॥ সিরাজুর রহমান ॥
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বছর যাওয়া হয়নি। একটা কারণ অবশ্যই ছিলÑ জর্জ ডব্লিউ বুশের আট বছরের শাসন। একঝুড়ি মিথ্যা কারণ দেখিয়ে তিনি ও তার আজ্ঞাবহ বন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। বারো-তেরো লাখ মানুষ নিহত হয়েছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত আর স্থিতিশীল দেশটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর জীবনযাত্রার সঙ্কট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি স্থির করেছিলাম, বুশ যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন আমি সে দেশে যাবো না। তারপর অবশ্য আরো বহু কারণ অন্তরায় ঘটিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানা নিয়মিত আমার কলাম ছাপে। বিদেশে আজকাল বহু বাংলা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। সেটা বাংলাভাষীদের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তির একটা বড় অবদান। ঠিকানা তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। এ পত্রিকার বয়স ২৩ বছর পেরোল এবং নিয়মিত পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০।
সাপ্তাহিক ঠিকানার কর্তৃপক্ষ (তারা বলেন ঠিকানা পরিবার) এবার নিয়ে পরপর তিনবার উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশীদের মহাসম্মেলন উদ্যাপন করলেন। তাদের আমন্ত্রণে স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক ঘুরে এলাম। কর্তৃপক্ষ মহাসম্মেলনের নাম দিয়েছে এবিসি (আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা) কনভেনশন। সঠিক কত লাখ কিংবা কোটি হবে বলতে পারব না, তবে উত্তর আমেরিকায় এখন বহু বাঙালির অধিবাস। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বাংলাদেশী অভিবাসীর সাথে তাদের অনেক তফাৎ। বাংলাদেশীরা ইউরোপে প্রথম এসেছিলেন অর্থনৈতিক ভাগ্য ফেরানোর আশায়। অন্য দিকে সাধারণত উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাজীবীরাই উত্তর আমেরিকায় এসেছেন।
অনেকে এসেছিলেন প্রযুক্তি-প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং মানবিকবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাসমাপন করে অনেকেই দেখলেন, তাদের শিক্ষা ও যোগ্যতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করার আয়োজন দেশের নেতারা এখনো করে উঠতে পারেননি। একই সাথে উত্তর আমেরিকায় খুবই সহজে এবং উঁচু বেতনে চাকরি পেতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এই মহাদেশের দেশগুলো উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নতিকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আরো বহু দক্ষ ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন। বহিরাগত ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা পেয়ে সে চাহিদা পূরণ করেন।
প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দশ-বারো হাজার মাইল দূরে থাকেন বলেই বোধ করি স্বদেশকে তারা এমন গভীরভাবে ভালোবাসেন। দেশের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে, দেশবাসীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এবং দেশের উন্নতি-প্রগতির পন্থা নিয়ে ভাব-বিনিময়ে তাদের আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশাল-বিস্তীর্ণ দু’টি দেশ। কেউ কেউ দুই কিংবা তিন হাজার মাইল দূর থেকেও স্বদেশীদের সভা-সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। সৌভাগ্যবশত আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে তারা ভোগেন না। এবিসি কনভেনশনের মতো মহাসম্মেলনগুলো সে কারণেই খুবই জনপ্রিয় এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর আমেরিকায় ফোবানা (ফেডারেশন অব বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) নামে আরো একটা সংস্থা আগে এ জাতীয় সভা-সম্মেলন করত। বেশ কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে তাদের একটা মহাসম্মেলনে যোগদানের সুযোগ আমারও হয়েছিল। কিন্তু ফোবানা এখন বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নির্জীব হয়ে পড়েছে। শুনেছি বাঙালিদের স্বভাবজাত পরশ্রীকাতরতা এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে অর্থহীন দলাদলি এর কারণ। এবিসি মহাসম্মেলনে উপস্থিত দু-একজন বলছিলেন, এ সম্মেলন ফোবানার শূন্যতা অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছে।
এবিসি সম্মেলন সম্বন্ধে প্রথমেই বলতে হয় তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। এই সুদূর থেকে প্রকাশিত একখানি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পূর্ণ নিজেদের আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য দিয়ে এত বড় একটা আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন করলেন সেটাই এক বিস্ময়। তাও শুধু একবার নয়। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আগের দুটো বার্ষিক সম্মেলনও সমানেই সফল হয়েছিল।
বিদেশে ভালো আয়-উপার্জন এবং উন্নত জীবন সত্ত্বেও পেছনে ফেলে আসা মাতৃভূমির সমস্যাগুলোর সমাধান করে বাংলাদেশটাকে সুদিনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে তাদের চিন্তাভাবনার কতখানি জুড়ে আছে, সম্মেলনের সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচনে সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু’, ‘আউট সোর্সিং : বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের উন্নয়ন পরিকল্পনা’, ‘পানি আগ্রাসন : ভাটি অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ে কতটা হুমকি’; ‘করপোরেট আমেরিকায় ভাগ্য গড়–ন : মেধার আর অপচয় নয়’; ‘দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা : স্বাধীন না পরাধীন’; ‘বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোথায়?’ এবং ‘বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন বাংলা ভাষার জন্য কতটুকু হুমকি?’; ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি কি না’; ‘বাংলাদেশে কোন তন্ত্র বিদ্যমানÑ গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র না পরিবারতন্ত্র?’ ইত্যাদি।
সেমিনার এবং টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচন থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা-সঙ্কটগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের চিন্তাভাবনার অনেকখানি জুড়ে আছে। এসব আলোচনায় অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখেছেন প্রবাসী ও আমন্ত্রিত চিন্তাবিদরা। প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. খলিলুর রহমান. ড. আলী রিয়াজ প্রমুখ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান অধ্যাপকরা। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কলামিস্ট ফরহাদ মজহার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। লন্ডন থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান, বিবিসি বাংলা বিভাগের বর্তমান প্রধান সাবির মোস্তাফা ও আমি (সিরাজুর রহমান)।
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আসবেন বলে বিশেষ প্রচার চালানো হয়েছিল। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হবে মনে করে আমিও প্রীত ছিলাম। তিনি আসবেন বলে সম্মতি দিলেও মাত্র দুই দিন আগে কোনো অজ্ঞাত কারণে আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। মহাসম্মেলনে কানাঘুষা শুনলাম, আমাদের কারো কারো উপস্থিতির প্রতিবাদে উত্তর আমেরিকার আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা এ সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। বুড়ি-ছুঁই গোছের মতো করে নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন এবং একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আলোচনা ইত্যাদিতে আওয়ামী লীগপন্থী আর যাদের অংশগ্রহণের কথা ছিল, তারা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। অবশ্য তাই বলে সম্মেলনের অঙ্গহানি হয়নি। দুই দিনে দীর্ঘ অধিবেশনের প্রায় সময়ই বিশাল সম্মেলনকেন্দ্রে প্রচুর জনসমাগম দেখেছি।
শূদ্রদের দেববাক্য শোনা নিষিদ্ধ
আপনারা কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানি না, আওয়ামী লীগের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সমর্থকদের ভিন্ন মতবাদ শোনা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার ধর্মগ্রন্থগুলো সীমিত রেখেছিল। সেসব গ্রন্থের বক্তব্য, এমনকি সংস্কৃত ভাষা শোনাও অব্রাহ্মণ্যদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বিধান দিয়েছিলেন, কোনো অব্রাহ্মণ দেব-ভাষা সংস্কৃত শুনে ফেললে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিতে হবে। বোধ করি ব্রাহ্মণরা ভেবেছিলেন, অব্রাহ্মণরা সংস্কৃত শিখে ফেললে তাদের বহু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারাও নিশ্চয়ই মনে করেন, ভিন্ন মতামতের ছোঁয়াচ লাগলে তাদের সমর্থকরা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ভিন্ন মতবাদের কাউকে তাদের ধারে-কাছেও ভিড়তে দেয় না। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ রীতি নিন্দনীয় হবে।
এতক্ষণ যা বলছিলাম তার থেকে মনে হতে পারে যে, নিরস-নিকষ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নিউ ইয়র্কের এবিসি মহাসম্মেলন। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। উভয় দিনের অনুষ্ঠানই শেষ হয়েছে নৃত্য ও সঙ্গীতের দীর্ঘ আসর দিয়ে। তা ছাড়া কয়েকটা আলোচনা অনুষ্ঠানের পরপরই আরো ছোট আকারে গান-বাজনা ও সঙ্গীত দিয়ে দর্শকদের বিনোদন করা হয়। বাংলাদেশের শিল্পী শবনম মুশতারী ও বেবী নাজনীনরা উত্তর আমেরিকা নিবাসী শিল্পীদের সাথে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন। উদ্যোক্তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুষ্ঠানগুলোকে সবিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলেন। ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কলকাতা থেকে আগত আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা মনোজ্ঞ আবৃত্তি দিয়ে সকলকে সম্মোহিত করেন। প্রবাসীদের লিখিত গ্রন্থের একটা প্রদর্শনীও ছিল মহাসম্মেলনে।
বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এবং ক্রীড়া সম্বন্ধেও একাধিক আলোচনা বৈঠক হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক বদহজমের ভয়ে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। উদ্যোক্তাদের একটা মহতী আয়োজন ছিল উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন পেশায় অসাধারণ প্রতিভা ও কৃতিত্বের অধিকারী বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান। কয়েকজনকে ক্রেস্ট দিতে পেরে আমি সম্মানীত বোধ করেছি।
মহাসম্মেলনের অলিখিত এবং অনুচ্চারিত বিরাট লাভজনক দিক ছিল পুরনো ও নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতা ও মতামত বিনিময়। আমি নিজেও ইকবাল বাহার চৌধুরী, কাফি খান, দিলারা হাসেম, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, সরকার কবীরুদ্দিন প্রমুখ সহবেতারকর্মী বন্ধুদের সাথে দীর্ঘকাল পরে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে প্রীত হয়েছিলাম। রাষ্ট্রদূত রফিক আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর সাথেও দেখা হলো বহু বছর পরে। সত্তরের দশকের বিবিসি শ্রোতাসঙ্ঘের কর্মকর্তা আকবর হায়দার কিরণের সাক্ষাৎ পেলাম মহাসম্মেলনে। নিউ ইয়র্কের ‘ব্রিক লেন’ জ্যাকসন হাইটস দেখালেন তিনি, বাঁশপাতারি ইলিশ ও বেলে মাছ সহযোগে ডাল-ভাত খাওয়ালেন।
সবশেষে ঠিকানা পরিবারের সদস্যদের কথা বলতেই হয়। এর পরিবারের প্রধান সাইদুর রবের নেতৃত্বে ফজলুর রহমান, দেওয়ান শামসুল আরেফিন, মঞ্জুর হোসেন, মিজানুর রহমান প্রমুখরা যেমন কঠোর পরিশ্রম ও গঠনমূলক কল্পনাশক্তি দিয়ে এমন মনোজ্ঞ মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেটা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কোনো সন্দেহ নেই, তাদের ভবিষ্যৎ আয়োজনগুলোও সমানেই সার্থক হবে।
লন্ডন, ০৩.০৭.১২
serajurrahman34@gmail.com
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বছর যাওয়া হয়নি। একটা কারণ অবশ্যই ছিলÑ জর্জ ডব্লিউ বুশের আট বছরের শাসন। একঝুড়ি মিথ্যা কারণ দেখিয়ে তিনি ও তার আজ্ঞাবহ বন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। বারো-তেরো লাখ মানুষ নিহত হয়েছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত আর স্থিতিশীল দেশটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর জীবনযাত্রার সঙ্কট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি স্থির করেছিলাম, বুশ যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন আমি সে দেশে যাবো না। তারপর অবশ্য আরো বহু কারণ অন্তরায় ঘটিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানা নিয়মিত আমার কলাম ছাপে। বিদেশে আজকাল বহু বাংলা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। সেটা বাংলাভাষীদের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তির একটা বড় অবদান। ঠিকানা তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। এ পত্রিকার বয়স ২৩ বছর পেরোল এবং নিয়মিত পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০।
সাপ্তাহিক ঠিকানার কর্তৃপক্ষ (তারা বলেন ঠিকানা পরিবার) এবার নিয়ে পরপর তিনবার উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশীদের মহাসম্মেলন উদ্যাপন করলেন। তাদের আমন্ত্রণে স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক ঘুরে এলাম। কর্তৃপক্ষ মহাসম্মেলনের নাম দিয়েছে এবিসি (আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা) কনভেনশন। সঠিক কত লাখ কিংবা কোটি হবে বলতে পারব না, তবে উত্তর আমেরিকায় এখন বহু বাঙালির অধিবাস। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বাংলাদেশী অভিবাসীর সাথে তাদের অনেক তফাৎ। বাংলাদেশীরা ইউরোপে প্রথম এসেছিলেন অর্থনৈতিক ভাগ্য ফেরানোর আশায়। অন্য দিকে সাধারণত উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাজীবীরাই উত্তর আমেরিকায় এসেছেন।
অনেকে এসেছিলেন প্রযুক্তি-প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং মানবিকবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাসমাপন করে অনেকেই দেখলেন, তাদের শিক্ষা ও যোগ্যতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করার আয়োজন দেশের নেতারা এখনো করে উঠতে পারেননি। একই সাথে উত্তর আমেরিকায় খুবই সহজে এবং উঁচু বেতনে চাকরি পেতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এই মহাদেশের দেশগুলো উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নতিকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আরো বহু দক্ষ ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন। বহিরাগত ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা পেয়ে সে চাহিদা পূরণ করেন।
প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দশ-বারো হাজার মাইল দূরে থাকেন বলেই বোধ করি স্বদেশকে তারা এমন গভীরভাবে ভালোবাসেন। দেশের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে, দেশবাসীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এবং দেশের উন্নতি-প্রগতির পন্থা নিয়ে ভাব-বিনিময়ে তাদের আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশাল-বিস্তীর্ণ দু’টি দেশ। কেউ কেউ দুই কিংবা তিন হাজার মাইল দূর থেকেও স্বদেশীদের সভা-সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। সৌভাগ্যবশত আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে তারা ভোগেন না। এবিসি কনভেনশনের মতো মহাসম্মেলনগুলো সে কারণেই খুবই জনপ্রিয় এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর আমেরিকায় ফোবানা (ফেডারেশন অব বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) নামে আরো একটা সংস্থা আগে এ জাতীয় সভা-সম্মেলন করত। বেশ কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে তাদের একটা মহাসম্মেলনে যোগদানের সুযোগ আমারও হয়েছিল। কিন্তু ফোবানা এখন বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নির্জীব হয়ে পড়েছে। শুনেছি বাঙালিদের স্বভাবজাত পরশ্রীকাতরতা এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে অর্থহীন দলাদলি এর কারণ। এবিসি মহাসম্মেলনে উপস্থিত দু-একজন বলছিলেন, এ সম্মেলন ফোবানার শূন্যতা অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছে।
এবিসি সম্মেলন সম্বন্ধে প্রথমেই বলতে হয় তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। এই সুদূর থেকে প্রকাশিত একখানি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পূর্ণ নিজেদের আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য দিয়ে এত বড় একটা আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন করলেন সেটাই এক বিস্ময়। তাও শুধু একবার নয়। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আগের দুটো বার্ষিক সম্মেলনও সমানেই সফল হয়েছিল।
বিদেশে ভালো আয়-উপার্জন এবং উন্নত জীবন সত্ত্বেও পেছনে ফেলে আসা মাতৃভূমির সমস্যাগুলোর সমাধান করে বাংলাদেশটাকে সুদিনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে তাদের চিন্তাভাবনার কতখানি জুড়ে আছে, সম্মেলনের সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচনে সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু’, ‘আউট সোর্সিং : বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের উন্নয়ন পরিকল্পনা’, ‘পানি আগ্রাসন : ভাটি অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ে কতটা হুমকি’; ‘করপোরেট আমেরিকায় ভাগ্য গড়–ন : মেধার আর অপচয় নয়’; ‘দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা : স্বাধীন না পরাধীন’; ‘বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোথায়?’ এবং ‘বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন বাংলা ভাষার জন্য কতটুকু হুমকি?’; ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি কি না’; ‘বাংলাদেশে কোন তন্ত্র বিদ্যমানÑ গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র না পরিবারতন্ত্র?’ ইত্যাদি।
সেমিনার এবং টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচন থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা-সঙ্কটগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের চিন্তাভাবনার অনেকখানি জুড়ে আছে। এসব আলোচনায় অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখেছেন প্রবাসী ও আমন্ত্রিত চিন্তাবিদরা। প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. খলিলুর রহমান. ড. আলী রিয়াজ প্রমুখ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান অধ্যাপকরা। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কলামিস্ট ফরহাদ মজহার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। লন্ডন থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান, বিবিসি বাংলা বিভাগের বর্তমান প্রধান সাবির মোস্তাফা ও আমি (সিরাজুর রহমান)।
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আসবেন বলে বিশেষ প্রচার চালানো হয়েছিল। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হবে মনে করে আমিও প্রীত ছিলাম। তিনি আসবেন বলে সম্মতি দিলেও মাত্র দুই দিন আগে কোনো অজ্ঞাত কারণে আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। মহাসম্মেলনে কানাঘুষা শুনলাম, আমাদের কারো কারো উপস্থিতির প্রতিবাদে উত্তর আমেরিকার আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা এ সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। বুড়ি-ছুঁই গোছের মতো করে নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন এবং একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আলোচনা ইত্যাদিতে আওয়ামী লীগপন্থী আর যাদের অংশগ্রহণের কথা ছিল, তারা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। অবশ্য তাই বলে সম্মেলনের অঙ্গহানি হয়নি। দুই দিনে দীর্ঘ অধিবেশনের প্রায় সময়ই বিশাল সম্মেলনকেন্দ্রে প্রচুর জনসমাগম দেখেছি।
শূদ্রদের দেববাক্য শোনা নিষিদ্ধ
আপনারা কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানি না, আওয়ামী লীগের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সমর্থকদের ভিন্ন মতবাদ শোনা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার ধর্মগ্রন্থগুলো সীমিত রেখেছিল। সেসব গ্রন্থের বক্তব্য, এমনকি সংস্কৃত ভাষা শোনাও অব্রাহ্মণ্যদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বিধান দিয়েছিলেন, কোনো অব্রাহ্মণ দেব-ভাষা সংস্কৃত শুনে ফেললে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিতে হবে। বোধ করি ব্রাহ্মণরা ভেবেছিলেন, অব্রাহ্মণরা সংস্কৃত শিখে ফেললে তাদের বহু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারাও নিশ্চয়ই মনে করেন, ভিন্ন মতামতের ছোঁয়াচ লাগলে তাদের সমর্থকরা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ভিন্ন মতবাদের কাউকে তাদের ধারে-কাছেও ভিড়তে দেয় না। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ রীতি নিন্দনীয় হবে।
এতক্ষণ যা বলছিলাম তার থেকে মনে হতে পারে যে, নিরস-নিকষ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নিউ ইয়র্কের এবিসি মহাসম্মেলন। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। উভয় দিনের অনুষ্ঠানই শেষ হয়েছে নৃত্য ও সঙ্গীতের দীর্ঘ আসর দিয়ে। তা ছাড়া কয়েকটা আলোচনা অনুষ্ঠানের পরপরই আরো ছোট আকারে গান-বাজনা ও সঙ্গীত দিয়ে দর্শকদের বিনোদন করা হয়। বাংলাদেশের শিল্পী শবনম মুশতারী ও বেবী নাজনীনরা উত্তর আমেরিকা নিবাসী শিল্পীদের সাথে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন। উদ্যোক্তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুষ্ঠানগুলোকে সবিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলেন। ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কলকাতা থেকে আগত আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা মনোজ্ঞ আবৃত্তি দিয়ে সকলকে সম্মোহিত করেন। প্রবাসীদের লিখিত গ্রন্থের একটা প্রদর্শনীও ছিল মহাসম্মেলনে।
বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এবং ক্রীড়া সম্বন্ধেও একাধিক আলোচনা বৈঠক হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক বদহজমের ভয়ে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। উদ্যোক্তাদের একটা মহতী আয়োজন ছিল উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন পেশায় অসাধারণ প্রতিভা ও কৃতিত্বের অধিকারী বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান। কয়েকজনকে ক্রেস্ট দিতে পেরে আমি সম্মানীত বোধ করেছি।
মহাসম্মেলনের অলিখিত এবং অনুচ্চারিত বিরাট লাভজনক দিক ছিল পুরনো ও নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতা ও মতামত বিনিময়। আমি নিজেও ইকবাল বাহার চৌধুরী, কাফি খান, দিলারা হাসেম, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, সরকার কবীরুদ্দিন প্রমুখ সহবেতারকর্মী বন্ধুদের সাথে দীর্ঘকাল পরে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে প্রীত হয়েছিলাম। রাষ্ট্রদূত রফিক আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর সাথেও দেখা হলো বহু বছর পরে। সত্তরের দশকের বিবিসি শ্রোতাসঙ্ঘের কর্মকর্তা আকবর হায়দার কিরণের সাক্ষাৎ পেলাম মহাসম্মেলনে। নিউ ইয়র্কের ‘ব্রিক লেন’ জ্যাকসন হাইটস দেখালেন তিনি, বাঁশপাতারি ইলিশ ও বেলে মাছ সহযোগে ডাল-ভাত খাওয়ালেন।
সবশেষে ঠিকানা পরিবারের সদস্যদের কথা বলতেই হয়। এর পরিবারের প্রধান সাইদুর রবের নেতৃত্বে ফজলুর রহমান, দেওয়ান শামসুল আরেফিন, মঞ্জুর হোসেন, মিজানুর রহমান প্রমুখরা যেমন কঠোর পরিশ্রম ও গঠনমূলক কল্পনাশক্তি দিয়ে এমন মনোজ্ঞ মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেটা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কোনো সন্দেহ নেই, তাদের ভবিষ্যৎ আয়োজনগুলোও সমানেই সার্থক হবে।
লন্ডন, ০৩.০৭.১২
serajurrahman34@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন