে প্রকাশিত একখানি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পূর্ণ নিজেদের আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য দিয়ে এত বড় একটা আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন করলেন সেটাই এক বিস্ময়। তাও শুধু একবার নয়। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আগের দুটো বার্ষিক সম্মেলনও সমানেই সফল হয়েছিল।
বিদেশে ভালো আয়-উপার্জন এবং উন্নত জীবন সত্ত্বেও পেছনে ফেলে আসা মাতৃভূমির সমস্যাগুলোর সমাধান করে বাংলাদেশটাকে সুদিনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে তাদের চিন্তাভাবনার কতখানি জুড়ে আছে, সম্মেলনের সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচনে সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু’, ‘আউট সোর্সিং : বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের উন্নয়ন পরিকল্পনা’, ‘পানি আগ্রাসন : ভাটি অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ে কতটা হুমকি’; ‘করপোরেট আমেরিকায় ভাগ্য গড়–ন : মেধার আর অপচয় নয়’; ‘দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা : স্বাধীন না পরাধীন’; ‘বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোথায়?’ এবং ‘বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন বাংলা ভাষার জন্য কতটুকু হুমকি?’; ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি কি না’; ‘বাংলাদেশে কোন তন্ত্র বিদ্যমানÑ গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র না পরিবারতন্ত্র?’ ইত্যাদি।
সেমিনার এবং টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচন থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা-সঙ্কটগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের চিন্তাভাবনার অনেকখানি জুড়ে আছে। এসব আলোচনায় অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখেছেন প্রবাসী ও আমন্ত্রিত চিন্তাবিদরা। প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. খলিলুর রহমান. ড. আলী রিয়াজ প্রমুখ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান অধ্যাপকরা। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কলামিস্ট ফরহাদ মজহার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। লন্ডন থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান, বিবিসি বাংলা বিভাগের বর্তমান প্রধান সাবির মোস্তাফা ও আমি (সিরাজুর রহমান)।
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আসবেন বলে বিশেষ প্রচার চালানো হয়েছিল। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হবে মনে করে আমিও প্রীত ছিলাম। তিনি আসবেন বলে সম্মতি দিলেও মাত্র দুই দিন আগে কোনো অজ্ঞাত কারণে আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। মহাসম্মেলনে কানাঘুষা শুনলাম, আমাদের কারো কারো উপস্থিতির প্রতিবাদে উত্তর আমেরিকার আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা এ সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। বুড়ি-ছুঁই গোছের মতো করে নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন এবং একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আলোচনা ইত্যাদিতে আওয়ামী লীগপন্থী আর যাদের অংশগ্রহণের কথা ছিল, তারা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। অবশ্য তাই বলে সম্মেলনের অঙ্গহানি হয়নি। দুই দিনে দীর্ঘ অধিবেশনের প্রায় সময়ই বিশাল সম্মেলনকেন্দ্রে প্রচুর জনসমাগম দেখেছি। 

শূদ্রদের দেববাক্য শোনা নিষিদ্ধ
আপনারা কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানি না, আওয়ামী লীগের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সমর্থকদের ভিন্ন মতবাদ শোনা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার ধর্মগ্রন্থগুলো সীমিত রেখেছিল। সেসব গ্রন্থের বক্তব্য, এমনকি সংস্কৃত ভাষা শোনাও অব্রাহ্মণ্যদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বিধান দিয়েছিলেন, কোনো অব্রাহ্মণ দেব-ভাষা সংস্কৃত শুনে ফেললে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিতে হবে। বোধ করি ব্রাহ্মণরা ভেবেছিলেন, অব্রাহ্মণরা সংস্কৃত শিখে ফেললে তাদের বহু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারাও নিশ্চয়ই মনে করেন, ভিন্ন মতামতের ছোঁয়াচ লাগলে তাদের সমর্থকরা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ভিন্ন মতবাদের কাউকে তাদের ধারে-কাছেও ভিড়তে দেয় না। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ রীতি নিন্দনীয় হবে।
এতক্ষণ যা বলছিলাম তার থেকে মনে হতে পারে যে, নিরস-নিকষ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নিউ ইয়র্কের এবিসি মহাসম্মেলন। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। উভয় দিনের অনুষ্ঠানই শেষ হয়েছে নৃত্য ও সঙ্গীতের দীর্ঘ আসর দিয়ে। তা ছাড়া কয়েকটা আলোচনা অনুষ্ঠানের পরপরই আরো ছোট আকারে গান-বাজনা ও সঙ্গীত দিয়ে দর্শকদের বিনোদন করা হয়। বাংলাদেশের শিল্পী শবনম মুশতারী ও বেবী নাজনীনরা উত্তর আমেরিকা নিবাসী শিল্পীদের সাথে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন। উদ্যোক্তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুষ্ঠানগুলোকে সবিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলেন। ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কলকাতা থেকে আগত আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা মনোজ্ঞ আবৃত্তি দিয়ে সকলকে সম্মোহিত করেন। প্রবাসীদের লিখিত গ্রন্থের একটা প্রদর্শনীও ছিল মহাসম্মেলনে।
বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এবং ক্রীড়া সম্বন্ধেও একাধিক আলোচনা বৈঠক হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক বদহজমের ভয়ে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। উদ্যোক্তাদের একটা মহতী আয়োজন ছিল উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন পেশায় অসাধারণ প্রতিভা ও কৃতিত্বের অধিকারী বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান। কয়েকজনকে ক্রেস্ট দিতে পেরে আমি সম্মানীত বোধ করেছি।
মহাসম্মেলনের অলিখিত এবং অনুচ্চারিত বিরাট লাভজনক দিক ছিল পুরনো ও নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতা ও মতামত বিনিময়। আমি নিজেও ইকবাল বাহার চৌধুরী, কাফি খান, দিলারা হাসেম, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, সরকার কবীরুদ্দিন প্রমুখ সহবেতারকর্মী বন্ধুদের সাথে দীর্ঘকাল পরে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে প্রীত হয়েছিলাম। রাষ্ট্রদূত রফিক আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর সাথেও দেখা হলো বহু বছর পরে। সত্তরের দশকের বিবিসি শ্রোতাসঙ্ঘের কর্মকর্তা আকবর হায়দার কিরণের সাক্ষাৎ পেলাম মহাসম্মেলনে। নিউ ইয়র্কের ‘ব্রিক লেন’ জ্যাকসন হাইটস দেখালেন তিনি, বাঁশপাতারি ইলিশ ও বেলে মাছ সহযোগে ডাল-ভাত খাওয়ালেন।
সবশেষে ঠিকানা পরিবারের সদস্যদের কথা বলতেই হয়। এর পরিবারের প্রধান সাইদুর রবের নেতৃত্বে ফজলুর রহমান, দেওয়ান শামসুল আরেফিন, মঞ্জুর হোসেন, মিজানুর রহমান প্রমুখরা যেমন কঠোর পরিশ্রম ও গঠনমূলক কল্পনাশক্তি দিয়ে এমন মনোজ্ঞ মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেটা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কোনো সন্দেহ নেই, তাদের ভবিষ্যৎ আয়োজনগুলোও সমানেই সার্থক হবে। 
লন্ডন, ০৩.০৭.১২
serajurrahman34@gmail.com