শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

গণতন্ত্রের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত করার সরকারি চেষ্টা


গণতন্ত্রের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত করার সরকারি চেষ্টা ॥ সিরাজুর রহমান ॥

স্কুলে আমাদের সিনিয়র অঙ্ক শিক্ষক সুধীন ভট্টাচার্য্য ভীষণ রসিক লোক ছিলেন। পাটীগণিতের মতো নীরস বিষয়ের ক্লাসেও তিনি মুহূর্তে হাস্যমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন। সেই দিন তিনি ‘রুল অব থ্রি’ নামে পাটীগণিতের একটি বিধি শেখাচ্ছিলেন আমাদের। তিনটি করে অঙ্ক ক্লাসেই করতে বললেন। একটা ছেলে বাঁ হাত দিয়ে চোখ কচলাচ্ছিল। সুধীন বাবু ওকে জিজ্ঞেস করলেন অঙ্কগুলো পেরেছে কি না? ছেলেটি জবাব দিলো সে এক চোখ বন্ধ করে দুটো অঙ্ক করেছে। শিক্ষক চট করে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এক চোখ বন্ধ করে দুটো অঙ্ক করেছিস তুই, দুই চোখ বন্ধ করে চারটা করতে পারতিস? গোটা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠেছিল।
আরেকটি ছেলে অঙ্ক কষে বের করেছিল পটোলের সের ছয় আনা হবে। স্যার তাকে বললেন- আচ্ছা, পটোলের সের যদি ছয় আনা হয় তাহলে যে তুলেছে তার বাবার নাম কী? কলকাতায় তখনকার প্রচলিত বাংলায় ‘পটোল তোলার’ অর্থ ছিল অক্কা পাওয়া বা মারা যাওয়া। সুতরাং আমরা সবাই এই অ-সম্পর্কিত রসিকতায় হেসে উঠেছিলাম। বিশেষ করে এ কাহিনীটার অবতারণা করলাম বাংলাদেশের কিছু ঘটনার প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশের জন্য বর্তমান পরিসি'তি খুবই ট্র্যাজিক না হলে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহু উক্তি স্কুলের অঙ্কের ক্লাসের মতো হাস্যরোল সৃষ্টি করতে পারত। আগেও কোনো কোনো লেখক লিখেছেন, বাংলাদেশে সকালবেলার সূর্য ওঠে পুবের আকাশে কিন' নতুন চাঁদ যে পশ্চিম আকাশে ওঠে শেখ হাসিনা সম্ভবত সে জন্যও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে (জনসাধারণ তিনবার যাকে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী করেছিল এবং বর্তমানেও যিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন বলে জাতি আশা করে) দায়ী করেন। দেশে আইনশৃঙ্খলা নেই, ন্যায়বিচার নেই, জানমালের কিংবা নারীর মর্যাদার নিরাপত্তা নেই। মাত্র গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনার ফলে র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যা কমলেও বাংলাদেশে মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। দায়িত্ব স্বীকার করে সেসব দুষ্কৃতির প্রতিবিধানের পরিবর্তে কথায় কথায় এবং কারণে-অকারণে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেবেন, বিনা মূল্যে সার দেবেন কৃষককে, রাতারাতি বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করবেন, আরো কত কী? কোন প্রতিশ্রুতিটা পালন করতে পেরেছেন তিনি? মানুষ অসন'ষ্ট। খুবই ক্রুদ্ধ। শেখ হাসিনার সরকার কিছুই দিতে পারছে না তাদের। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী প্রাণ খুলে সব কিছু দিয়ে দিচ্ছেন ভারতকে। ভারত একে-দুয়ে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের সব নদীর পানি আটকে দিচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী করজোড়ে বলছেন, ‘দেবো প্রভু, আরো দেবো, যতো চান ততো দেবো’। ভারত আমাদের সড়ক চায়, রেলপথ চায়, নদী চায়, বন্দর চায়। দিল্লিকে সব কিছু দিয়ে কৃতার্থ বোধ করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পর আমাদের ভূগোলকেও তারা নিয়ে নিতে চায়। আমাদের দেশের ভেতরে এসে তারা আমাদের নদীতে, শাখানদী আর খালগুলোতেও বাঁধ দিচ্ছে।

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা আর চাই না
বাংলাদেশের মানুষ তিন বছরে অনেক কিছু সয়েছে। যুদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীনতার ওপর অন্য দেশের পোদ্দারি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো সর্বক্ষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে তাদের। তারা এখন আর নীরব থাকবে না। তারা প্রতিবাদ করছে, হরতাল করছে। তারা বলছে, তারা গণতন্ত্র চায়, তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি চায়। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যত দোষ খালেদা জিয়ার। খেটেখাওয়া মানুষ যৎসামান্য সঞ্চয়, বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া গয়না আর গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে আনা টাকা শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছে। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারের সমর্থক আর সরকারের পৃষ্ঠপোষক দুষ্ট লোকেরা সাধারণ মানুষের সে লগ্নির টাকা লুটেপুটে খেয়েছে। গত তিন বছরে আবারো হরির লুট চলেছে শেয়ারবাজারে।
মধ্যবিত্তের লাখ লাখ কোটি টাকা তারা লুট করেছে, সে টাকায় ডলার কিনে বিদেশে পাচার করেছে। কিন' একটাও মুদ্রাপাচারের মামলা হয়েছে কী কারো বিরুদ্ধে? হয়নি। হয়নি, কেননা এরা খালেদা জিয়ার পুত্র নয়, শেখ হাসিনার বরপুত্র। ৩২ লাখ পরিবার শেয়ারবাজারে সর্বস্ব খুঁইয়ে পথে বসেছে, তাদের পোষ্য দেড় থেকে দুই কোটি নরনারী ও শিশু সর্বস্বান্ত হয়েছে। মানুষ ক্রুদ্ধ। এমন সাঙ্ঘাতিক অবিচারে হয়তো পাগলও হয়ে গেছে কেউ কেউ। তারা প্রতিবাদ করছে, হরতাল করছে, রাজপথ অবরোধ করছে। শেখ হাসিনার মনে পড়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা : ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। সে রকম করেই শেখ হাসিনা বলছেন, সব কিছুর জন্য খালেদা জিয়াই দায়ী।
ধরা পড়ার ভয়ে চোর নিজেই ‘চোর চোর’ বলে ছুট দেয়। এ দৃশ্যের সাথে আমাদের অনেকেরই পরিচয় আছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের হয়েছে সে দশা। মানুষ ক্রুদ্ধ, অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, সর্বোপরি অপমানিত। এ অবস'া চলতে দিলে তাদের সংযমের বাঁধ ভেঙে যেতে বাধ্য। সরকারি মহলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এরা খালেদা জিয়ার দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। নাগাল পাচ্ছে না বলে পাশের দেশ থেকে আঁকশি ধার করে আনছে। কলকাতার পত্রিকা ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করছে। সে ধুন তুলে ঢাকার সরকার আবারো গান জুড়ে দিয়েছে। সব কিছুর জন্যই খালেদা জিয়া দায়ী। ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। এ দিকে বাংলাদেশের শহর-নগর আর পথে-ঘাটে কী হচ্ছে? সরকারি দলের সোনার ছেলেরা খুন-খারাপি, ছিনতাই-রাহাজানি, নারী ধর্ষণ ও সম্পত্তি গ্রাস করছে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সিট-বাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য ও হত্যা চালাচ্ছে নির্বিবাদে। তাদের নৈরাজ্য আর খুন-খারাপির দায়িত্ব শেখ হাসিনা বহন করতে রাজি নন, ভান করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও তার বরপুত্ররা ধোয়া তুলসিপাতা।

সাত দফা চুক্তি কি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে?
উনিশ শ’ একাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের কাছে বন্ধীত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, বিডিআরের বীর জওয়ানেরা আর দলত্যাগী সৈন্যরা নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশের সাধারণ মানুষ সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে তাদের। সে জন্য বহু নির্যাতন সয়েছে তারাও, বাংলাদেশের নারী তার আত্ম মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছেন।
কলকাতার হোটেলে-গেস্ট হাউজে প্রমোদ আর বিলাসে কাটিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা ভারত সরকারের ব্যয়ে। তাদের আশ্রয় আর ভরণ-পোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দানের বিনিময়ে ভারত সরকার যা যা দাবি করেছিল সব কিছু মেনে নেয়া ছাড়া দেশ থেকে পলাতক এসব আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতার গত্যন্তর ছিল না। দিল্লির সাথে এরা সাত দফা চুক্তি করেছিলেন। চুক্তিতে তারা মেনে নিয়েছিলেন যে স্বাধীন হলে বাংলাদেশের স্বাধীন কোনো পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না, নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না বাংলাদেশের এবং বিডিআরকে ভেঙে দিতে হবে। তাজউদ্দীনের সরকার সেসব দাবি মেনে নিলেও ভারতের এসব অন্যায় শর্ত মেনে নেয়া শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সেসব দাবি মানবে না। কিন' প্রমাণ হয়ে গেছে শেখ মুজিব আর শেখের কন্যা হাসিনার সম্মান ও মর্যাদাবোধ এক মাপের নয়।
শেখ হাসিনা এ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। এখন আর কারোই অজানা নয় যে ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শে‘ এক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে জিতেছিল। তারপরই শুরু হয়েছে ভারতকে মূল্যদান। সেটি অবশ্যি প্রত্যাশিত ছিল। কিছু পেতে হলে কিছু দিতেই হয়। শেখ মুজিব যে সাত দফা চুক্তি নাকচ করে দিয়েছিলেন সে চুক্তি আবার বহাল করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীত্বের মূল্য হিসেবে।
এ সরকারের দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ ঘটে। প্রায় তিন বছর গড়িয়ে গেলেও সব ঘটনা সাধারণ মানুষেরও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ক’দিন আগে থেকেই বিডিআরের কোনো কোনো সদস্যের সাথে মুঠোফোনে প্রচুর আলাপচারিতা করছিলেন বলে তখনো বলাবলি হচ্ছিল, মিডিয়ার কোনো কোনো অংশেও সেসব কথা প্রচারিত হয়েছে। একপ্রস' হত্যালীলার পর ঘাতকেরা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলাপ করেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের ‘সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেন’। বর্ণাঢ্য নামের সব মানুষ তারপরও বিডিআর সদর দফতরে যান এবং তারপর চলে আরো এক দফা হত্যাকাণ্ড। সন্ধ্যায় বিডিআরে হাওয়া খেতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এবং তখনকার খবর অনুযায়ী তার উপসি'তিতে আরো একবার গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছিল বিদ্রোহ দমন করতে, কিন' তাদের মাঝপথে থামিয়ে দেয়া হয়। বিদ্রোহের পরে পরে বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান যেসব আজেবাজে ও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেছিলেন সে প্রসঙ্গ না হয় না-ই তুললাম।

আসল রহস্য উদঘাটন করতে হবে
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হয়নি। লোকদেখানো বিচারের নামে শুধু শত শত জওয়ানকে নানা মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের গৃহপালিত মিডিয়া এবং কলম সন্ত্রাসীরা ছাড়া অন্যেরা বহুবার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্ত করে পালের গোদাদের খুঁজে বের করার দাবি জানান। আমি নিজেও একাধিক কলামে সুস্পষ্ট ভাষায় সে দাবি করেছি। কিন' ঘটনার পেছনের ঘটনা ও ষড়যন্ত্র আবিষ্কার এবং পালের গোদাদের মুখোশ খুলে দেয়ার কোনো চেষ্টাই হয়নি।
বিডিআর বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস' ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন। তার পর থেকে সেনাবাহিনী যেন যবনিকার অন্তরালে চলে গেছে, কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানেও দেশবাসী তাদের সেনাবাহিনীকে দেখতে পায়নি। শুধু টের পাওয়া যাচ্ছে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে জাতিসঙ্ঘের কাছে ভাড়া দিয়ে কিছু বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা হচ্ছে। দিল্লির অভিপ্রায় অনুযায়ী বিডিআরকে ভেঙে দেয়া হয়েছে। তার পরিণতি কী হয়েছে সবাই তা দেখতে পারছে। মাঝে মধ্যেই ভারতীয়রা বাংলাদেশের জমি দখল করে নিচ্ছে। সীমান্তে হরহামেশা বাংলাদেশী খুন হচ্ছে। ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে সেসব ‘ছোটখাটো ঘটনা’, সে দিকে সরকারের গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব লোপ করে দিয়ে কি সাত দফা চুক্তির আরো একটি দফা পালন করা হবে?
আবারো ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। সরকার বিডিআর বিদ্রোহের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করেনি। হঠাৎ করে আবার সে বিদ্রোহের জন্য খালেদা জিয়ার ঘাড়ে দায় চাপানোর কথা মনে হয়েছে কোনো কোনো সরকারি মহলের। এ দিকে আবার অভিযোগ উঠেছে যে সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর দিক থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে শুধু অভিযোগই করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযোগ ও তদন্ত মানেই যে অপরাধের প্রমাণ নয়- এ কথাটা কেউ বোধ হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের শেখায়নি অথবা আজ্ঞাবহ আদালতে অভিপ্রায় অনুযায়ী রায় পেয়ে পেয়ে তাদের বদ অভ্যেস হয়ে গেছে, নিজেদের অভিযোগকে তারা প্রমাণিত অপরাধের সমার্থক বিবেচনা করছে।
এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী তো কোনো রকম তদন্তের আগেই খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে বসেছেন! খালেদা জিয়া সম্পর্কে শেখ হাসিনার গাত্রদাহের কারণ বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার আপসবিহীন সংগ্রামের সময় থেকে বাংলাদেশের মানুষ তাকে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক রূপে গ্রহণ করেছে, গণতন্ত্র বিপন্ন বোধ করলেই তারা তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। অন্য দিকে শেখ হাসিনার পরিকল্পনা হচ্ছে বাকশালী অথবা অন্য কোনো ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে চিরকালের জন্য গদি আঁকড়ে রাখা। তার এই অশুভ পরিকল্পনার প্রধান বাধা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব। বহু সাজানো মামলায় খালেদা জিয়া ও তার ছেলেদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা। সেটি সম্ভব না হলে জনতার চোখে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মিথ্যা অভিযোগের তো অবধি নেই।
দুর্ভাগ্যবশত দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে যতটা শক্তিশালী সমর্থন দিয়েছে, বিএনপির মন্ত্রিত্ব ও নেতৃত্ব-লিপ্সু নেতাদের কেউ কেউ তেমন আন্তরিক সমর্থন ও সুপরামর্শ তাকে দিচ্ছেন বলে মনে হয় না। তারা যে বেঁচে আছেন হয়তো সেটা প্রমাণ করার জন্যই মাঝে মধ্যে তারা বক্তৃতা করেন কিংবা বিবৃতি দেন। আমার প্রায়ই মনে হয় এরা কৌতুক গানের লিরিকের “রাঁধিব বাড়িব ব্যঞ্জন কুটিব, হাঁড়ি তবু ছোঁ’বনা” গোছের নেতা। তারা মাঠে নামবেন না, সংগঠনের কাজ করবেন না। আমার মনে হয় তাদের সবাই সুপরামর্শও দিচ্ছেন না নেত্রীকে।

অহেতুক বিতর্ক শক্তি ক্ষয় করছে
বর্তমান গণতন্ত্রের আন্দোলনে খালেদা জিয়া সুপরামর্শ পাচ্ছেন বলে আপনাদের মনে হয় কি? সংবিধান থেকে ইসলামকে বর্জন এবং একতরফা সংবিধান সংশোধন করে যেই দিন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাদ দেয়া হয় বাংলাদেশের মানুষ সেই দিনই বুঝে গেছে এ সরকারের মতলব শুভ কিংবা সাধু নয়। তারা পাশের দেশের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করে ‘উগ্র সেকুলারিজম’ চালু করতে চায়। সে মূল্যে ভারতের সমর্থনে গদি পোক্ত করতে চায়।
খালেদা জিয়ার আন্দোলন যখন সাফল্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, তখন বিএনপির কোনো কোনো মহল থেকে ‘সাংবিধানিক আন্দোলনের‘ কথা উঠছে। কোন সংবিধানের কথা বলছে তারা? যে সংবিধান নিয়ে শেখ হাসিনা ময়দার কাইয়ের দলার মতো খেলা করছেন সে সংবিধানের? মতলবি মহল গুজব ছড়াচ্ছে, ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের সাথে নাকি বিএনপির বোঝাপড়া হয়ে গেছে, সমঝোতা হবে শিগগির। কিন' কিসের বোঝাপড়া? কিসের সমঝোতা? সরকার কি তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়েছে? অথবা রাজি হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে? দিলেই বা তাদের আশ্বাসের মূল্য কী?
বর্তমান গণতন্ত্রের আন্দোলন দুই থেকে তিন মাস আগেই তুঙ্গে উঠেছে। নেতাদের মধ্যে দ্বিমত থাকতে পারে কিন' সাধারণ মানুষ বুঝে ফেলেছে ঠেলে না ফেললে এ সরকার গদি ছাড়বে না। দলীয়কৃত পুলিশ, প্রশাসন আর বিচারব্যবস'া তাদের হাতে। সেসব ব্যবহার করে তারা গদি আঁকড়ে থাকতে চাইবে, প্রয়োজন হলে দলীয় সরকারের অধীনে আবারো মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচন করে। আরো বস্তা বস্তা টাকা আর চানক্যদের পরামর্শ আসবে পাশের দেশ থেকে। এ অবস'ায় ‘কুইক, কুইক, শ্লো’ আন্দোলনের কৌশল হতে পারে না। আম পাকলে পেড়ে নিতে হবে, নইলে পচে যাবে কিংবা কাকে খাবে। লোহা তপ্ত থাকতে হাতুড়ির ঘা দিতে হয়, নইলে অযথা পরিশ্রমই সার হবে। এসব সাধারণ বুদ্ধির কথা বিএনপির নেতারা কী বোঝেন না? নেতৃত্বের ভেতরে যদি কুচক্রি কিংবা মীরজাফরের বংশধরদের কেউ থেকে থাকেন তাহলে কঠোর ব্যবস'া নিতে হবে তাদের বিরুদ্ধে। নইলে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ সেটি আশা করে না।
(লন্ডন, ২৪.০১.১২)
serajurrahman@btinternet.com

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়

বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা বানচাল করা হয়েছে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কথা বলেছি প্রথিতযশা বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সিরাজুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হল।
রেডিও তেহরান : জনাব সিরাজুর রহমান, বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা বানচাল করে দেয়া হয়েছে বলে আজ (বৃহস্পতিবার) সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেনা অভ্যুত্থান অত্যন্ত কঠিন কাজ। তারপর বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশে তো শক্তিশালী কোন দেশের মদদ ছাড়া সেনা অভ্যুত্থান অসম্ভব বলেই মনে করা হয়। তো বাংলাদেশ সেনবাহিনীর পক্ষ থেকে আজ যা বলা হলো, সে সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন ?
সিরাজুর রহমান : দেখুন, সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে প্রকৃত কি ঘটেছে সেটা আমি জানি না। তবে আমি আপনাদের এর পটভূমি সম্পর্কে কিছু বলতে পারি।
এ বিষয়ে কতগুলো জিনিস মনে রাখা দরকার। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী -পাকিস্তান, ভারত কিংবা অন্য দেশের সেনাবাহিনীর মত নয়। পাকিস্তানে এবং ভারতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাধারণতঃ একটা মার্শাল রেস থেকে আসে; বিশেষ গোষ্ঠী থেকে আসে । আর সেটা তাদের সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য। আর সেজন্য ঐসব দেশের সেনাবাহিনী তাদের দেশের অভ্যন্তরে কি ঘটছে তা থেকে পৃথক থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন মার্শাল রেস নেই, সাধারণ পরিবারের ছেলেরা বা তাদের ভাইয়েরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। যেহেতু তারা দেশের সাধারণ পরিবার থেকে সেনাবাহিনীতে আসে ফলে তাদের সাথে সারা দেশের সঙ্গে এবং প্রতিটি সমাজের সঙ্গে খুবই গভীর বা ওতপ্রোত যোগাযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাবনার সাথে সেনাবাহিনীর ভাবনার কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ মোটামুটি মনে করা যেতে পারে দেশের মানুষ যা ভাবছে সেনাবাহিনীও তাই ভাবছে। মোটামুটিভাবে এই হচ্ছে প্রাথমিক পটভূমি।
দেখুন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে নানারকম তোলপাড় হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন ধরুন- রক্ষীবাহিনী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল মস্ত বিরোধ । পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনীর যারা ফিরে এসেছিলেন তাদের সাথে মুক্তিবাহিনী থেকে আসা সেনা সদস্যদের বিরোধ হয়েছে । ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশের সেনবাহিনীতে একটি মহল গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই -আর সেটি হচ্ছে , ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন সরকার ভারত সরকারের সাথে ৭ দফা চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তিতে ছিল - বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না; বাংলাদেশের নিজস্ব কোন পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না । ভারত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তখন থেকেই ভারত বলাবলি করে আসছে। তারা তখন থেকেই বলছিল-সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে তুলে দেয়া হবে এবং সীমান্ত রক্ষার জন্য বিএসএফের পরামর্শে একটি সীমান্ত রক্ষাবাহিনী গড়ে তোলা হবে।
এছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটল। আর এই বিডিআর বিদ্রোহের ফলে এক ঢিলে অনেক পাখি পড়ে গেল। এতে বিডিআর পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। বিডিআরের মধ্যে যারা খুবই অ্যাকটিভ কর্মকর্তা ছিলেন বা নন কমিশন্‌ড অনেক অফিসার ছিলেন তাদের মধ্য থেকে অনেকেই ঐ বিদ্রোহের সময় মারা গেলেন । ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে মেজর জেনারেল পর্যন্ত ৫৭ জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা মারা গেলেন ঐ বিদ্রোহে। এই ঘটনার পর আপনারা দেখেছেন কীভাবে বিডিআরকে ধ্বংস করে বিজিবি করা হল। আর এই বিডিআর ধ্বংস করে বিজিবি করার ঘটনায় বাংলাদেশের বহু মানুষ অসন্তুষ্ট। কারণ, আপনারা নিশ্চয়ই দেখছেন যে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এখন কথায় কথায় এবং কোন কারণ ছাড়াই বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করছে, বাংলাদেশিদের জায়গা জমি দখল করে নিচ্ছে। বিডিআর থাকা অবস্থায়- বিডিআরের অনেক যোগ্য অফিসার ও সদস্য ছিল যাদের কারণে তখন এতোটা ঘটেনি। তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন বহুবার।
আমি আগের ঐ কথার প্রসঙ্গে আবার যাবো- ভারত যে কথা বলেছিল যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী রাখার কোন দরকার নেই। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সেকথা মানেননি । আর আজকের প্রেক্ষাপটে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের সেই সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় থেকে সে বিষয়টি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এখানে আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- মর্মান্তিকভাবে সেনাবাহিনীর যে ৫৭ জন দক্ষ অফিসারকে মেরে ফেলা হলো - সেই ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তার জায়গায় কাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে?  তারা কোন মতাবলম্বী সে বিষয়টি দেশের সাধারণ মানুষ জানে না। আমি এ সম্পর্কে যা শুনেছি -সেটা হচ্ছে সেনাবাহিনীর যে ৫৭ কর্মকর্তার পদ খালি হয়েছিল সেখানে আওয়ামী লীগ এবং ভারতপন্থীদের দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা হয়েছে। তবে ঠিক সবগুলো হয়েছে কিনা তা জানি না। একই সাথে বিজিবিকে যেন পর্দার মধ্যে রাখা হয় সে ব্যবস্থাও কিন্তু করা হল। এভাবে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেল অলক্ষ্যে।
আপনারা একটা জিনিস লক্ষ্য করে থাকবেন - সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বিডিআর কুচকাওয়াজ করেছে। আর বিডিআরের এই কুচকাওয়াজ যে শুধু রং তামাশা তা কিন্তু নয়। এটা দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির একটা অন্যতম উপায় ।
কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের সময় থেকে বর্তমান সরকারের আমলে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে এখন দুর্বল অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে এখন বিদেশে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষীবাহিনীর নামে একটি ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে এমন বহু দেশপ্রেমিক সদস্য রয়েছেন - যারা মনে করেন- জাতীয় জীবনে সেনাবাহিনীর একটি পূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত। যে ভূমিকাটা তারা রাখতে পারছেন না। আর সে কারণে সেনবাহিনীর মধ্যে বহু সদস্য অশান্ত এবং ক্ষুব্ধ। সেনাবাহিনীর বহু সদস্য দেশে গণতন্ত্রের জন্য- স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও বহু মানুষ একই কারণে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ যারা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আছে বা বাইরের সাধারণ মানুষ -সকলেই গণতন্ত্রকামী একথা সবাই স্বীকার করে। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র দমনের জন্য, একটি একদলীয় বাকশালীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বর্তমানে আবার যে চেষ্টা চালানো হচ্ছে -এসব বিষয় সেনাবাহিনীর লোকেরা যে জানেন না -সে কথা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ, সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছুটিতে বাড়িতে যায়, সেখানে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা কথা শোনেন, তারা পত্রপত্রিকা বা মিডিয়া থেকে জানতে পারেন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে ।
কাজেই বাংলাদেশের গোটা সমাজব্যবস্থায় যে একটা টালমাতাল ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে সে ব্যাপারে সেনাবাহিনী পুরোপুরি সজাগ রয়েছে- একথা আমরা বলতে পারি।
তাছাড়া ভারত যে কথা বলেছিল যে বাংলাদেশের কোন সেনাবাহিনী থাকবে না- এবং তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অনেক সেনাকর্মকর্তা বা সেনা সদস্য ভাবতে শুরু করেছেন -তাহলে তাদের অবস্থাটা কি হবে! বর্তমান সরকারের সময়ের নানা কর্মকাণ্ড এবং সেনাবাহিনীর বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি সব মিলিয়ে সেনাবাহিনীর অনেকেই উদ্বিগ্ন। কাজেই সেনাবাহিনীর মধ্যে যে টালমাতাল ভাব এবং বহু অসন্তোষ আছে এটা আমরা ধরে নিতে পারি।
আমি এখানে আরো একটা উদাহরণ তুলে ধরছি। সেটি হচ্ছে, গত সপ্তাহ দুয়েক হবে-সেনাবাহিনীর জনৈক এক মেজরকে ধরে নিয়ে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে সম্ভবতঃ তিনি বেরিয়ে এসেছেন বা আসেননি ঠিক বলতে পারছি না। কারণ আমি ইন্টারনেটে এ ব্যাপারে দেখেছি বহু কথা চালাচালি হচ্ছে। তাছাড়া ইতোমধ্যে একজন সার্ভিং মেজরকে একটি গোয়েন্দা ইউনিট অ্যারেস্ট করে অপর একটি গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে সোপর্দ করেছে। এ ধরনের ব্যাপারগুলো যখন হয় তখন সেটি ভিন্ন বার্তা বহন করে । তাছাড়া আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন - সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে যখন কোন অভ্যুত্থান ঘটে বা কোন বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় -তখন সেটি হয় মেজর থেকে কর্নেল পর্যন্ত কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে। সাধারণ অভ্যুত্থান কিন্তু জেনারেলরা করেন না, ফিল্ড মাশার্লরা করেন না বা সিপাহীরাও করেন না।
তো গত ক'দিনে আমি যে আলামতগুলো দেখেছি এই হচ্ছে তার বাস্তব চিত্র । তবে কেউ অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করছিল কি না বা বিদ্রোহ করার চেষ্টা করছিল কি না- এ ব্যাপারে আমার কাছে কোন সঠিক খবর নেই, আমি কোন সঠিক খবর জানতে পারিনি।

রেডিও তেহরান : আজ (বৃহস্পতিবার) সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক বলেছেন, কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকের ইন্ধনে সেনবাহিনীতে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কতিপয় কর্মকর্তা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইন্ধনের যে কথা বলা হয়েছে, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। এ কারণে, এর সম্ভাব্যতা বা এর বাস্তবতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। তো আপনি কিভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
সিরাজুর রহমান : দেখুন, প্রবাসী বাংলাদেশিরা কাজ করে খান। প্রবাসে গিয়ে তারা হাঁড় খাটুনি খেটে উপার্জন করেন। তারা কেউ বেকার বসে থাকেন না। বাংলাদেশে বহু বেকার মানুষ রয়েছেন, বাংলাদেশের সরকারে, মন্ত্রীসভায় এবং সেনাবাহিনীতে বহু বেকার মানুষ রয়েছেন । আর যারা প্রবাসে থাকেন তাদের পরিশ্রমের অন্ত নেই। তারা কেউ সময় অপচয় করেন না বা বসে থাকেন না । আমি নিজে একজন প্রবাসী, আমাকে সংসারের সব কাজ করতে হয়, একইসাথে লেখালেখি করি, আমার বয়স হয়েছে; আমার পরিবারে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, তারপরও আমাকে কাজ করতে হয়। কাজের বাইরে আমাদের অন্য কোন বিষয় থাকে না। ফলে প্রবাসে থেকে মানুষ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করবে- এ কথার কি যুক্তি থাকতে পারে? তাছাড়া প্রবাসীরা কেন অভ্যুত্থানে অংশ নেবে- এ প্রশ্নটিও কিন্তু ওঠে ! আপনাদের মনে থাকার কথা, ১৯৭৫ সালে যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল তা কি প্রবাসীরা করেছে? ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল সেটি কি প্রবাসীরা করেছিল? তারপর সিপাহীরা ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল- সেটাও কি প্রবাসীরা করেছিল? ৭ ই নভেম্বর সিপাহীরা বিদ্রোহ করে নিজেদেরকে মুক্ত করেছে ; জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছে। তো এখানে প্রাবাসীদের কোন ভূমিকা তো দেখতে পাচ্ছি না। বরং এসব অনেক ক্ষেত্রে যে বিদেশিদের ভূমিকা রয়েছে- একথা বলা যায়। বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বা ঘটেছে- তাতে পাশের দেশের ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা  'র' এর যে ছয় লাখ তিন হাজার এজেন্ট রয়েছে- তারা কী করছে না করছে সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দিন, সেগুলো খুঁজে বের করুন । প্রবাসীরা খেটে খায়, অতি কষ্টের আয় তারা দেশে বাপ মায়ের কাছে পাঠায় - ফলে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর সঙ্গে প্রবাসীদের কোন রকম যোগাযোগ বা সরাসরি কোনো সংযোগ আছে - একথা আমি একদম বিশ্বাস করি না।
রেডিও তেহরান : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক সংবাদ সম্মেলনে আরেকটি কথা বলেছেন। তিনি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদেরকে ধর্মান্ধ বলেছেন। তো এই ধর্মান্ধ শব্দের কি তাৎপর্য থাকতে পারে?
সিরাজুর রহমান : দেখুন বাংলাদেশে আজ যারা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে, যেমন ধরুন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী- তাদেরকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ অপরাধী। বাংলাদেশের মানুষ যারা মাথায় টুপি পরেন বা মুখে দাড়ি রাখেন - তারা যদি রাজনীতির কথা-বার্তা বলেন ,তখন বলা হয় ওরা যুদ্ধ অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আবার যদি ধর্মের কথা বলেন, টুপি পরেন, লুঙ্গি পরেন -তাদেরকে বলা হচ্ছে হিজবুত তাহরীর। এইসব নানা বিষয় ঘটছে ।
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন? বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে নতজানু। সরকার ভারতকে খুশী করার জন্য বলছে তারা ধর্মনিরপেক্ষ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- দেশে ফসল ভাল হয়েছে তার মা দূর্গার কল্যাণে। মা দূর্গা সদয় হয়েছিলেন, তিনি হাতিতে চড়ে এসেছিলেন বলেই বাম্পার ফলন হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন সরকারি উদ্যোগে তোড়জোড় চলছে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার। অন্যদিকে ভারতকে খুশী করার জন্য নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধান থেকে ইসলামকে বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেখেন ভারতের অত্যন্ত উগ্র ধর্মীয় দল হচ্ছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি । যারা আগে ক্ষমতায় ছিল, বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল ; যাদের একটি বড় কম্পোনেন্ট অংশ হচ্ছে শিব সেনা - যারা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। তারা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিলো এই কারণে যে তিনি পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম সকলের মতের প্রাধান্যের কথা বলতেন। কিন্তু শিব সেনাদের সেটি সহ্য হয়নি; ফলে তাকে হত্যা করা হয়। তো ভারতের মত দেশে বিজেপির মতো উগ্র রাজনৈতিক দল রয়েছে, যারা ক্ষমতায় ছিল এবং খুব সম্ভবতঃ আবার তারা আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে। অথচ বাংলাদেশের সরকার দেখুন সেই ভারতকে খুশী করার জন্য বাংলাদেশের অনেককে মৌলবাদী বলছে। অনেককে সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে।
আমেরিকার ৯/১১'র ঘটনায় কোন বাংলাদেশি জড়িত ছিল একথা আমি বিশ্বাস করি না। অথচ আমেরিকার কাছেও ভালো হওয়ার জন্য বলছে আমরা সন্ত্রাস দমন করছি। আসলে সন্ত্রাস দমনের নামে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে।‌ আর সরকার যত বেশী মা দূর্গা দূর্গা করবে, রামকৃষ্ণ মিশন সৃষ্টি করতে চাইবে এবং উগ্র সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করতে চইবে- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তত বেশী ক্ষুব্ধ হবে। কারণ, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু। তাদের ধর্মের ওপর যদি কোন আঘাত আসে তবে তারা কোনমতে সহ্য করবে না। ফলে ধর্মীয় রাজনীতি ধ্বংস করার জন্য যে চেষ্টা চলছে সেটা তো বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বা ধর্মীয় অন্যান্য যে সব দল আছে তাদের বিরুদ্ধেই সব কিছু হচ্ছে। অথচ এইসব ধর্মীয় দলের সবাই কিন্তু গণতন্ত্র চায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটা চান না। শেখ হাসিনা যেভাবে ফ্যাসিস্ট পন্থায় ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করছেন, সেটি বাকশাল হোক বা অন্য কোন নামে হোক -এখানে তিনি সকল গণতন্ত্রপন্থীদের শক্র বলে মনে করেন।
রেডিও তেহরান : জনাব সিরাজুর রহমান, আপনার কথার সূত্র ধরেই আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। বাংলাদেশে আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রশাসনের সব বিভাগে ইসলামপন্থীদের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বহু কর্মকর্তা ওএসডি হয়ে আছেন। ঠিক এ কারণেই সেনাবাহিনীতে যারা ইসলামী জীবন বিধানের প্রতি যত্নবান তাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের অভিযান শুরু হয়ে গেছে। অনেকে 'ধর্মান্ধ ' শব্দটিকে তারই আলোকে ব্যাখ্যা করছেন। আপনি এ বিষয়ে কি মনে করেন ?
সিরাজুর রহমান : আসলেও তো তাই । আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন বাংলাদেশের পুলিশে বা সরকারি চাকুরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে- আর সেটি কখনও ডাবল আবার ট্রিপল প্রমোশন দিয়ে? আর সেই সব জায়গায় অভিজ্ঞ যেসব সংখ্যাগুরু কর্মকর্তা বা কর্মচারী ছিলেন তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর বা  ওসডি করা হয়েছে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে ,বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মনে করে যে, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশে তাদের রক্ষক । আর তাদেরকে তোয়াজ করার জন্য শেখ হাসিনা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বলেন, তার মা দূর্গা।
আমি বলব বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের যেসব অফিসার আছেন তাদের মধ্যে কিছুটা ন্যায়নীতি আছে, তারা ন্যায়পরায়ণ হতে পারেন। তারা ন্যায়পরায়ণ বলেই আওয়ামী লীগ সরকার যেটি বলবেন সেটি তারা করবেন এমনটি নয়। কিন্তু সংখ্যালঘু যারা রয়েছেন - তারা হাসিনার জোরে ডাবল বা ট্রিপল প্রমোশন পেয়ে বড় বড় পদে রয়েছেন- তাদেরকে যে নির্দেশ দেবে সরকার তারা তা মানবে। তাদেরকে যদি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জয়নুল আবদিনকে লাঠিপেটা কর, তাকে ন্যাংটা কর -তাহলে তারা করবে এবং করছে ।
Courtesy: রেডিও তেহরান
শুক্রবার, 20 জানুয়ারী 2012

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

এ দৈত্য আর বোতলে ফিরে যাবে না


২০১১-১০-২৮

তিউনিসিয়ার ৭০ লাখ মানুষ গত ২৩ অক্টোবর খুবই শান্তিপূর্ণ, বলতে গেলে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছে। সেটা খুবই প্রত্যাশিত ছিল। কেননা, ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর এই প্রথম এরা নিজেদের নির্বাচিত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ পেল। এর আগেও তাদের কেউ কেউ ভোট দিয়েছে, কিন' প্রতিবারই ভোট দিতে হয়েছে ক্ষমতাসীন ডিক্টেটরদের।
গত জানুয়ারি মাসে এক গ্র্যাজুয়েট বেকার ফুটপাথে ফল বিক্রি করছিল। পুলিশ বিনা লাইসেন্সে ব্যবসায় করার দায়ে তার ফলগুলো বাজেয়াপ্ত করে। লাইসেন্সের আবেদন নিয়ে সে স'ানীয় মিউনিসিপ্যালিটির আপিসে যায়, কিন' হতাশ হয়ে ফিরে আসে। হতাশা আর অপমানে এবং অভুক্ত পরিবারের কথা মনে করে সে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। এই মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিউনিসিয়ার জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তথাকথিত আরব বসন্তের এই ছিল সূচনা। অল্প কিছু দিনের আন্দোলনের জোয়ারেই প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেনআলি সপরিবারে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। গত রোববারের নির্বাচন ছিল তারই ফল।
আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে গত ২৩ অক্টোবর। লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (এনটিসি) নেতা বিচারপতি মোস্তাফা আবদুল জলিল বেনগাজির এক বিশাল জনসমাবেশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, লিবিয়ার স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষ হয়েছে, লিবীয়রা স্বাধীন হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, লিবিয়া একটি ঐক্যবদ্ধ ও গণতান্ত্রিক জাতিতে পরিণত হবে। লিবিয়া ও মিসরের জনতা তিউনিসিয়ার আন্দোলনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেছিল। মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাতের হত্যার পর প্রেসিডেন্ট হন। অপ্রতিরোধ্য গণ-আন্দোলনের মুখে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বর্তমানে তার ও তার পুত্রদের বিচার চলছে কায়রোর আদালতে।
লিবিয়ার কর্নেল মুয়াম্মার গাদাফি ১৯৬৯ সালে এক অভ্যুত্থানে বাদশাহ ইদ্রিসকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তিউনিসিয়ার অনুপ্রেরণায় গণতন্ত্রের দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু হলে গাদাফি সংস্কারের দাবির জবাবে সশস্ত্র বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে আন্দোলন দমন করার প্রয়াস পান। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ গাদ্দাফির নৃশংসতার নিন্দা করে প্রস্তাব পাস করে। এ প্রস্তাবে কিছু বিশেষত্ব ছিল। সাধারণত পশ্চিমী পক্ষ কোনো প্রস্তাব পাস করতে চাইলে রাশিয়া ও চীন প্রায়ই ভেটো প্রয়োগের হুমকি দেয় অথবা প্রকৃতই ভেটো দিয়ে বসে। কিন' সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে তারা বাধা দেয়নি। এমনকি আরব লিগও প্রস্তাবটি সমর্থন করে।
এ প্রস্তাবের জের ধরেই বেসামরিক লিবীয়দের সংরক্ষণের নামে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমান বাহিনী গাদ্দাফির সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি আক্রমণে অংশ না নিলেও তার ড্রোন পাইলটবিহীন বিমানগুলো গাদ্দাফির বাহিনী সম্বন্ধে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে আক্রমণকারী ব্রিটিশ ও ফরাসি বিমানগুলোকে সাহায্য করে। বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার ড্রোনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ফরাসি বিমান গাদ্দাফির জন্মস'ান সিরতে শহরে এক মোটর কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালায়। গাদ্দাফি ও তার পুত্র সে কনভয়যোগে সিরতে শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কর্নেল গাদ্দাফি অন্তত একটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রাণ থাকতে তিনি লিবিয়া ছেড়ে যাবেন না। বাস্তবেও লিবিয়ার মাটিতেই তিনি নিহত হয়েছেন।
লিবিয়ার জনগণের গণতন্ত্রের সংগ্রামে ন্যাটোর, বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ নিয়ে অনেক কথা উঠেছে। এ দু’টি দেশের বক্তব্য ছিল, গাদ্দাফির সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণ থেকে নিরীহ নাগরিকদের রক্ষা করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। অন্য দিকে সমালোচকেরা বলেছেন, গাদ্দাফিকে সরিয়ে লিবিয়ার বিশাল তেল ও গ্যাসের মজুদ হাতিয়ে নেয়াই পশ্চিমাদের মতলব ছিল। তাতে অবশ্যই সত্যতা আছে। গাদ্দাফি ধরা পড়ার পরের দিন ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিপ হ্যানন ব্যবসায়ীদের বলেছেন, ‘স্যুটকেস প্যাক করে’ লিবিয়ায় ছুটে যেতে। তেল ও গ্যাসের চুক্তি ছাড়াও যে অসংখ্য ঘরবাড়ি ইমারত ও স'াপনা বিধ্বস্ত হয়েছে সেসব মেরামতও বিশাল অঙ্কের ব্যবসায় হবে। ওয়াশিংটন লিবিয়ার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়নি, কিন' কালবিলম্ব না করেই প্রেসিডেন্ট ওবামা যে ভাষণ দিয়েছেন কার্যত তাতে বলা হয়েছে, মার্কিন ভূমিকাও কারো চেয়ে কম ছিল না।
অপর দিকে এ কথাও সত্যি, লিবিয়ার জনসাধারণের গণতন্ত্রের আন্দোলন খুবই বাস্তব ছিল। খুব সম্ভবত গাদ্দাফি কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কারে সম্মত হলে লিবীয়রা শান্ত হতো। গণতান্ত্রিক অধিকার না দিলেও গাদ্দাফি তেল রফতানির অর্থ থেকে লিবীয়দের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করেছেন। কিন' সংস্কারের পরিবর্তে তিনি যখন অস্ত্রবলে বেনগাজিতে এবং অন্যত্র বিদ্রোহীদের দমনের প্রয়াস পান, জনসাধারণ তখন আর আপসে রাজি ছিল না। এরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণ এবং ইঙ্গ-ফরাসি বিমান আক্রমণের আগেই বিদ্রোহীরা বেনগাজিসহ পূর্ব লিবিয়ার একটা বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছিল। অর্থাৎ তাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ খাঁটি ছিল, বিদেশী হস্তক্ষেপ তাদের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে লিবীয়দের মুক্তির সংগ্রামে চমৎকার মিল আছে। বাংলাদেশের জনসাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার আর অর্থনৈতিক সুবিচারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন করে আসছিল। পাকিস্তানিরা তাদের ওপর সামরিক অভিযান চালানোর পর গণতন্ত্রের আন্দোলন স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। বলতে গেলে তারা শূন্য হাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতের হস্তক্ষেপ সে স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছিল মাত্র।
লিবিয়ায় পশ্চিমারা হস্তক্ষেপ করেছিল তেলসম্পদের লোভে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপের পেছনে ভারতেরও বিরাট লোভ ছিল। সেটা পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়া। পশ্চিম ও পূর্ব উভয় সীমান্তেই ভারতকে একটা বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়ে থাকতে হচ্ছিল। ফলে তার প্রতিরক্ষা ব্যয় অসম্ভব রকম বেশি ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় পূর্ব সীমান্তে ভারতকে আর সুবিশাল প্রতিরক্ষা শক্তি মোতায়েন রাখতে হচ্ছে না। সে বাবদ প্রতি বছর তার সাশ্রয় হচ্ছে বহু, বহু শত কোটি ডলারের। ভারতের কাছে বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা আছে। কিন' বাংলাদেশের কাছে ভারতের কৃতজ্ঞতা কোনো মতেই কম হওয়া উচিত নয়।

আরব বসন্ত : বহু ফাঁকি বহু কপটতা
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আর প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রথমে দাবি করেছিলেন, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বিপুল পরিমাণ গণবিধ্বংসী অস্ত্র মজুদ করছিলেন বলেই তারা ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। সে মিথ্যাটা ধরা পড়ে যাওয়ার পর তারা বলেন, আসলে ইরাকিদের গণতন্ত্র আর স্বাধীনতাদানই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল। লক্ষণীয় যে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যখন প্রথমে তিউনিসিয়ায় ও পরে মিসরে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান শুরু হয় পশ্চিমারা, বিশেষ করে ওয়াশিংটন, গোড়ায় তার বিরোধিতাই করছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়াই তিউনিসিয়ার জনগণ স্বৈরতন্ত্রী বেনআলিকে বিতাড়িত করে। মিসরেও হোসনি মোবারকের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠার পরই শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি ঘোষণা করেন। সত্যিকারভাবে ‘আরব বসন্তের’ আবির্ভাব ঘটে।
আরব বসন্তের ব্যাপারে পশ্চিমা, বিশেষ করে ওয়াশিংটনের মনোভাবে আরো বহু ফাঁকি আর কপটতা আছে। ইয়েমেনের গণতন্ত্রের আন্দোলন শুরু হয় তিউনিসিয়ার সমসাময়িকভাবে। বাহরাইনেও একটি গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানকে অস্ত্র বলে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাহরাইনে প্রায় এক হাজার আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে মনে করা হচ্ছে। সৌদি আরব দীর্ঘ এক সারি ট্যাঙ্ক আর এক হাজারেরও বেশি সৈন্য পাঠিয়ে রাজতন্ত্রকে সাহায্য করেছে। মাত্র কয়েক দিন আগে বাহরাইনের আদালত আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা করার দায়ে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও নার্সদের পাঁচ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
ইয়েমেনে ডিক্টেটর আলী আবদুল্লাহ সালেহ ট্যাঙ্ক কামান আর হেলিকপ্টার দিয়ে গণ-আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এ অভিযান পরিচালনা করছে প্রেসিডেন্টের পুত্রের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড বাহিনী। সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশন জেনারেল মোহসেনের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছে। অর্থাৎ ইয়েমেনে এখন একটি পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ চলছে। কয়েক দিন আগের এক খবরে বলা হয়েছিল, এক সারি ট্যাঙ্ককে সৌদি আরব থেকে ইয়েমেনে আসতে দেখা গেছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে অন্তত হাজার দুয়েক লোক মারা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র কেন আধিপত্য বজায় রাখতে চায়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখতে চায় মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত মধ্যপ্রাচ্যের তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং দ্বিতীয়ত, ইসরাইলকে পাকাপোক্তভাবে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়া। এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের প্রধান সুহৃদ আরব শাসকেরা। এ শাসকেরাই যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রের ঢেউকে ঠেকিয়ে রাখতে চান। উপসাগরীয় দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের সে জন্যই তারা সব রকমের সাহায্য-সমর্থন দিচ্ছেন। এই নির্ভরশীলতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা উপসাগরীয় দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে উৎসাহ দেবে না। কিন' এখানেও গণতন্ত্রের কম্পন সুস্পষ্ট। সে জন্যই আরব সরকারগুলো তাদের বর্তমান বাজেটে গৃহায়ন, সমাজকল্যাণ ও বেকারভাতা বাবদ বাজেট বরাদ্দ দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে, সৌদি নারীরা ২০১৫ সাল থেকে স'ানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দিতে এবং প্রার্থী হতে পারবেন। কিন' এই সামান্য সংস্কারে বিশেষ করে সৌদি বুদ্ধিজীবীদের গণতন্ত্রের স্পৃহা মিটবে বলে মনে হয় না।
সবচেয়ে হিংস্র গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান এখন চলছে সিরিয়ায়। প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ ১৯৮২ সালে হোমা প্রদেশে সুন্নি বিদ্রোহ দমনের জন্য ২০ হাজার লোককে হত্যা করেছিলেন। তার পুত্র বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদও হিংস্রতার দিক থেকে কম যান না। দুই সপ্তাহ আগে জাতিসঙ্ঘের এক হিসাবে বলা হয়েছিল, গণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সিরীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণে তিন হাজারের বেশি লোক মারা গেছে। কিন' সিরিয়ার জনগণের আন্দোলনে মদদ দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওয়াশিংটন কিংবা তার পশ্চিমা মিত্ররা দেখাচ্ছে না।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ইসরাইলের কাছ থেকে গোলান মালভূমি ফিরে পাওয়ার বাসনা বারবার প্রকাশ করেছেন। ফিলিস্তিনের জঙ্গি হামাস দলকেও কিছু সাহায্য তিনি দিচ্ছেন, পশ্চিমা চাপ সত্ত্বেও দামেস্ক থেকে হামাসের শীর্ষ নেতাদের তিনি বহিষ্কার করেননি। অন্য দিকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস কিংবা অন্য কোনো ফিলিস্তিনি জোটের গেরিলা আক্রমণকেও তিনি প্রশ্রয় দেননি। সেটা ওয়াশিংটনের একটা বড় বিবেচনা। ইসরাইলের অপর বড় প্রতিবেশী মিসরের সাথে ইসরাইলের শান্তিচুক্তি হয়েছিল। সাইনাই মালভূমিতে মিসরীয় সীমান্ত নিয়ে এতকাল ইসরাইল নিশ্চিন্ত ছিল- যেমন বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে তার পূর্ব সীমান্ত নিয়ে ভারত নিশ্চিন্ত আছে।

সিরিয়া ও নিরাপত্তা পরিষদ
কিন' মিসরে মোবারকের পতনের সময় থেকে ইসরাইল ও ওয়াশিংটন উৎকণ্ঠিত আছে। নির্বাচন হলে যারা মিসরে ক্ষমতায় আসবে তারা ইসরাইল সম্পর্কে কী মনোভাব অবলম্বন করবে বলা কঠিন। তবে এটা বলা যায়, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতন হলে যাদের ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা তারা ইসরাইলের প্রতি অনেক বেশি বিরূপ হবে। সে জন্যই মুখে আরব বসন্তের গুণগান করলেও ওয়াশিংটন বাশার আল আসাদের পতনের জন্য তেমন আগ্রহী নয়।
নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে প্রস্তাব পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম। পুরনো বন্ধুত্বের কারণে রাশিয়া অবশ্যই তেমন কোনো প্রস্তাবে ভেটো দেবে। ভেটো হয়তো চীনও দেবে, কেননা সিরিয়ার বেশির ভাগ তেলের খদ্দের হচ্ছে চীন আর ভারত। তা ছাড়া বোধগম্য কারণেই যুক্তরাষ্ট্র তেমন প্রস্তাব পাসের জন্য তদবিরও করেনি। কিন' বাশার আল আসাদ দীর্ঘকাল গণতন্ত্রীদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। দশ মাস ধরে চললেও আন্দোলনকারীরা ক্ষান্ত হচ্ছেন না। অন্তত তিন হাজার হত এবং বহু হাজার লোক আহত হলেও তাদের আন্দোলন বরং আরো তীব্র হচ্ছে। এবং সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, রাশিয়া ও চীন আরো কঠোর ভাষায় সিরীয় সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের সমালোচনা করছে।
রূপকথার আলাদিন কৌতূহলের বশে বোতল থেকে দৈত্যকে মুক্তি দিয়ে ফেলেছিল। সে দৈত্য আর ফিরে যাবে না। অত্যন্ত সুকৌশলে আলাদিন তাকে বোতলে পুরে ছিপি বন্ধ করে দিতে পেরেছিল। কিন' আরব বিশ্বে যে গণতন্ত্রের দাবি শুরু হয়েছে, বোতল থেকে মুক্ত হয়েছে, সে দাবিকে আবার বোতলে ফেরত পাঠানোর মন্ত্র ওয়াশিংটনেরও জানা আছে বলে আমার মনে
হয় না।
লন্ডন, ২৬-১০-১১
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
serajurrahman@btinternet.com

ভারতীয়রা কেবলই কলা দেখাচ্ছে


২০১১-১১-২৫

তিস্তাচুক্তিতে সই না করেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। অথচ এই চুক্তির ওপর অনেক ভরসা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের। যেচে যেচে দু’মুখো এশিয়ান হাইওয়ে, করিডোর, ট্রানজিট, আমাদের নদীপথ আর নদীবন্দর, চট্টগ্রাম আর মংলাবন্দর- মোট কথা, সব কিছুই ভারতকে দিয়ে দেয়ার পক্ষে খোঁড়া যুক্তি হিসেবে সরকার বলেছিল যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। সে চুক্তি যখন হলো না তখন অনেক রাবিশ অজুহাত দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, তিস্তার পানি ভাগের চুক্তিতে সই হয়নি বলে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিতে রাজি হয়নি। কিন' এ কথা একবারো প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্য কোনো মন্ত্রীর মনে হয়নি যে ট্রানজিট দেয়া না দেয়া সম্পূর্ণ বাংলাদেশের এখতিয়ার, কিন' তিস্তার পানির ন্যায্য অংশ বাংলাদেশকে দিতে ভারত আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্য। তা ছাড়া এখন প্রমাণ হয়ে গেছে যে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে এবং দেয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে।
শেখ হাসিনা তারপর থেকে বলেই চলেছেন: হবে, হবে, তিস্তার পানিচুক্তি হবে শিগগির। স্প্যানিশ ভাষায় একটা ‘স্ল্যাং‘ (চলতি কথা) হচ্ছে ‘মানিয়ানা’- হবে আগামীকাল। সব স্প্যানিশ জানে এই আগামীকাল সঠিকার্থে আজ রাতের পর সূর্য উঠলে যে আগামীকাল হবে সেটা নয়, মানিয়ানার আগামীকাল দশ বছর পরেও হতে পারে আর কখনোই না হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ দিলেন যে, তার ‘শিগগির’ কথাটা স্প্যানিশ স্ল্যাং মানিয়ানার মতোই অনির্ভরযোগ্য। শেখ হাসিনার বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে ভারতেরও চেষ্টার অবধি নেই।
বর্তমান সরকারের লোকেরা দলে বলে বিদেশে বিলাস ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তারা যে এক-একজন ‘কেউকেটা’ সেটা বিদেশীদের জানান দেয়ার এটাই প্রকৃষ্ট পন'া বলে তাদের ধারণা। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে বহু দেশের সরকারপ্রধানই অনুপসি'ত থাকেন। অবশ্য নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাওয়ার উপলক্ষ পেলেই খুশি। তাকে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেয়া হলে তো কথাই নেই। সেসব কথা কেউ শুনল কি না এবং শুনলেও বিদেশীরা বক্তৃতা সম্পর্কে কী ভাবল সে কথায় কী আসে-যায়?
প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার পার্থে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান সম্মেলনে গিয়েছিলেন। কিন' ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাননি সে সম্মেলনে। অতএব ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে ফটো তোলানোর এবং তার সাথে তিস্তাচুক্তি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে ‘আলোচনা করার’ খবর ফলাও করে প্রচার করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। কিন' ড. মনমোহন সিং সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে মালদ্বীপে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও গিয়েছিলেন। তার যাত্রা শুরুর আগে থেকেই প্রচারাভিযান চালানো হলো যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করবেন। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে আরো একবার প্রচার চলে তিনি ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং যথারীতি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ফটোও প্রকাশিত হয়েছে মিডিয়ায়।

আলোচনা আলোচনা খেলাই কি উদ্দেশ্য?
কথা হচ্ছে আলোচনা হওয়াটাই কি মূল উদ্দেশ্য? তিন বছর ধরে অনর্গল আলোচনা করে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে। কিন' তাতে কী লাভ হচ্ছে বাংলাদেশের? বরঞ্চ এসব সফর বাবদ বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে বর্তমানে প্রায় দেউলিয়া বাংলাদশের। মালদ্বীপের আলোচনায় যে সত্যিকারের কোনো ফল হয়নি সেটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন তার দেশের সাংবাদিকদের, ফেরত যাত্রায়। ড. সিং বলেছেন, চুক্তি অবশ্যই হবে তবে সে চুক্তি হতে হবে জাতীয় (সর্বভারতীয়) মতৈক্যের ভিত্তিতে। অর্থাৎ সারা ভারতের মানুষ, অন্তত সবগুলো রাজ্য যদি রাজি না হয় তাহলে বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীগুলোর পানি দেয়া হবে না। একটা প্রশ্ন অবশ্যই মনে আসে : সাত মণ তেল কবে পুড়বে আর শ্রীরাধিকা কবে নৃত্য করবেন?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরো একটা কথা বলেছেন তার দেশের সাংবাদিকদের, যে কথায় বাংলাদেশ সরকারের মাথায় হাত দিয়ে বসা উচিত। তিনি বলেছেন, সীমান্ত এলাকায় ভূমি বিনিময় সম্বন্ধে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে যে চুক্তি হয়েছে সে চুক্তি কার্যকর করতেও বিলম্ব হবে, কেননা সে জন্য ভারতকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সীমান্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় ভূমি বিনিময় সম্পর্কে চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ী ছিটমহলটি ভারতের কাছে হস্তান্তরের লক্ষ্যে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। বেরুবাড়ী ভারত ঠিকই পেয়েছে কিন' ৩৭ বছরেও বাংলাদেশ তিনবিঘা করিডোরটি পায়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে খবর পাওয়া গিয়েছিল সীমান্তের বিভিন্ন স'ানে, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট সীমান্তে, বিস্তীর্ণ এলাকা ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এবারো বাংলাদেশ বিনিময়ে তার পাওনা এলাকাগুলো পাবে না। কেননা এবার যে চটজলদি ভারতের সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
বাংলাদেশের মানুষকে নানাভাবে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন' সে ‘বন্ধুত্ব’ সত্ত্বেও শ্রীমতী ব্যানার্জি ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা আসেননি এবং তিনি আসেননি বলে অজুহাত দেখিয়ে ড. মনমোহন সিং তিস্তাচুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করেছিলেন। মমতা ব্যানার্জি তখন বলেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ প্রস্তাবিত চুক্তিতে রক্ষিত হয়নি বলেই তিনি ঢাকা আসেননি। মমতা দফায় দফায় হুমকি দেন তার রাজ্যের স্বার্থ রক্ষিত না হলে তিনি কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে আসবেন, অর্থাৎ মনমোহন সিংয়ের সরকারের পতন ঘটাবেন।

মনমোহন ও মমতা ভারতের স্বার্থ দেখছেন,
বাংলাদেশের স্বার্থ দেখছে কে?
আরো শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতা ব্যানার্জির মন গলাতে কূটনৈতিক রীতিপদ্ধতি বিসর্জন দিয়ে কলকাতা যাবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে শীর্ষ সম্মেলন করতে। শেষ পর্যন্ত বোধহয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বোধোদয় হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি গত সপ্তাহে কলকাতায় গিয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জি তাকেও বন্ধু বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন' কোনো আশার কথা তিনি বলেননি। বরং বলেছেন তিস্তাচুক্তি হবে, তবে কবে হবে বলা যাবে না। কেননা তাকে আগে তার নিজ রাজ্যের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।
মমতা ব্যানার্জির সাথে দীপু মনির নবলব্ধ বন্ধুত্বের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ অসম বন্ধুত্বের মূল ভিত্তিটি চমৎকার ফুটে উঠেছে। সেটা এই যে, দুর্বল পক্ষ কেবলই দিয়ে যাবে আর প্রবল পক্ষ শুধুই নিতে থাকবে। আসলে ভারতের সুনজরে যেতে বর্তমান সরকার যে সব কিছু দিয়ে দিতে রাজি আছেন ভারতীয়রা গোড়া থেকেই সেটা বুঝে ফেলেছে। এখন তারা ‘দিচ্ছি-দেবো’ বলে শুধুই ভাঁওতা দিচ্ছে। সোজা কথায় তারা আমাদের কেবলই কলা দেখাচ্ছে।
আরেকটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ। ভারতের বহু পরিবেশ বিশেষজ্ঞও বলেছেন, বরাক নদীর ওপর এই বাঁধটি তৈরি হলে মনিপুর ও বাংলাদেশসহ বিশাল এলাকার পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে যাবে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে বাংলাদেশ। শুকনো মওসুমে বর্তমানে পদ্মা ও তিস্তার যে দুরবস'া সুরমা, কুশিয়ারা ও ফলত মেঘনার অবস'াও সে রকমই দাঁড়াবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের মতো পূর্বাঞ্চলেও মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। মোট ৪২টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত এখন পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ভারতের এই হিংস্র আগ্রাসন বন্ধ না হলে আগামী ৩০-৪০ বছরে ‘সুজলা সুফলা বাংলাদেশ’ বর্ণনা ‘আমার সোনার বাংলার’ মতো কবি-কল্পনাতেই নির্বাসিত হবে।
টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির পরিকল্পনার খবরে বাংলাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। গণতন্ত্রকামী সব মানুষ রোষে ফুঁসে উঠেছিল। লংমার্চ করে টিপাইমুখে যাওয়ার কথাও বলাবলি হচ্ছিল। সরকার তখন একদল আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্যকে প্রকৃত পরিসি'তি অবগত হওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল। উল্লেখ্য, এ প্রতিনিধিদলে একজনও প্রকৌশলী কিংবা বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। ভারতীয়রা তাদের স্বভাবসুলভ ছলাকলা দিয়ে তাদের ‘হাইকোর্ট দেখিয়েছে’। আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের প্রচুর খাতির-যত্ন করা হয়েছে, তারপর হেলিকপ্টারে করে তাদের উড়িয়ে এনে বলে দিয়েছে যে, টিপাইমুখে তারা বাঁধ তৈরি শুরু করেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাকি শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো কাজ ভারত করবে না এবং বাঁধ তৈরির আগে বাংলাদেশকে জানানো হবে।
সে প্রতিশ্রুতিও এখন ভারতের অন্যান্য আশ্বাসের মতো ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই খবর প্রচারিত হয় যে, টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির জন্য মনিপুরের রাজ্য সরকার এবং একটি রাষ্ট্রায়ত্ত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। যদ্দূর জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা দূরের কথা ঢাকার সরকারের অজ্ঞাতসারেই এ চুক্তি করা হয়েছে এবং টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। ভারত যে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে একটি নতজানু আজ্ঞাবহ ও আশ্রিত প্রশাসনিক সত্তা বলেই বিবেচনা করে এ হচ্ছে তার প্রমাণ।
বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে ভারতের এই আগ্রাসী উদ্যোগের কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না; বরং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মাহবুুবুর রহমান বলেছেন, টিপাইমুখে বাঁধ তৈরি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বলার কিছু নেই। শেখ হাসিনা সরকারের অনেক মন্ত্রীকেই অযোগ্য বলা অনুচিত হবে না। অন্যথায় একটি স্বাধীন দেশের সরকারের অন্য একটি দেশের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকা তারা সমর্থন করতে পারতেন না। আলহাজ মাহবুবুর রহমান স'ূলমতি না হলে বুঝতে পারতেন যে বাংলাদেশকে একটি অভিন্ন নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে ভারতের নেই। শেখ হাসিনা যদি একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপযোগী আত্মসম্মানবিশিষ্ট হতেন তাহলে তার অবশ্য কর্তব্য হতো এই অর্বাচীন মন্ত্রীকে তার দেশদ্রোহী উক্তির জন্য অবিলম্বে বরখাস্ত করা।
অপর দিকে ভারত বাংলাদেশের নদী এবং আশুগঞ্জ ও আখাউড়া স'লবন্দর যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছে। গত সপ্তাহেও ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী‘ নামের একখানি ভারতীয় জাহাজ আশুগঞ্জে মাল নামিয়েছে এবং ট্রাকে করে সেসব মাল আখাউড়া হয়ে আগরতলায় গেছে।

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম
অনেকগুলো বিষয় এখানে বিবেচ্য। প্রথমত, বাংলাদেশের মানুষকে বলা হয়েছিল যে, আগরতলায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য অত্যধিক ভারী ও বিরাটাকারের যন্ত্রপাতিই শুধু যাবে এ পথে। বাংলাদেশের সড়ক-সেতু অবকাঠামো এবং নদীস্রোতের বিপুল ক্ষতি করে সেসব যন্ত্রপাতি বহু আগেই ভারতে চলে গেছে। এখন বলা হচ্ছে ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ আরো কয়েক মাস এ পথে ভারতীয় মাল চলাচল হবে। কিসের এই পরীক্ষা? বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দলন করার পরীক্ষা? শুধু কি তাই? কনটেইনারগুলোতে কী মাল আগরতলা ও উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যগুলোতে যাচ্ছে সে খবর সংগ্রহের কোনো চেষ্টাই বাংলাদেশ সরকার করছে না। অনেকেই সন্দেহ করছেন উলফা প্রভৃতি এসব রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করার জন্য এবং অরুণাচলে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস'তি হিসেবে সমরশক্তি বৃদ্ধির জন্য এসব কনটেইনারে অস্ত্রশস্ত্র নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। গণচীন ও উত্তরপূর্ব ভারতের মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উদাসীনতাকে বৈরী আচরণ বলেই দেখবে।
ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আছে যে, অনুরূপ পরিসি'তিতে একটি দেশের গেরিলা যোদ্ধারা আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশের ভেতরে ঢুকে সে দেশের অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে। আসাম মনিপুর প্রভৃতি রাজ্যের বহু পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ এসব বাঁধ তৈরির প্রবল বিরোধী। তারা যে বাঁধ উড়িয়ে দেয়ার মতো নেগেটিভ কাজ করবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কর্তব্য হবে যেকোনো মূল্যে ভারতীয় চালান ও কনটেইনার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলাচল বন্ধ করার মতো প্রতিবাদ করা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সারা দেশের মতৈক্য ছাড়া বাংলাদেশকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে অসমর্থ। নিজ রাজ্যের স্বার্থের দোহাই দিয়ে মমতা ব্যানার্জি তিস্তাচুক্তির বিরোধিতা করছেন। কিন' বাংলাদেশের স্বার্থের কথা কে বলবে? শেখ হাসিনার সরকার কি ভারতকে ট্রানিজট-করিডোর ইত্যাদি দেয়ার ব্যাপারে দেশের মানুষের মতামত যাচাই করেছেন? এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের কোনো চেষ্টা হয়েছে? অর্থাৎ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও অস্ত্রের চালান যাচ্ছে দেশবাসীর আপত্তি সত্ত্বেও। এবং সে কারণে নৈতিক বিবেচনায় এ ট্রানজিট সম্পূর্ণ অবৈধ। বাংলাদেশের আমলারাও বলেছেন কোন আইনে কোন চুক্তিতে বিনা তদারকে এবং ফি না দিয়ে এসব চালান যাচ্ছে তারা জানেন না।
বাংলাদেশের মানুষের উচিত এ মুহূর্তে শপথ নেয়া যে, জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া আর একটি ট্রাকও আশুগঞ্জ থেকে ভারতে যেতে দেয়া উচিত হবে না। আর একটি ভারতীয় জাহাজকেও এসব অবৈধ চালান নিয়ে আশুগঞ্জে আসতে দেয়া হবে না। যেহেতু এসব চালান অবৈধ সেহেতু দেশের সাধারণ মানুষকে এসব চালানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ খালাস করতে দেয়নি। বহু পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি তারা বিধ্বস্ত করেছে। সুতরাং অবৈধ ভারতীয় পণ্য ও অস্ত্রের চালান বন্ধ করার সামর্থ্য বাংলাদেশের মানুষের আছে। তাদের মনে রাখতে হবে এটা আরো একটি মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। এবারের যুদ্ধ হবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ।

চীনের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি অত্যাবশ্যক
খালেদা জিয়া তার সর্বশেষ সরকারের আমলে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল দু’টি এশীয় পরাশক্তি ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে একটা নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বনের লক্ষ্যে তথাকথিত ‘লুক ইস্ট’ মনোভাব গড়ে তোলা হবে। সমপ্রতি তিনি আবার প্রস্তাব দিয়েছেন যে, গণচীনকেও সার্কের সদস্যপদভুক্ত করতে হবে। বিএনপি নেত্রীর এ প্রস্তাব অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী। ভারত প্রতিবেশী ক্ষুদ্রতর দেশগুলোকে চোখ ঠেরে শাসিয়ে রাখছে। একটা দৃষ্টান্ত এই যে, সাম্প্রতিক মালদ্বীপ শীর্ষ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিবণ্টন সম্পর্কে আলোচনার বাংলাদেশী প্রস্তাবে ভারত বাধা দিয়েছে। অথচ নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এ বিষয়টির সাথে সংযুক্ত।
গণচীনকে অবশ্যই সার্কের সদস্য করতে হবে। এবার যখন নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসবে তখন সর্বাগ্রেই চীনের সাথে বাংলাদেশের এক প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে হবে, যাতে ভারত আর বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির সাহস না পায়। এবং আমি মনে করি যে, মিয়ানমারকেও সার্কের সদস্য করা খুবই জরুরি। গত কয়েক মাসে মিয়ানমারের সরকার গণতন্ত্রের পথে আশাপ্রদ উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে হয়। দেশটিকে সদস্যপদ দিয়ে সার্ক মিয়ানমারের বর্তমান নেতৃত্বকে পুরস্কৃত ও উৎসাহিত করতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট, বিবিসি বাংলা বিভাগের
সাবেক প্রধান
(লন্ডন, ২২.১১.১১)
serajurrahman@btinternet.com

আওয়ামী লীগের সর্বব্যাপী সহিংসতা


২০১১-১২-২৩

একাত্তরের বিজয় দিবস ছিল শত নির্যাতন এবং আত্মত্যাগে ক্লান্ত জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। শেখ মুজিবুর রহমান সে দিন ঢাকায় ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়টাও তিনি রণাঙ্গনে ছিলেন না, ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি আপসে ধরা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও কেউ পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশ নেয়া তো দূরের কথা। তারা ২৫ মার্চ রাতে এবং পরবর্তী দিন-দুয়েকের মধ্যে কলকাতা চলে যান।
স্টেটসম্যান পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সন্তোষ বসাক ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ায় আমাকে কলকাতার বিভিন্ন হোটেল ও গেস্ট হাউসে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেশত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতারা সেসব হোটেলে থাকতেন এবং যাবতীয় ব্যয়ের ভাউচার (কারো কারো ফুর্তি করার বিলসহ) সই করতেন। সেসব বিল পরিশোধ করত ভারত সরকার। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার আগে তাদের কোনো স্বীকৃত মর্যাদাও ছিল না, তারা ছিলেন একটি বিদেশী রাষ্ট্রের পলাতক রাজনীতিক। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা ভোগ করেছেন তারা। ভারতের আজ্ঞা অমান্য করা বহু আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষেই সম্ভব নয়। দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে আর যারা পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ দিয়েছে এবং তাদের নির্যাতন সয়েছে কলকাতায় পলাতক নেতারা তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানেরা এবং বিডিআরের সদস্যরা আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস'ত ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকেরা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সমর্থকেরা জনসাধারণকে উদ্দীপিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। ছাত্র-অছাত্র তরুণেরা ঘর ছেড়ে চলে গেল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। সাধারণ শ্রমজীবী ও সংসারী মানুষ যথাসাধ্য হানাদার বাহিনীর সাথে অসহযোগিতা ও প্রতিরোধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা আশ্রয় দিয়েছেন, নিজেদের থালার ভাত তাদের সাথে ভাগ করে খেয়েছেন। বিনিময়ে বহু নির্যাতন-নিপীড়ন তারা সহ্য করেছেন। অনেকে প্রাণ দিয়েছেন, বহু নারী হয়েছেন নিগৃহীত। একাত্তরের বিজয় দিবসে উল্লাস করেছেন তারা।
কিন' কয়েক দিনের মধ্যেই সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ের গর্তগুলোর মোটামুটি মেরামতের কাজ শেষ হতেই কলকাতার বিলাসব্যসন ছেড়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানে উড়ে এলেন। এসেই নতুন স্বাধীন দেশের মালিকানা দাবি করলেন তারা, আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন হয়ে ঢাকা গেলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, তারপর তিনি হলেন একচ্ছত্র অধিপতি। জাসদ ও ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা একটা জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষীণ দাবি তোলেন। জবাবে শেখ মুজিব ‘লাল ঘোড়া দাড়াইয়া দিব’ ঘোষণা দিলেন। রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজার জাসদ ও অন্যান্য দলের কর্মীকে হত্যা করল। নিহত নেতাদের একজন ছিলেন সিরাজ শিকদার। গ্রেফতারের পর পিঠে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। অন্তত আরো পাঁচ বছর যাতে মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা না থাকে সেটা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে একটি বিতর্কিত ও বিভাজক মেয়াদ-মধ্য নির্বাচন করা হলো। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়।

বাংলাদেশের বড় ট্র্যাজেডি
বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসের এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ট্র্র্যাজেডি। আরো বহু ট্র্যাজেডি ঘটেছে, কিন' সেসবেরই উৎস হচ্ছে এখানে। আওয়ামী লীগ সেই যে ‘যা কিছু পাই লুটেপুটে খাই’ পথ ধরেছে তার তীব্রতা ক্রমেই বেড়ে গেছে। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ভারত থেকে ফিরেই ঘোষণা দিলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থান ও মুজিব হত্যার পরবর্তী বিক্ষুব্ধ পরিসি'তিতে যারাই রাষ্ট্র তরণীর হাল ধরেছিলেন, দেশটার অস্তিত্ব কোনো মতে টিঁকিয়ে রেখেছিলেন, তারা সবাই খুনি। কিন' সে সময় তাদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্বই যে ধুয়েমুছে যেতে পারত, সে কথা বিবেচনা করার মতো বিচক্ষণতা আওয়ামী লীগ নেত্রী দেখাতে পারেননি।
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘চোর চোর’ বলে অভিযোগ তোলেন। কিন' বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্য দাতা দেশগুলো এ সরকারকেই চোর বলছে, চুরির তদন্ত ও অবসান না হলে তারা বাংলাদেশকে আর ঋণ দিতে অস্বীকার করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে তিনি নতুন বছরে বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই, ‘সব কুচ ঠিক হায়’।
তিনি ছেলেপুলে, আর সভাসদ নিয়ে প্রায়ই বিদেশে কারণে-অকারণে ভ্রমণে যাচ্ছেন, দু’হাতে বিদেশী মুদ্রা উড়াচ্ছেন। এ দিকে তার অর্থমন্ত্রী দফায় দফায় নানাভাবে বলে যাচ্ছেন অর্থনীতির বারোটা বেজে গেছে, নাভিশ্বাস উঠেছে।
বাংলাদেশ এখন এমনভাবে চলছে যেন একজনই এর অধিশ্বর। তার নির্দেশে একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন বাহুবলে, অস্ত্রবলে সব গণতান্ত্রিক শক্তির টুঁটি টিপে মারার চেষ্টা করছে। ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ‘, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’ ইত্যাদি ধরনের বহু সার্থক উপমাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আরো অর্থবহ করে তুলেছেন। দেশে ইদানীং ছিনতাই, গুম-খুন ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রকম বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে গুম ও খুন হচ্ছেন বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সব কিছুর জন্যই দায়ী খালেদা জিয়া, কেননা তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চান। খালেদা জিয়া তার সমর্থকদের খুন করাচ্ছেন- এ কথা শুধু উন্মাদেই বিশ্বাস করবে।
এ কথা শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ নেতারা স্বীকার করতে চান না- যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথম এবং প্রধান বিরোধী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধের প্রথম কাতারে পড়ে অপরাধী শত্রুপক্ষের সৈন্যরা। একাত্তরের হামলায় যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে ১৯৫ জনকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধী বলে শনাক্ত করা হয়েছিল; কিন' শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা দূর করে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। স্বদেশে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন সামাজিক শান্তি ও সদ্ভাব স'াপনের লক্ষ্যে। তার সে উদ্যোগ তখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন' বর্তমান আওয়ামী লীগ মুজিবের আওয়ামী লীগ নয়; বরং হিটলারের নাৎসিদের সাথেই এ দলের তুলনা চলে। একাত্তরের রাজাকার-আলবদরদের অনেকে আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছেন। কেউ কেউ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাথে আত্মীয়তা গড়ে তুলেছেন। তাদের গায়ে কেউ টোকা দেয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে কী ঘটছে? হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি স্বৈরশাসন স'াপন করতে চান। মুজিব তিন মিনিটে সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল করেছিলেন, আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। সংসদে আপত্তি করার মতো সৎ সাহস কারো ছিল না। কিন' বাংলাদেশের মানুষ তখনো প্রতিবাদ করেছেন, এখনো করছেন। পঁচাত্তরের সাথে তফাৎ এখানে যে অনেক পুড়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রীরা খাঁটি সোনা হয়েছেন, তারা সক্রিয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করছেন। এ সরকারের সেটা সহ্য হচ্ছে না। হিটলারের স্টর্ম ট্রুপার আর গেস্টাপোর মতো আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার, আর সম্পূর্ণ দলীয়কৃত পুলিশ-র‌্যাব উপলক্ষ পেলেই গণতন্ত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সমস্যা হচ্ছে, কে পুলিশ আর কে পুলিশ নয় বোঝার উপায় নেই। তবে তারা বিরোধীদের নির্যাতন করছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কেউ ইউনিফর্ম পরছে, আর কেউ পরছে না- তফাৎ শুধু এখানে।

বিজয় দিবস- তখন এবং এখন
একাত্তরে যে বিজয় দিবস ছিল সংগ্রামী-অসংগ্রামী জনতার, সে বিজয়কে এবং সে বিজয় দিবসকেও ওরা ছিনিয়ে নিতে চায়। এবারের বিজয় দিবসের বিশেষ তাৎপর্য ছিল, এটা ছিল মুক্তির ৪০তম বার্ষিকী। কিন' সে বিশেষ অনুষ্ঠানের পবিত্রতা নষ্ট করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজন। আগের দিন (১৫ ডিসেম্বর) জাতীয় স্মৃতিসৌধের পথে ব্যানার আর ফেস্টুন লাগিয়েছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপির কর্মীরা এবং অন্যরা। রাতের বেলা শাসক দলের লোকজন বিএনপির ব্যানার আর ফেস্টুনগুলো ছিঁড়ে ফেলে।
বিজয় দিবসের প্রভাতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ৯ বছর স'ায়ী এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার আপসহীন সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে, তিনবার তিনি জনসাধারণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং বর্তমানেও তিনি বিরোধী দলের নেতা। আওয়ামী লীগের কর্মীরা খালেদা জিয়ার পথরোধ করেন। তাদের ধারণা, শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাবেন তাদের নেত্রী, বিএনপির নেত্রী নন। সারা দেশে বিএনপির বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে, খুনখারাবি আর ভাঙচুর করেছে এরা। অর্থাৎ গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিলো, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অধিকারও আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নিলো। ওই যে বলছিলাম : যা কিছু পাই লুটেপুটে খাই।
আসলে শহীদদের, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা আওয়ামী লীগের একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার মাত্র- অনেকটা তাদের লগি-লাঠি-বৈঠারই মতো। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়, লাখে লাখে তারা মুক্তিযুদ্ধের সনদ দিচ্ছেন এমন লোকদের ১৯৭১ সালে যাদের অনেকের জন্মই হয়নি। তারা আশা করছেন, এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা তাদের রাজনৈতিক ক্যাডারভুক্ত হবেন, নিদেন তাদের ভোট দেবেন।
গত রোববার বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। দেশের বিভিন্ন স'ান থেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেটা সরকারের এবং শাসক দলের সহ্য হয়নি। দেশজুড়ে একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল তারা। ঢাকার পথে যেসব বাসে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছিলেন আওয়ামী পুলিশ তাদের গতিরোধ করেছে, আওয়ামী লীগের লোকেরা দলীয়কৃত পুলিশের প্রটেকশনে থেকে সেসব বাস ভাঙচুর করেছেন, আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন যানবাহনে। তারপর পুলিশ তাদের প্রভুদের নির্দেশে গণ্ডা গণ্ডা মামলা রুজু করেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

ফ্যাসিবাদী তাণ্ডব
আরো ভয়ঙ্কর তাণ্ডব সৃষ্টি হয়েছিল দেশের রাজধানীতে। যারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে যাচ্ছিলেন তাদের ওপর লাঠিপেটা করা হয়েছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে, দলের নেতাকর্মীদের নিজেদের দফতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ভীতি প্রদর্শনের জন্য সে দফতরের সামনে বোমা ফাটানো হয়েছে। গোড়া থেকেই এ সরকার বিএনপিকে সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। সভা কিংবা সমাবেশ করার স'ান তাদের দেয়া হচ্ছে না, তারা মিছিল করলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ও পুলিশ সেসব মিছিলে চড়াও হচ্ছে, যখন-তখন বিএনপির দফতর ঘেরাও করা হচ্ছে, কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া হচ্ছে সে দফতর। কিন' কেন? দেশে কি এখন রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস'া আছে? বিএনপি কি কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল? তাই প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে- কোন যুক্তিতে আর কোন অধিকারে সরকার এসব জঘন্য ফ্যাসিবাদী কাণ্ডকারখানা করছে?
একাত্তরে পাকিস্তানিরা অস্ত্রবলে বাংলাদেশকে পদাবনত রাখতে চেয়েছিল। তাদের সৈন্যরা মানুষ হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে। তাদের ঘাতকেরা মানুষ ছিনতাই করেছে, গুম করেছে, খুন করেছে। তার সাথে আজকের বাংলাদেশের কোনো তফাৎ আছে কি? একটি ফ্যাসিবাদী দল চিরস'ায়ীভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে চায়। দলীয়কৃত পুলিশ ও র‌্যাব গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হামলা করছে, নিরীহ মানুষও হত্যা করছে তারা। কারা গত বছর ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আলম চৌধুরীকে অপহরণ করেছিল? অদ্যাবধি তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে অপহরণ আর গুপ্তহত্যা বেড়েই চলেছে। গত দু-তিন মাসে গুম-খুনের যেন তাণ্ডব চলছে। বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সর্বব্যাপী সহিংসতা চরমে উঠেছে।
(লন্ডন ২১-১২-১১)
serajurrahman@btinternet.com