॥ সিরাজুর রহমান ॥
এখন বিশ্বায়নের যুগ চলছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিনিয়োগ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রহীতা দেশগুলো বিদেশী বিনিয়োগ চায় বিভিন্ন কারণে। বহু ক্ষেত্রে বিশেষ প্রযুক্তি, দক্ষতা কিংবা আর্থিক সামর্থ্য এদের থাকে না। তা ছাড়া এরা আশা করে বিদেশী বিনিয়োগ পেলে তাদের দেশে কর্মসংস্থানে সহায়তা হবে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
বিনিয়োগ সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যাপার। এখানে আবেগের প্রশ্নই আসে না। ভারতের বড় ব্যবসায়ী কোম্পানি সাহারা গ্রুপের মালিক সুব্রত রায় সাহারা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি পাঁচটি উপশহর নির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন। সুব্রত রায় বলেছেন, তার কয়েক প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল বিক্রমপুরে। সে সুবাদেই বাংলাদেশে এই উপশহরগুলো নির্মাণে তার এত আগ্রহ।
ব্যবসায় কিংবা শ্রমশিল্পের সাথে আবেগ সংযুক্ত হলে তার মধ্যে বহু বিপদ প্রচ্ছন্ন থাকতে বাধ্য। উপশহরগুলোর পরিকল্পনা আগে বাংলাদেশে প্রকাশ করা হয়নি, নির্মাতাদের কোনো তালিকাভুক্তি কিংবা টেন্ডার ডাকা হয়নি। সে অবস্থাতেই সুব্রত রায় এলেন এবং তার কোম্পানিকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেয়া হবে বলে আশ্বাস নিয়ে ফিরে গেলেন। অর্থাৎ আবেগের কথাটা আগেভাগে প্রচার করে সুব্রত রায় বহু লোকের, বিশেষ করে সরকারের ভেতরের বহু লোকের সমর্থন-সহানুভূতি সৃষ্টি করে তার অপসুযোগ নিয়েছেন।
বাংলাদেশে বহু শিল্প এখনো গড়ে ওঠেনি অথবা বিকশিত হয়নি। নির্মাণ শিল্প সেগুলোর মধ্যে পড়ে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। রাজধানীতে বহু সুরম্য অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, রাজধানী বহু গুণে সম্প্রসারিত হয়েছে, উপশহরও কতগুলো তৈরি হয়েছে। তেমনি বহু অট্টালিকা তৈরি হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ আরো বহু শহর-নগরে। এসব কাজই সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো, বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ-উপকরণ নির্মাণ কিংবা সরবরাহ করেছেন বাংলাদেশীরা। তাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে।
ভারতের বিবর্তনমুখী অর্থনৈতিক দর্শনের একটা মূল কথা গঠন কিংবা নির্মাণের কাজ যেখানেই হোক যথাসম্ভব ভারতীয় যন্ত্রপাতি, প্রকৌশলী ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে হবে। একটা দৃষ্টান্ত দেখা গেছে গত বছর। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে সরকারের সাথে বহুমুখী চুক্তি করে গিয়েছিলেন। চুক্তিতে কথা ছিল ভারতকে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী ও চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহারের অধিকার দেয়া হচ্ছে। সেসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চড়া সুদে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে ভারত, তবে উন্নয়নের সব কাজই করবেন ভারতীয় ঠিকাদারেরা ভারতের প্রকৌশলী, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ শ্রমশক্তি ব্যবহার করে।
সে চুক্তির বহু সমালোচনা হয়েছে বাংলাদেশের সব মহল থেকে। প্রধান কারণ, ভারতকে করিডোর ও ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে যেমন শুধু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়াই সার হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ হয়নি, তেমনি অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ থেকেও বাংলাদেশ সামান্যই উপকৃত হবে। আমাদের ভৌগোলিক সম্পদ ব্যবহার করে ভারত লাভবান হবে অথচ আমরা উপকৃত হবো নাÑ এমন আত্মঘাতী চিন্তা একমাত্র বর্তমান সরকারের মাথায় আসতে পারে।
জানা গেছে, সুব্রত রায়ের কোম্পানি সাহারাও ভারত থেকে যন্ত্রপাতি, উপকরণ, প্রকৌশলী ও দক্ষ শ্রমিক আমদানি করে উপশহরগুলো তৈরি করবে। খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশী অদক্ষ শ্রমিকই তারা ব্যবহার করবে। এই শত শত, হয়তো হাজার হাজার ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু বাংলাদেশে তারা আয়করও দেবে না। শুধু তা-ই নয়, উপশহরগুলো তৈরি হলে সেগুলো ক্রয় করার জন্য বাংলাদেশীদের ঋণ নিতে হবে। শোনা গেছে, সে ঋণও দেবে ভারতীয় ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ভারত গাছেরটা খাবে, তলারটাও কুড়োবে এবং তারপর সে বাবদ বখশিশও আদায় করে নেবে।
বিলাস
বিচিত্র নয় যে অর্থনীতিবিদ, চিন্তানায়ক ও নির্মাণশিল্পে সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকে সুব্রত রায়ের সাথে এই সমঝোতা চুক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছে। সব তথ্য প্রকাশ হলে ব্যাংক ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই খুব ক্রুদ্ধ হবেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি গ্রুপকে জ্বালানি খাতে বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। যত দূর জানা যায়, সে সম্বন্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন বলেই টেলিভিশন সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি ও সাগর সরোয়ারকে হত্যা করা হয়েছিল। সে হত্যার সুরাহা করার ব্যাপারে সরকারের অনীহা থেকে সাধারণ মানুষেরও বিশ্বাস জন্মেছে যে, দুর্নীতি ঢাকার লক্ষ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো মহল সে দু’টি অমূল্য প্রাণ বিনাশের জন্য দায়ী। সাহারা গ্রুপের সাথে সমঝোতা চুক্তিও করা হয়েছে একই রকম সন্দেহজনক এবং অস্বচ্ছভাবে।
সবাই জানেন বাংলাদেশের সাড়ে ছয় শ’ স্থাপনায় শেখ পরিবারের কোনো-না-কোনো সদস্যের নাম খোদিত হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি দেশ। জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের বিবরণ অনুযায়ী প্রতি বছর দুই লাখ একর করে জমি স্থায়ীভাবে কৃষির বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন দিন দৃশ্যমান ভবিষ্যতেই আসতে পারে যখন এ দেশে দাঁড়ানোর স্থানও থাকবে না। সেসব মানুষকে খাদ্য দিতে হবে। সৌভাগ্যবশত দেশটি পলিসমৃদ্ধ খুবই উর্বর এবং চাষবাসের উপযোগী সমতল। আমাদের কৃষক কঠোর পরিশ্রমী এবং নিবেদিতপ্রাণ। উদায়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তারা কোনোমতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু মাথাভারী প্রকল্প কার্যকর করতে যে হাজার হাজার একর আবাদি জমি স্থায়ীভাবে চাষের বাইরে চলে যাবে সে কথা একবারও ক্ষমতাসীনদের কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা এলাকার লাখ লাখ অধিবাসীর ক্রোধের সঞ্চার করেছিলেন। দিনের পর দিন আন্দোলন করে এবং সে আন্দোলনে প্রাণ দিয়ে আড়িয়াল বিলের অধিবাসীরা সরকারকে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। বিকল্প যে স্থানগুলোর কথা তখন শোনা গিয়েছিল, সেখানের মানুষও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, আড়িয়াল বিলের মতো আন্দোলন করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, সেসব সত্ত্বেও সরকারের মোহ ভঙ্গ হয়নি।
ঋণ পরিশোধ করবে নতুন প্রজন্মগুলো
পদ্মা সেতু তৈরি হয়নি কিন্তু তার মধ্যেই এত দুর্নীতি হয়েছে যে বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেই সেতুর জন্য অর্থ জোগান দিতে অস্বীকার করেছে। তারা সবাই প্রকারান্তরে বর্তমান সরকারকে চোর বলে রায় দিয়েছে, দুর্নীতিবাজদের যথোচিত শাস্তির দাবি করেছে। কিন্তু তেমন উদ্দেশ্য সরকারের আছে বলে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশের মানুষ মনে করে সেসব দুর্নীতি সরকারের উঁচু স্তরে ঘটেছে বলেই দায়ী ব্যক্তিদের সাজা দিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে সস্তা ঋণ ফিরে পেতে সরকার চেষ্টা করছে না। তার পরিবর্তে তারা বহু গুণ বেশি সুদে বিকল্প অর্থায়ন সংগ্রহ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সরকার বেশি দিন গদিতে থাকবে না, কিন্তু সে উচ্চ সুদের হারের ঋণ বাংলাদেশের মানুষকে চক্রবৃদ্ধি হারে পরিশোধ করতে হবে যুগ যুগ ধরে। প্রধানমন্ত্রীর অবাস্তব স্বপ্নের জন্য বংশানুক্রমে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং হয়তো নতুন রাজধানী নির্মাণেও যে দুর্নীতির ‘বঙ্গোপসাগর চুরি’ ঘটবে সে সম্বন্ধে কারো কোনো সন্দেহ নেই।
ব্রিটেনে দুটো অবকাঠামো প্রকল্প বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিথরো সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর। পাঁচটি টার্মিনাল এবং দু’টি রানওয়ে এখন যথেষ্ট নয়। গ্যাটউইক, স্ট্যানস্টেড ও লুটন এবং সর্বশেষ সাউথে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো উপচে পড়া যাত্রী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বিগত লেবার দলীয় সরকার হিথরোতে একটি এবং গ্যাটউইক কিংবা স্ট্যানস্টেডে আরো একটি রানওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। বস্তুত হিথরোর রানওয়েটির জন্য জমি অধিগ্রহণও করা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যবান কৃষিজমি এবং পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে।
দুই বছর আগের সাধারণ নির্বাচনে টোরি পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হিথরোর তৃতীয় রানওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা তারা বাতিল করবে। সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে টোরিরা এখন একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। হিথরো রানওয়ের বিকল্প সন্ধানে তারা জটিল সমস্যায় পড়েছে। টোরিরা ঘোষণা করেছে, তারা লন্ডন আর বার্মিংহামের মধ্যে দুই শতাধিক মাইল গতিবেগের হাইস্পিড রেল চালু করবে। এতে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি আবাদের বাইরে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিত্ত ও প্রভাবশালী ভূস্বামীরা বিরোধিতা ঘোষণা করেছেন। সরকারের সমস্যা এই যে, ভূস্বামীরা সাধারণত টোরি দলের সমর্থক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যরা সবাই টোরি দলের। এই হাইস্পিড রেল এখন শিকেয় ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঢাকার বর্তমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির ‘ক্যাপাসিটির’ (যাত্রী চলাচল ক্ষমতা) ৪০ শতাংশেরও কম এখন ব্যবহার হচ্ছে। দৃশ্যমান ভবিষ্যতে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাহিদা বাংলাদেশে হবে না। আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশের কোনো এলাকার মানুষই তাদের চাষের জমিতে বিমানবন্দর তৈরি করতে দেবে না। এখন আবার সাহারা গ্রুপকে পাঁচটি উপশহর তৈরি করতে দিচ্ছে সরকার। কোথায় তৈরি হবে সেসব উপশহর? কোন ভাগ্যহীন কৃষক ভূসম্পত্তি হারিয়ে পথে বসবেন?
অসাধু উদ্দেশ্যের দুর্গন্ধ
সরকারের আয়োজনের পেছনে অসাধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। সুব্রত রায় সাহারার মতো পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বেশির ভাগই দাবি করেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা ঢাকার বিক্রমপুর কিংবা বরিশালের জমিদার ছিলেন। কলকাতায় সামাজিক বৈঠকে এমন দাবি আমিও অজস্রবার শুনেছি। আমাদের এক বন্ধুর মা একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা, মরার আগে ভাগ্যকুলে আমার মামার বাড়িটি কি একবার দেখতে পাবো?’ বৃদ্ধা কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। ভাগ্যকুল দেখা তার ভাগ্যে জোটেনি।
অনুপস্থিত জমিদারেরা কলকাতায় বসে ব্যবসায়-বাণিজ্য কিংবা রাজনীতি করতেন। বিধানসভা নির্বাচনে তারা পূর্ববাংলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় তাদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের অথবা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের মুসলমানদের সম্পত্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের সম্পত্তি তাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। দেশভাগের সময়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর খুনখারাবির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাবকবালা বা অন্য কোনো বৈধ দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের নূরুল আমিন সরকার ১৯৫০ সালে আইন করে জমিদারি প্রথা বাতিল করে।
এখন আবার পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভারতের হিন্দুদের বাংলাদেশে ছেড়ে আসা সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য জরুরিভাবে আবেদন করতে বলেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। তাদের খুশি করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখছে না বর্তমান সরকার। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জ্ঞাত চোর-ডাকাত কিংবা খুনি হলেও হিন্দুরা তাদেরই ভোট দেবে, কেননা তারা জানে যে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাদের স্বার্থের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হবে, বিশেষ সুবিধা পাবে তারা।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে কয়েক লাখ ভারতীয় হিন্দু বাংলাদেশে এসেছে, বৈধ কিংবা অবৈধভাবে তারা বাংলাদেশে চাকরি কিংবা ব্যবসায়ও করছে। অনুমান করা হয়েছে, একমাত্র বৃহত্তর ঢাকা ও শিল্পাঞ্চলেই তিন লাখের বেশি ভারতীয় নাগরিক আছে। অনেকেই সন্দেহ করেন তাদের কেউ কেউ পূর্বপুরুষদের সম্পত্তির ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লা পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। সরকার আশা করছে, ভারতের হিন্দুরা চার-পাঁচ কিংবা সাতপুরুষ আগের সম্পত্তি দখল করতে পারলে তারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকের কলেবরও বৃদ্ধি পাবে।
সৎ বিশ্বাসে যারা সাতচল্লিশে হিন্দুদের সাথে সম্পত্তি বিনিময় করেছিল তারা এখন মহাবিপদে পড়তে পারে। পঁয়ষট্টি বছর ধরে ভোগ করা সম্পত্তি হিন্দুদের ফিরিয়ে দিতে হয়তো তাদের বাধ্য করা হবে। অথচ ভারতে ফেলে আসা সম্পত্তি তারা ফিরে পাবে না, কেননা তাতে বর্তমান সরকারের আগ্রহ নেই। সরকারের এই উদ্যোগটি সাধারণভাবেই দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করবে এবং তাতে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেবে। সে উদ্যোগ সরকারেরই গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধবে।
লন্ডন, ০৫.০৬.১২
serajurrahman34@gmail.com
এখন বিশ্বায়নের যুগ চলছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিনিয়োগ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রহীতা দেশগুলো বিদেশী বিনিয়োগ চায় বিভিন্ন কারণে। বহু ক্ষেত্রে বিশেষ প্রযুক্তি, দক্ষতা কিংবা আর্থিক সামর্থ্য এদের থাকে না। তা ছাড়া এরা আশা করে বিদেশী বিনিয়োগ পেলে তাদের দেশে কর্মসংস্থানে সহায়তা হবে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
বিনিয়োগ সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যাপার। এখানে আবেগের প্রশ্নই আসে না। ভারতের বড় ব্যবসায়ী কোম্পানি সাহারা গ্রুপের মালিক সুব্রত রায় সাহারা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি পাঁচটি উপশহর নির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন। সুব্রত রায় বলেছেন, তার কয়েক প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল বিক্রমপুরে। সে সুবাদেই বাংলাদেশে এই উপশহরগুলো নির্মাণে তার এত আগ্রহ।
ব্যবসায় কিংবা শ্রমশিল্পের সাথে আবেগ সংযুক্ত হলে তার মধ্যে বহু বিপদ প্রচ্ছন্ন থাকতে বাধ্য। উপশহরগুলোর পরিকল্পনা আগে বাংলাদেশে প্রকাশ করা হয়নি, নির্মাতাদের কোনো তালিকাভুক্তি কিংবা টেন্ডার ডাকা হয়নি। সে অবস্থাতেই সুব্রত রায় এলেন এবং তার কোম্পানিকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেয়া হবে বলে আশ্বাস নিয়ে ফিরে গেলেন। অর্থাৎ আবেগের কথাটা আগেভাগে প্রচার করে সুব্রত রায় বহু লোকের, বিশেষ করে সরকারের ভেতরের বহু লোকের সমর্থন-সহানুভূতি সৃষ্টি করে তার অপসুযোগ নিয়েছেন।
বাংলাদেশে বহু শিল্প এখনো গড়ে ওঠেনি অথবা বিকশিত হয়নি। নির্মাণ শিল্প সেগুলোর মধ্যে পড়ে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। রাজধানীতে বহু সুরম্য অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, রাজধানী বহু গুণে সম্প্রসারিত হয়েছে, উপশহরও কতগুলো তৈরি হয়েছে। তেমনি বহু অট্টালিকা তৈরি হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ আরো বহু শহর-নগরে। এসব কাজই সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো, বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ-উপকরণ নির্মাণ কিংবা সরবরাহ করেছেন বাংলাদেশীরা। তাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে।
ভারতের বিবর্তনমুখী অর্থনৈতিক দর্শনের একটা মূল কথা গঠন কিংবা নির্মাণের কাজ যেখানেই হোক যথাসম্ভব ভারতীয় যন্ত্রপাতি, প্রকৌশলী ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে হবে। একটা দৃষ্টান্ত দেখা গেছে গত বছর। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে সরকারের সাথে বহুমুখী চুক্তি করে গিয়েছিলেন। চুক্তিতে কথা ছিল ভারতকে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী ও চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহারের অধিকার দেয়া হচ্ছে। সেসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চড়া সুদে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে ভারত, তবে উন্নয়নের সব কাজই করবেন ভারতীয় ঠিকাদারেরা ভারতের প্রকৌশলী, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ শ্রমশক্তি ব্যবহার করে।
সে চুক্তির বহু সমালোচনা হয়েছে বাংলাদেশের সব মহল থেকে। প্রধান কারণ, ভারতকে করিডোর ও ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে যেমন শুধু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়াই সার হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ হয়নি, তেমনি অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ থেকেও বাংলাদেশ সামান্যই উপকৃত হবে। আমাদের ভৌগোলিক সম্পদ ব্যবহার করে ভারত লাভবান হবে অথচ আমরা উপকৃত হবো নাÑ এমন আত্মঘাতী চিন্তা একমাত্র বর্তমান সরকারের মাথায় আসতে পারে।
জানা গেছে, সুব্রত রায়ের কোম্পানি সাহারাও ভারত থেকে যন্ত্রপাতি, উপকরণ, প্রকৌশলী ও দক্ষ শ্রমিক আমদানি করে উপশহরগুলো তৈরি করবে। খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশী অদক্ষ শ্রমিকই তারা ব্যবহার করবে। এই শত শত, হয়তো হাজার হাজার ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু বাংলাদেশে তারা আয়করও দেবে না। শুধু তা-ই নয়, উপশহরগুলো তৈরি হলে সেগুলো ক্রয় করার জন্য বাংলাদেশীদের ঋণ নিতে হবে। শোনা গেছে, সে ঋণও দেবে ভারতীয় ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ভারত গাছেরটা খাবে, তলারটাও কুড়োবে এবং তারপর সে বাবদ বখশিশও আদায় করে নেবে।
বিলাস
বিচিত্র নয় যে অর্থনীতিবিদ, চিন্তানায়ক ও নির্মাণশিল্পে সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকে সুব্রত রায়ের সাথে এই সমঝোতা চুক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছে। সব তথ্য প্রকাশ হলে ব্যাংক ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই খুব ক্রুদ্ধ হবেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি গ্রুপকে জ্বালানি খাতে বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। যত দূর জানা যায়, সে সম্বন্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন বলেই টেলিভিশন সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি ও সাগর সরোয়ারকে হত্যা করা হয়েছিল। সে হত্যার সুরাহা করার ব্যাপারে সরকারের অনীহা থেকে সাধারণ মানুষেরও বিশ্বাস জন্মেছে যে, দুর্নীতি ঢাকার লক্ষ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো মহল সে দু’টি অমূল্য প্রাণ বিনাশের জন্য দায়ী। সাহারা গ্রুপের সাথে সমঝোতা চুক্তিও করা হয়েছে একই রকম সন্দেহজনক এবং অস্বচ্ছভাবে।
সবাই জানেন বাংলাদেশের সাড়ে ছয় শ’ স্থাপনায় শেখ পরিবারের কোনো-না-কোনো সদস্যের নাম খোদিত হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি দেশ। জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের বিবরণ অনুযায়ী প্রতি বছর দুই লাখ একর করে জমি স্থায়ীভাবে কৃষির বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন দিন দৃশ্যমান ভবিষ্যতেই আসতে পারে যখন এ দেশে দাঁড়ানোর স্থানও থাকবে না। সেসব মানুষকে খাদ্য দিতে হবে। সৌভাগ্যবশত দেশটি পলিসমৃদ্ধ খুবই উর্বর এবং চাষবাসের উপযোগী সমতল। আমাদের কৃষক কঠোর পরিশ্রমী এবং নিবেদিতপ্রাণ। উদায়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তারা কোনোমতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু মাথাভারী প্রকল্প কার্যকর করতে যে হাজার হাজার একর আবাদি জমি স্থায়ীভাবে চাষের বাইরে চলে যাবে সে কথা একবারও ক্ষমতাসীনদের কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা এলাকার লাখ লাখ অধিবাসীর ক্রোধের সঞ্চার করেছিলেন। দিনের পর দিন আন্দোলন করে এবং সে আন্দোলনে প্রাণ দিয়ে আড়িয়াল বিলের অধিবাসীরা সরকারকে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। বিকল্প যে স্থানগুলোর কথা তখন শোনা গিয়েছিল, সেখানের মানুষও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, আড়িয়াল বিলের মতো আন্দোলন করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, সেসব সত্ত্বেও সরকারের মোহ ভঙ্গ হয়নি।
ঋণ পরিশোধ করবে নতুন প্রজন্মগুলো
পদ্মা সেতু তৈরি হয়নি কিন্তু তার মধ্যেই এত দুর্নীতি হয়েছে যে বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেই সেতুর জন্য অর্থ জোগান দিতে অস্বীকার করেছে। তারা সবাই প্রকারান্তরে বর্তমান সরকারকে চোর বলে রায় দিয়েছে, দুর্নীতিবাজদের যথোচিত শাস্তির দাবি করেছে। কিন্তু তেমন উদ্দেশ্য সরকারের আছে বলে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশের মানুষ মনে করে সেসব দুর্নীতি সরকারের উঁচু স্তরে ঘটেছে বলেই দায়ী ব্যক্তিদের সাজা দিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে সস্তা ঋণ ফিরে পেতে সরকার চেষ্টা করছে না। তার পরিবর্তে তারা বহু গুণ বেশি সুদে বিকল্প অর্থায়ন সংগ্রহ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সরকার বেশি দিন গদিতে থাকবে না, কিন্তু সে উচ্চ সুদের হারের ঋণ বাংলাদেশের মানুষকে চক্রবৃদ্ধি হারে পরিশোধ করতে হবে যুগ যুগ ধরে। প্রধানমন্ত্রীর অবাস্তব স্বপ্নের জন্য বংশানুক্রমে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং হয়তো নতুন রাজধানী নির্মাণেও যে দুর্নীতির ‘বঙ্গোপসাগর চুরি’ ঘটবে সে সম্বন্ধে কারো কোনো সন্দেহ নেই।
ব্রিটেনে দুটো অবকাঠামো প্রকল্প বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিথরো সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর। পাঁচটি টার্মিনাল এবং দু’টি রানওয়ে এখন যথেষ্ট নয়। গ্যাটউইক, স্ট্যানস্টেড ও লুটন এবং সর্বশেষ সাউথে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো উপচে পড়া যাত্রী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বিগত লেবার দলীয় সরকার হিথরোতে একটি এবং গ্যাটউইক কিংবা স্ট্যানস্টেডে আরো একটি রানওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। বস্তুত হিথরোর রানওয়েটির জন্য জমি অধিগ্রহণও করা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যবান কৃষিজমি এবং পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে।
দুই বছর আগের সাধারণ নির্বাচনে টোরি পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হিথরোর তৃতীয় রানওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা তারা বাতিল করবে। সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে টোরিরা এখন একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। হিথরো রানওয়ের বিকল্প সন্ধানে তারা জটিল সমস্যায় পড়েছে। টোরিরা ঘোষণা করেছে, তারা লন্ডন আর বার্মিংহামের মধ্যে দুই শতাধিক মাইল গতিবেগের হাইস্পিড রেল চালু করবে। এতে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি আবাদের বাইরে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিত্ত ও প্রভাবশালী ভূস্বামীরা বিরোধিতা ঘোষণা করেছেন। সরকারের সমস্যা এই যে, ভূস্বামীরা সাধারণত টোরি দলের সমর্থক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যরা সবাই টোরি দলের। এই হাইস্পিড রেল এখন শিকেয় ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঢাকার বর্তমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির ‘ক্যাপাসিটির’ (যাত্রী চলাচল ক্ষমতা) ৪০ শতাংশেরও কম এখন ব্যবহার হচ্ছে। দৃশ্যমান ভবিষ্যতে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাহিদা বাংলাদেশে হবে না। আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশের কোনো এলাকার মানুষই তাদের চাষের জমিতে বিমানবন্দর তৈরি করতে দেবে না। এখন আবার সাহারা গ্রুপকে পাঁচটি উপশহর তৈরি করতে দিচ্ছে সরকার। কোথায় তৈরি হবে সেসব উপশহর? কোন ভাগ্যহীন কৃষক ভূসম্পত্তি হারিয়ে পথে বসবেন?
অসাধু উদ্দেশ্যের দুর্গন্ধ
সরকারের আয়োজনের পেছনে অসাধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। সুব্রত রায় সাহারার মতো পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বেশির ভাগই দাবি করেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা ঢাকার বিক্রমপুর কিংবা বরিশালের জমিদার ছিলেন। কলকাতায় সামাজিক বৈঠকে এমন দাবি আমিও অজস্রবার শুনেছি। আমাদের এক বন্ধুর মা একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা, মরার আগে ভাগ্যকুলে আমার মামার বাড়িটি কি একবার দেখতে পাবো?’ বৃদ্ধা কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। ভাগ্যকুল দেখা তার ভাগ্যে জোটেনি।
অনুপস্থিত জমিদারেরা কলকাতায় বসে ব্যবসায়-বাণিজ্য কিংবা রাজনীতি করতেন। বিধানসভা নির্বাচনে তারা পূর্ববাংলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় তাদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের অথবা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের মুসলমানদের সম্পত্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের সম্পত্তি তাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। দেশভাগের সময়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর খুনখারাবির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাবকবালা বা অন্য কোনো বৈধ দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের নূরুল আমিন সরকার ১৯৫০ সালে আইন করে জমিদারি প্রথা বাতিল করে।
এখন আবার পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভারতের হিন্দুদের বাংলাদেশে ছেড়ে আসা সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য জরুরিভাবে আবেদন করতে বলেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। তাদের খুশি করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখছে না বর্তমান সরকার। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জ্ঞাত চোর-ডাকাত কিংবা খুনি হলেও হিন্দুরা তাদেরই ভোট দেবে, কেননা তারা জানে যে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাদের স্বার্থের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হবে, বিশেষ সুবিধা পাবে তারা।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে কয়েক লাখ ভারতীয় হিন্দু বাংলাদেশে এসেছে, বৈধ কিংবা অবৈধভাবে তারা বাংলাদেশে চাকরি কিংবা ব্যবসায়ও করছে। অনুমান করা হয়েছে, একমাত্র বৃহত্তর ঢাকা ও শিল্পাঞ্চলেই তিন লাখের বেশি ভারতীয় নাগরিক আছে। অনেকেই সন্দেহ করেন তাদের কেউ কেউ পূর্বপুরুষদের সম্পত্তির ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লা পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। সরকার আশা করছে, ভারতের হিন্দুরা চার-পাঁচ কিংবা সাতপুরুষ আগের সম্পত্তি দখল করতে পারলে তারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকের কলেবরও বৃদ্ধি পাবে।
সৎ বিশ্বাসে যারা সাতচল্লিশে হিন্দুদের সাথে সম্পত্তি বিনিময় করেছিল তারা এখন মহাবিপদে পড়তে পারে। পঁয়ষট্টি বছর ধরে ভোগ করা সম্পত্তি হিন্দুদের ফিরিয়ে দিতে হয়তো তাদের বাধ্য করা হবে। অথচ ভারতে ফেলে আসা সম্পত্তি তারা ফিরে পাবে না, কেননা তাতে বর্তমান সরকারের আগ্রহ নেই। সরকারের এই উদ্যোগটি সাধারণভাবেই দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করবে এবং তাতে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেবে। সে উদ্যোগ সরকারেরই গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধবে।
লন্ডন, ০৫.০৬.১২
serajurrahman34@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন