বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

ভারতীয়রা কেবলই কলা দেখাচ্ছে


২০১১-১১-২৫

তিস্তাচুক্তিতে সই না করেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। অথচ এই চুক্তির ওপর অনেক ভরসা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের। যেচে যেচে দু’মুখো এশিয়ান হাইওয়ে, করিডোর, ট্রানজিট, আমাদের নদীপথ আর নদীবন্দর, চট্টগ্রাম আর মংলাবন্দর- মোট কথা, সব কিছুই ভারতকে দিয়ে দেয়ার পক্ষে খোঁড়া যুক্তি হিসেবে সরকার বলেছিল যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে। সে চুক্তি যখন হলো না তখন অনেক রাবিশ অজুহাত দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, তিস্তার পানি ভাগের চুক্তিতে সই হয়নি বলে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিতে রাজি হয়নি। কিন' এ কথা একবারো প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্য কোনো মন্ত্রীর মনে হয়নি যে ট্রানজিট দেয়া না দেয়া সম্পূর্ণ বাংলাদেশের এখতিয়ার, কিন' তিস্তার পানির ন্যায্য অংশ বাংলাদেশকে দিতে ভারত আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্য। তা ছাড়া এখন প্রমাণ হয়ে গেছে যে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হচ্ছে এবং দেয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে।
শেখ হাসিনা তারপর থেকে বলেই চলেছেন: হবে, হবে, তিস্তার পানিচুক্তি হবে শিগগির। স্প্যানিশ ভাষায় একটা ‘স্ল্যাং‘ (চলতি কথা) হচ্ছে ‘মানিয়ানা’- হবে আগামীকাল। সব স্প্যানিশ জানে এই আগামীকাল সঠিকার্থে আজ রাতের পর সূর্য উঠলে যে আগামীকাল হবে সেটা নয়, মানিয়ানার আগামীকাল দশ বছর পরেও হতে পারে আর কখনোই না হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ দিলেন যে, তার ‘শিগগির’ কথাটা স্প্যানিশ স্ল্যাং মানিয়ানার মতোই অনির্ভরযোগ্য। শেখ হাসিনার বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে ভারতেরও চেষ্টার অবধি নেই।
বর্তমান সরকারের লোকেরা দলে বলে বিদেশে বিলাস ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তারা যে এক-একজন ‘কেউকেটা’ সেটা বিদেশীদের জানান দেয়ার এটাই প্রকৃষ্ট পন'া বলে তাদের ধারণা। আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে বহু দেশের সরকারপ্রধানই অনুপসি'ত থাকেন। অবশ্য নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাওয়ার উপলক্ষ পেলেই খুশি। তাকে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ দেয়া হলে তো কথাই নেই। সেসব কথা কেউ শুনল কি না এবং শুনলেও বিদেশীরা বক্তৃতা সম্পর্কে কী ভাবল সে কথায় কী আসে-যায়?
প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার পার্থে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান সম্মেলনে গিয়েছিলেন। কিন' ভারতের প্রধানমন্ত্রী যাননি সে সম্মেলনে। অতএব ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে ফটো তোলানোর এবং তার সাথে তিস্তাচুক্তি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে ‘আলোচনা করার’ খবর ফলাও করে প্রচার করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। কিন' ড. মনমোহন সিং সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে মালদ্বীপে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও গিয়েছিলেন। তার যাত্রা শুরুর আগে থেকেই প্রচারাভিযান চালানো হলো যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করবেন। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে আরো একবার প্রচার চলে তিনি ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং যথারীতি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ফটোও প্রকাশিত হয়েছে মিডিয়ায়।

আলোচনা আলোচনা খেলাই কি উদ্দেশ্য?
কথা হচ্ছে আলোচনা হওয়াটাই কি মূল উদ্দেশ্য? তিন বছর ধরে অনর্গল আলোচনা করে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে। কিন' তাতে কী লাভ হচ্ছে বাংলাদেশের? বরঞ্চ এসব সফর বাবদ বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে বর্তমানে প্রায় দেউলিয়া বাংলাদশের। মালদ্বীপের আলোচনায় যে সত্যিকারের কোনো ফল হয়নি সেটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন তার দেশের সাংবাদিকদের, ফেরত যাত্রায়। ড. সিং বলেছেন, চুক্তি অবশ্যই হবে তবে সে চুক্তি হতে হবে জাতীয় (সর্বভারতীয়) মতৈক্যের ভিত্তিতে। অর্থাৎ সারা ভারতের মানুষ, অন্তত সবগুলো রাজ্য যদি রাজি না হয় তাহলে বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীগুলোর পানি দেয়া হবে না। একটা প্রশ্ন অবশ্যই মনে আসে : সাত মণ তেল কবে পুড়বে আর শ্রীরাধিকা কবে নৃত্য করবেন?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরো একটা কথা বলেছেন তার দেশের সাংবাদিকদের, যে কথায় বাংলাদেশ সরকারের মাথায় হাত দিয়ে বসা উচিত। তিনি বলেছেন, সীমান্ত এলাকায় ভূমি বিনিময় সম্বন্ধে শেখ হাসিনার সরকারের সাথে যে চুক্তি হয়েছে সে চুক্তি কার্যকর করতেও বিলম্ব হবে, কেননা সে জন্য ভারতকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সীমান্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় ভূমি বিনিময় সম্পর্কে চুক্তি করেছিলেন। সে চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ী ছিটমহলটি ভারতের কাছে হস্তান্তরের লক্ষ্যে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। বেরুবাড়ী ভারত ঠিকই পেয়েছে কিন' ৩৭ বছরেও বাংলাদেশ তিনবিঘা করিডোরটি পায়নি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে খবর পাওয়া গিয়েছিল সীমান্তের বিভিন্ন স'ানে, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট সীমান্তে, বিস্তীর্ণ এলাকা ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এবারো বাংলাদেশ বিনিময়ে তার পাওনা এলাকাগুলো পাবে না। কেননা এবার যে চটজলদি ভারতের সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
বাংলাদেশের মানুষকে নানাভাবে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন' সে ‘বন্ধুত্ব’ সত্ত্বেও শ্রীমতী ব্যানার্জি ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা আসেননি এবং তিনি আসেননি বলে অজুহাত দেখিয়ে ড. মনমোহন সিং তিস্তাচুক্তিতে সই করতে অস্বীকার করেছিলেন। মমতা ব্যানার্জি তখন বলেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ প্রস্তাবিত চুক্তিতে রক্ষিত হয়নি বলেই তিনি ঢাকা আসেননি। মমতা দফায় দফায় হুমকি দেন তার রাজ্যের স্বার্থ রক্ষিত না হলে তিনি কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন থেকে বেরিয়ে আসবেন, অর্থাৎ মনমোহন সিংয়ের সরকারের পতন ঘটাবেন।

মনমোহন ও মমতা ভারতের স্বার্থ দেখছেন,
বাংলাদেশের স্বার্থ দেখছে কে?
আরো শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতা ব্যানার্জির মন গলাতে কূটনৈতিক রীতিপদ্ধতি বিসর্জন দিয়ে কলকাতা যাবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে শীর্ষ সম্মেলন করতে। শেষ পর্যন্ত বোধহয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বোধোদয় হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি গত সপ্তাহে কলকাতায় গিয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জি তাকেও বন্ধু বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন' কোনো আশার কথা তিনি বলেননি। বরং বলেছেন তিস্তাচুক্তি হবে, তবে কবে হবে বলা যাবে না। কেননা তাকে আগে তার নিজ রাজ্যের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।
মমতা ব্যানার্জির সাথে দীপু মনির নবলব্ধ বন্ধুত্বের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ অসম বন্ধুত্বের মূল ভিত্তিটি চমৎকার ফুটে উঠেছে। সেটা এই যে, দুর্বল পক্ষ কেবলই দিয়ে যাবে আর প্রবল পক্ষ শুধুই নিতে থাকবে। আসলে ভারতের সুনজরে যেতে বর্তমান সরকার যে সব কিছু দিয়ে দিতে রাজি আছেন ভারতীয়রা গোড়া থেকেই সেটা বুঝে ফেলেছে। এখন তারা ‘দিচ্ছি-দেবো’ বলে শুধুই ভাঁওতা দিচ্ছে। সোজা কথায় তারা আমাদের কেবলই কলা দেখাচ্ছে।
আরেকটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ। ভারতের বহু পরিবেশ বিশেষজ্ঞও বলেছেন, বরাক নদীর ওপর এই বাঁধটি তৈরি হলে মনিপুর ও বাংলাদেশসহ বিশাল এলাকার পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে যাবে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে বাংলাদেশ। শুকনো মওসুমে বর্তমানে পদ্মা ও তিস্তার যে দুরবস'া সুরমা, কুশিয়ারা ও ফলত মেঘনার অবস'াও সে রকমই দাঁড়াবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের মতো পূর্বাঞ্চলেও মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। মোট ৪২টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত এখন পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ভারতের এই হিংস্র আগ্রাসন বন্ধ না হলে আগামী ৩০-৪০ বছরে ‘সুজলা সুফলা বাংলাদেশ’ বর্ণনা ‘আমার সোনার বাংলার’ মতো কবি-কল্পনাতেই নির্বাসিত হবে।
টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির পরিকল্পনার খবরে বাংলাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল। গণতন্ত্রকামী সব মানুষ রোষে ফুঁসে উঠেছিল। লংমার্চ করে টিপাইমুখে যাওয়ার কথাও বলাবলি হচ্ছিল। সরকার তখন একদল আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্যকে প্রকৃত পরিসি'তি অবগত হওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল। উল্লেখ্য, এ প্রতিনিধিদলে একজনও প্রকৌশলী কিংবা বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। ভারতীয়রা তাদের স্বভাবসুলভ ছলাকলা দিয়ে তাদের ‘হাইকোর্ট দেখিয়েছে’। আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের প্রচুর খাতির-যত্ন করা হয়েছে, তারপর হেলিকপ্টারে করে তাদের উড়িয়ে এনে বলে দিয়েছে যে, টিপাইমুখে তারা বাঁধ তৈরি শুরু করেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাকি শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে এমন কোনো কাজ ভারত করবে না এবং বাঁধ তৈরির আগে বাংলাদেশকে জানানো হবে।
সে প্রতিশ্রুতিও এখন ভারতের অন্যান্য আশ্বাসের মতো ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই খবর প্রচারিত হয় যে, টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির জন্য মনিপুরের রাজ্য সরকার এবং একটি রাষ্ট্রায়ত্ত নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। যদ্দূর জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা দূরের কথা ঢাকার সরকারের অজ্ঞাতসারেই এ চুক্তি করা হয়েছে এবং টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। ভারত যে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে একটি নতজানু আজ্ঞাবহ ও আশ্রিত প্রশাসনিক সত্তা বলেই বিবেচনা করে এ হচ্ছে তার প্রমাণ।
বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে ভারতের এই আগ্রাসী উদ্যোগের কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না; বরং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মাহবুুবুর রহমান বলেছেন, টিপাইমুখে বাঁধ তৈরি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বলার কিছু নেই। শেখ হাসিনা সরকারের অনেক মন্ত্রীকেই অযোগ্য বলা অনুচিত হবে না। অন্যথায় একটি স্বাধীন দেশের সরকারের অন্য একটি দেশের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকা তারা সমর্থন করতে পারতেন না। আলহাজ মাহবুবুর রহমান স'ূলমতি না হলে বুঝতে পারতেন যে বাংলাদেশকে একটি অভিন্ন নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে ভারতের নেই। শেখ হাসিনা যদি একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপযোগী আত্মসম্মানবিশিষ্ট হতেন তাহলে তার অবশ্য কর্তব্য হতো এই অর্বাচীন মন্ত্রীকে তার দেশদ্রোহী উক্তির জন্য অবিলম্বে বরখাস্ত করা।
অপর দিকে ভারত বাংলাদেশের নদী এবং আশুগঞ্জ ও আখাউড়া স'লবন্দর যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছে। গত সপ্তাহেও ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী‘ নামের একখানি ভারতীয় জাহাজ আশুগঞ্জে মাল নামিয়েছে এবং ট্রাকে করে সেসব মাল আখাউড়া হয়ে আগরতলায় গেছে।

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম
অনেকগুলো বিষয় এখানে বিবেচ্য। প্রথমত, বাংলাদেশের মানুষকে বলা হয়েছিল যে, আগরতলায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য অত্যধিক ভারী ও বিরাটাকারের যন্ত্রপাতিই শুধু যাবে এ পথে। বাংলাদেশের সড়ক-সেতু অবকাঠামো এবং নদীস্রোতের বিপুল ক্ষতি করে সেসব যন্ত্রপাতি বহু আগেই ভারতে চলে গেছে। এখন বলা হচ্ছে ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ আরো কয়েক মাস এ পথে ভারতীয় মাল চলাচল হবে। কিসের এই পরীক্ষা? বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দলন করার পরীক্ষা? শুধু কি তাই? কনটেইনারগুলোতে কী মাল আগরতলা ও উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যগুলোতে যাচ্ছে সে খবর সংগ্রহের কোনো চেষ্টাই বাংলাদেশ সরকার করছে না। অনেকেই সন্দেহ করছেন উলফা প্রভৃতি এসব রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করার জন্য এবং অরুণাচলে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস'তি হিসেবে সমরশক্তি বৃদ্ধির জন্য এসব কনটেইনারে অস্ত্রশস্ত্র নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। গণচীন ও উত্তরপূর্ব ভারতের মুক্তিযোদ্ধারা এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের উদাসীনতাকে বৈরী আচরণ বলেই দেখবে।
ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আছে যে, অনুরূপ পরিসি'তিতে একটি দেশের গেরিলা যোদ্ধারা আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশের ভেতরে ঢুকে সে দেশের অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে। আসাম মনিপুর প্রভৃতি রাজ্যের বহু পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ এসব বাঁধ তৈরির প্রবল বিরোধী। তারা যে বাঁধ উড়িয়ে দেয়ার মতো নেগেটিভ কাজ করবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কর্তব্য হবে যেকোনো মূল্যে ভারতীয় চালান ও কনটেইনার বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলাচল বন্ধ করার মতো প্রতিবাদ করা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সারা দেশের মতৈক্য ছাড়া বাংলাদেশকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে অসমর্থ। নিজ রাজ্যের স্বার্থের দোহাই দিয়ে মমতা ব্যানার্জি তিস্তাচুক্তির বিরোধিতা করছেন। কিন' বাংলাদেশের স্বার্থের কথা কে বলবে? শেখ হাসিনার সরকার কি ভারতকে ট্রানিজট-করিডোর ইত্যাদি দেয়ার ব্যাপারে দেশের মানুষের মতামত যাচাই করেছেন? এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের কোনো চেষ্টা হয়েছে? অর্থাৎ বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও অস্ত্রের চালান যাচ্ছে দেশবাসীর আপত্তি সত্ত্বেও। এবং সে কারণে নৈতিক বিবেচনায় এ ট্রানজিট সম্পূর্ণ অবৈধ। বাংলাদেশের আমলারাও বলেছেন কোন আইনে কোন চুক্তিতে বিনা তদারকে এবং ফি না দিয়ে এসব চালান যাচ্ছে তারা জানেন না।
বাংলাদেশের মানুষের উচিত এ মুহূর্তে শপথ নেয়া যে, জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া আর একটি ট্রাকও আশুগঞ্জ থেকে ভারতে যেতে দেয়া উচিত হবে না। আর একটি ভারতীয় জাহাজকেও এসব অবৈধ চালান নিয়ে আশুগঞ্জে আসতে দেয়া হবে না। যেহেতু এসব চালান অবৈধ সেহেতু দেশের সাধারণ মানুষকে এসব চালানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি অস্ত্রবাহী জাহাজ খালাস করতে দেয়নি। বহু পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি তারা বিধ্বস্ত করেছে। সুতরাং অবৈধ ভারতীয় পণ্য ও অস্ত্রের চালান বন্ধ করার সামর্থ্য বাংলাদেশের মানুষের আছে। তাদের মনে রাখতে হবে এটা আরো একটি মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। এবারের যুদ্ধ হবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ।

চীনের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি অত্যাবশ্যক
খালেদা জিয়া তার সর্বশেষ সরকারের আমলে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল দু’টি এশীয় পরাশক্তি ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে একটা নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বনের লক্ষ্যে তথাকথিত ‘লুক ইস্ট’ মনোভাব গড়ে তোলা হবে। সমপ্রতি তিনি আবার প্রস্তাব দিয়েছেন যে, গণচীনকেও সার্কের সদস্যপদভুক্ত করতে হবে। বিএনপি নেত্রীর এ প্রস্তাব অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী। ভারত প্রতিবেশী ক্ষুদ্রতর দেশগুলোকে চোখ ঠেরে শাসিয়ে রাখছে। একটা দৃষ্টান্ত এই যে, সাম্প্রতিক মালদ্বীপ শীর্ষ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিবণ্টন সম্পর্কে আলোচনার বাংলাদেশী প্রস্তাবে ভারত বাধা দিয়েছে। অথচ নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এ বিষয়টির সাথে সংযুক্ত।
গণচীনকে অবশ্যই সার্কের সদস্য করতে হবে। এবার যখন নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসবে তখন সর্বাগ্রেই চীনের সাথে বাংলাদেশের এক প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে হবে, যাতে ভারত আর বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির সাহস না পায়। এবং আমি মনে করি যে, মিয়ানমারকেও সার্কের সদস্য করা খুবই জরুরি। গত কয়েক মাসে মিয়ানমারের সরকার গণতন্ত্রের পথে আশাপ্রদ উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে হয়। দেশটিকে সদস্যপদ দিয়ে সার্ক মিয়ানমারের বর্তমান নেতৃত্বকে পুরস্কৃত ও উৎসাহিত করতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট, বিবিসি বাংলা বিভাগের
সাবেক প্রধান
(লন্ডন, ২২.১১.১১)
serajurrahman@btinternet.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন