॥ সিরাজুর রহমান ॥
১.
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, সরকার যদি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠির বিবরণ প্রকাশ করতে চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক আপত্তি করবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ
করে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সে চিঠির বয়ান প্রকাশ করবে না।
ইদানীং সরকার যেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। এমন দিন যায় না যেদিন শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন না। বহু বিবৃতির মধ্যে একটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক (তার সরকারকে) প্রতারণা করেছে। অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য এই ব্যাংক সম্বন্ধে অডিট করতে হবে। তার খাদ্যমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী আর মতিয়া চৌধুরী আত্মপ্রতারণা করছেন। তারা কি এতই শক্তিধর যে তাদের কথায় বাকি পৃথিবী বিশ্বব্যাংক সম্বন্ধে তদন্ত করবে? বিশেষ করে যখন বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ইমেজ ‘নেগেটিভ’। প্রকৃত ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বাংলাদেশের দিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ব্যাংক তারপর এ ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির বিবরণ সরকার গোপন রেখেছে, কিন্তু এক প্রতিবেদনে নাম ধরে এক মন্ত্রী, এক সচিব ও এক ডিরেক্টরের এবং নামোল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। ব্যাংক বলেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেন, অভিযোগ সম্বন্ধে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক হতাশ। অর্থাৎ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংক মঙ্গলবার আরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রতিবিধান করেনি বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্বন্ধে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সম্ভব নয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটা কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, অভিযুক্তরা এতই উচ্চাসনে উপবিষ্ট ও এতই শক্তিধর যে তাদের শাস্তিদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরং সে জন্য সরকার পদ্মা সেতুটি বিসর্জন দিতেও রাজি আছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার ও অন্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন।
‘নিজেদের সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের বহু আয়োজনও একই উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, দেশে নাকি ‘উদ্দীপনার‘ ঢল শুরু হয়েছে। কোন বালক নাকি তার টিফিনের পয়সা সেতু তৈরির জন্য দিতে চেয়েছে। নোয়াখালীর কোন স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। বিলম্ব না করে দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। এগুলোর একটি আবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকার আশা করছে যে প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে বিদেশী মুদ্রা জমা দেবেন।
২.
উদ্দীপনা কিংবা এক বালকের টিফিনের পয়সায় পদ্মার মতো জটিল নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা যায় না। লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে যেটুকু লক্ষ করেছি, আগাগোড়া দুর্নীতির চাদরে আবৃত বর্তমান সরকারের হাতে নিজেদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা তুলে দিতে প্রবাসীরা রাজি হবেন না। তারা জানেন সরকারকে দেয়া অর্থের বেশির ভাগই দুর্নীতির খোরাক জোগাতে লাপাত্তা হয়ে যাবে। সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ যে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর পকেটে যাবে, তার নমুনা দেখা গেছে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার এখন পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করেছে। তাতে বর্তমানে দেশজোড়া যে চাঁদাবাজি চলছে সেটাকেই বৈধতা দেয়া হবে। সে চাঁদাবাজির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র মারা গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে সেতুর অর্থায়ন সম্ভব হবে। শত দুঃখের মধ্যেও এ প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের হাস্যোদ্রেক করবে। পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের যথাসর্বস্ব শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। বহু হাজার কোটি টাকার সে লগ্নি সরকারের পৃষ্ঠপোষকেরা লুটেপুটে খেয়েছে। বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বাবদ জ্বালানি খাত থেকে আরো বহু হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। তেমনি লুটপাট করেছে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারের আওয়ামী লীগপন্থী সিন্ডিকেটগুলো। যদ্দুর জানা যায়, এই টাকার পাহাড় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেসব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সেতুর অর্থায়নের একটা অংশ সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে সেতু নির্মাণের জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে শেয়ারবাজারে লগ্নি করবে।
বলা হচ্ছে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অন্য মন্ত্রী দফতরগুলো থেকেও একই রকমভাবে টাকা নিয়ে সেতু নির্মাণ তহবিলে দেয়া হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সরকারের তহবিলে টাকা নেই। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্যও সরকারকে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হয়। শুনেছি, সরকারের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারীরা নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে সে টাকা ফেরত দেয়ার মতো তারল্য নাকি কোনো কোনো ব্যাংকের নেই। প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলে আমাদের প্রতিরক্ষা, আমাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করার কাজ অবশ্যই বিঘিœত হবে।
৩.
মাত্র দু-তিন দিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, দুই শ’রও বেশি ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশ এলাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কোস্ট গার্ডকে দেখা যায়নি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও সমানেই সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু মেরামত হয় না। মেঘনা সেতু ধসে পড়েছে বলে দক্ষিণ বাংলাদেশ ও চাঁদপুরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট আঘাত। বরাদ্দ অর্থের একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে ছিনিয়ে নেয়া হলে সড়ক আর সেতুগুলো চলাচলের উপযোগী থাকবে না।
সবচেয়ে বড় কথা দেশী টাকা বড়জোর মাটি কাটা ও জমির ক্ষতিপূরণ দানের কাজেই লাগতে পারে। মোট ব্যয়ের গরিষ্ঠ অংশই ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি বাবদ। সেই বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়া না হলে তারা টাকা দেবে না। তারা না দিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশও টাকা দিতে রাজি হবে না। ফলে দেখা যাবে যত টাকাই সরকার তুলুক না তাতে সেতু তৈরি হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সন্দেহ করেছেন, সংগৃহীত অর্থ আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার এবং ভোট কেনার কাজেই ব্যয়িত হবে।
পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, সেতুর আনুমানিক ব্যয় দুই হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেবে চীন এবং তারা তিন বছরের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে। চীন সাম্প্রতিক অতীতে উপহার হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একাধিক মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে, তাতে নদীর ওপারেও রাজধানীকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। চীনারা রাজধানীতে বিশাল চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রটিও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সর্বগ্রাসী দৃষ্টি পড়েছিল এই সম্মেলন কেন্দ্রের ওপর। তার কপালেও পাল্টানো নাম লিখে দিয়েছেন।
৪.
যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক চীনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা কারণ, নির্মাণব্যয়ের ১০ শতাংশ দক্ষিণা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হয়নি, চীনারা তো মোটেই দেবে না। আরো বড় কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা সে অনুমতি বর্তমান সরকারকে দেবে না। অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ পুরনো। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধও হয়েছিল। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিস্টরা’ (রণকৌশলবিশারদ) প্রায়ই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে অরুণাচলে চীনের সাথে বড় যুদ্ধ আসন্ন।
পলাশীর মতো ষড়যন্ত্র করে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্র্যানজিট, করিডোর ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দর দু’টি ব্যবহারের অধিকারও বর্তমান সরকার ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভারত এখন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতের দৃষ্টি মূলত চীনের সাথে বিরোধ। দুই দেশে যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যিই শুরু হয়, একমাত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ রণাঙ্গনে পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়। ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন যুদ্ধ শুরু হলে চীন প্রথম চোটেই জলপাইগুড়ির বাগদোগরা বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করবে এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের সরু সংযোগ পথটি বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত তার জঙ্গিবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ঘাঁটি চাইতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান সরকার যে আরো একটি ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নির্মাণ করতে উৎসাহী, তার কারণও ভারতের এ চাহিদা মেটানো।
চীন এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নম্বর পরাশক্তি। অদূর ভবিষ্যতে সে সমরশক্তিতেও এক নম্বরে উঠবে। ভারত আর তার নতুন পাওয়া মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই চীনকে ঘিরে একটা ব্যূহ রচনা করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে একটা নৌঘাঁটি লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এই হচ্ছে কারণ। চীন যদি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত পদ্মা সেতুিট তৈরি করে দেয় তাহলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা অঞ্চলে চীনের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সেটা ওয়াশিংটন কিংবা নয়াদিল্লির মুখরোচক হবে না।
(লন্ডন, ১৭.০৭.১২)
serajurrahman34@gmail.com
১.
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, সরকার যদি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠির বিবরণ প্রকাশ করতে চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক আপত্তি করবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ
করে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সে চিঠির বয়ান প্রকাশ করবে না।
ইদানীং সরকার যেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। এমন দিন যায় না যেদিন শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন না। বহু বিবৃতির মধ্যে একটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক (তার সরকারকে) প্রতারণা করেছে। অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য এই ব্যাংক সম্বন্ধে অডিট করতে হবে। তার খাদ্যমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী আর মতিয়া চৌধুরী আত্মপ্রতারণা করছেন। তারা কি এতই শক্তিধর যে তাদের কথায় বাকি পৃথিবী বিশ্বব্যাংক সম্বন্ধে তদন্ত করবে? বিশেষ করে যখন বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ইমেজ ‘নেগেটিভ’। প্রকৃত ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বাংলাদেশের দিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ব্যাংক তারপর এ ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির বিবরণ সরকার গোপন রেখেছে, কিন্তু এক প্রতিবেদনে নাম ধরে এক মন্ত্রী, এক সচিব ও এক ডিরেক্টরের এবং নামোল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। ব্যাংক বলেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেন, অভিযোগ সম্বন্ধে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক হতাশ। অর্থাৎ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংক মঙ্গলবার আরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রতিবিধান করেনি বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্বন্ধে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সম্ভব নয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটা কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, অভিযুক্তরা এতই উচ্চাসনে উপবিষ্ট ও এতই শক্তিধর যে তাদের শাস্তিদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরং সে জন্য সরকার পদ্মা সেতুটি বিসর্জন দিতেও রাজি আছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার ও অন্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন।
‘নিজেদের সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের বহু আয়োজনও একই উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, দেশে নাকি ‘উদ্দীপনার‘ ঢল শুরু হয়েছে। কোন বালক নাকি তার টিফিনের পয়সা সেতু তৈরির জন্য দিতে চেয়েছে। নোয়াখালীর কোন স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। বিলম্ব না করে দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। এগুলোর একটি আবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকার আশা করছে যে প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে বিদেশী মুদ্রা জমা দেবেন।
২.
উদ্দীপনা কিংবা এক বালকের টিফিনের পয়সায় পদ্মার মতো জটিল নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা যায় না। লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে যেটুকু লক্ষ করেছি, আগাগোড়া দুর্নীতির চাদরে আবৃত বর্তমান সরকারের হাতে নিজেদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা তুলে দিতে প্রবাসীরা রাজি হবেন না। তারা জানেন সরকারকে দেয়া অর্থের বেশির ভাগই দুর্নীতির খোরাক জোগাতে লাপাত্তা হয়ে যাবে। সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ যে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর পকেটে যাবে, তার নমুনা দেখা গেছে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার এখন পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করেছে। তাতে বর্তমানে দেশজোড়া যে চাঁদাবাজি চলছে সেটাকেই বৈধতা দেয়া হবে। সে চাঁদাবাজির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র মারা গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে সেতুর অর্থায়ন সম্ভব হবে। শত দুঃখের মধ্যেও এ প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের হাস্যোদ্রেক করবে। পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের যথাসর্বস্ব শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। বহু হাজার কোটি টাকার সে লগ্নি সরকারের পৃষ্ঠপোষকেরা লুটেপুটে খেয়েছে। বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বাবদ জ্বালানি খাত থেকে আরো বহু হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। তেমনি লুটপাট করেছে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারের আওয়ামী লীগপন্থী সিন্ডিকেটগুলো। যদ্দুর জানা যায়, এই টাকার পাহাড় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেসব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সেতুর অর্থায়নের একটা অংশ সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে সেতু নির্মাণের জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে শেয়ারবাজারে লগ্নি করবে।
বলা হচ্ছে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অন্য মন্ত্রী দফতরগুলো থেকেও একই রকমভাবে টাকা নিয়ে সেতু নির্মাণ তহবিলে দেয়া হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সরকারের তহবিলে টাকা নেই। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্যও সরকারকে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হয়। শুনেছি, সরকারের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারীরা নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে সে টাকা ফেরত দেয়ার মতো তারল্য নাকি কোনো কোনো ব্যাংকের নেই। প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলে আমাদের প্রতিরক্ষা, আমাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করার কাজ অবশ্যই বিঘিœত হবে।
৩.
মাত্র দু-তিন দিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, দুই শ’রও বেশি ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশ এলাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কোস্ট গার্ডকে দেখা যায়নি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও সমানেই সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু মেরামত হয় না। মেঘনা সেতু ধসে পড়েছে বলে দক্ষিণ বাংলাদেশ ও চাঁদপুরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট আঘাত। বরাদ্দ অর্থের একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে ছিনিয়ে নেয়া হলে সড়ক আর সেতুগুলো চলাচলের উপযোগী থাকবে না।
সবচেয়ে বড় কথা দেশী টাকা বড়জোর মাটি কাটা ও জমির ক্ষতিপূরণ দানের কাজেই লাগতে পারে। মোট ব্যয়ের গরিষ্ঠ অংশই ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি বাবদ। সেই বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়া না হলে তারা টাকা দেবে না। তারা না দিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশও টাকা দিতে রাজি হবে না। ফলে দেখা যাবে যত টাকাই সরকার তুলুক না তাতে সেতু তৈরি হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সন্দেহ করেছেন, সংগৃহীত অর্থ আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার এবং ভোট কেনার কাজেই ব্যয়িত হবে।
পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, সেতুর আনুমানিক ব্যয় দুই হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেবে চীন এবং তারা তিন বছরের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে। চীন সাম্প্রতিক অতীতে উপহার হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একাধিক মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে, তাতে নদীর ওপারেও রাজধানীকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। চীনারা রাজধানীতে বিশাল চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রটিও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সর্বগ্রাসী দৃষ্টি পড়েছিল এই সম্মেলন কেন্দ্রের ওপর। তার কপালেও পাল্টানো নাম লিখে দিয়েছেন।
৪.
যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক চীনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা কারণ, নির্মাণব্যয়ের ১০ শতাংশ দক্ষিণা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হয়নি, চীনারা তো মোটেই দেবে না। আরো বড় কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা সে অনুমতি বর্তমান সরকারকে দেবে না। অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ পুরনো। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধও হয়েছিল। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিস্টরা’ (রণকৌশলবিশারদ) প্রায়ই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে অরুণাচলে চীনের সাথে বড় যুদ্ধ আসন্ন।
পলাশীর মতো ষড়যন্ত্র করে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্র্যানজিট, করিডোর ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দর দু’টি ব্যবহারের অধিকারও বর্তমান সরকার ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভারত এখন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতের দৃষ্টি মূলত চীনের সাথে বিরোধ। দুই দেশে যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যিই শুরু হয়, একমাত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ রণাঙ্গনে পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়। ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন যুদ্ধ শুরু হলে চীন প্রথম চোটেই জলপাইগুড়ির বাগদোগরা বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করবে এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের সরু সংযোগ পথটি বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত তার জঙ্গিবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ঘাঁটি চাইতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান সরকার যে আরো একটি ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নির্মাণ করতে উৎসাহী, তার কারণও ভারতের এ চাহিদা মেটানো।
চীন এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নম্বর পরাশক্তি। অদূর ভবিষ্যতে সে সমরশক্তিতেও এক নম্বরে উঠবে। ভারত আর তার নতুন পাওয়া মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই চীনকে ঘিরে একটা ব্যূহ রচনা করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে একটা নৌঘাঁটি লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এই হচ্ছে কারণ। চীন যদি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত পদ্মা সেতুিট তৈরি করে দেয় তাহলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা অঞ্চলে চীনের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সেটা ওয়াশিংটন কিংবা নয়াদিল্লির মুখরোচক হবে না।
(লন্ডন, ১৭.০৭.১২)
serajurrahman34@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন