সিরাজুর রহমান
দেশটাকে ঠেলতে ঠেলতে আওয়ামী লীগ সরকার একেবারে অতল গহ্বরের ধারে নিয়ে এসেছে। মাত্র দুটো ব্যাপারই ঘটতে পারে এখন : দেশ যদি অতলে তলিয়ে যায়, শ্মশান-নৃত্যের মতো করে আওয়ামী লীগওয়ালারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার চালাবে। আর দেশ যদি টিকে থাকে, তলিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশকে এখন এই দুই সম্ভাবনার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।
ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল পঁচাত্তরে। সংসদে মাত্র তিন মিনিটের আলোচনার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। সবগুলো রাজনৈতিক দলকে তিনি নিষিদ্ধ করেন, এমনকি আওয়ামী লীগকেও। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন চারখানি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। প্রস্তুতি হিসেবে আগের বছরেই জরুরি ক্ষমতা আইনের বলে অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এসবেরও পটভূমি ছিল রক্ষী বাহিনীর হাতে ৪০ হাজার খুন, সর্বস্তরে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যেও অবাধ দুর্নীতি, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু।
একই পটভূমি এখন বাংলাদেশেও চলছে। মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ যদি দাবি করেন যে, তিনি দুর্নীতি করছেন না তাহলে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত কর্ণবিদারী অট্টহাসি শুরু হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সরকার সবাই এখন বেপরোয়া দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তাগিদ দিচ্ছে। র্যাব এখন রক্ষীবাহিনী হয়ে গেছে। তারা হাসিনার ক্যাডার আর আওয়ামী লীগের ঘাতকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। খুনের সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম করা। সাংবাদিকদের হত্যা, চ্যানেল-ওয়ান বন্ধ, একুশে টেলিভিশন, ইসলামী চ্যানেল প্রভৃতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার মিডিয়া জগতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে ৯ মাস জেল খাটানো হয়েছে। শুনেছি এখনও ৫৩টি সাজানো মামলা ঝুলে আছে তার বিরুদ্ধে, প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। সরকার ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদকে নিউইয়র্ক দূতাবাসে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে আর বাংলাদেশে একজন বিচারপতি গায়ে পড়ে তার বই ‘দেয়াল’ প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এখন আর কোনো নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। অর্থনৈতিক সঙ্কট, বেসামাল দ্রব্যমূল্য এবং বিদ্যুত্ ও পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত।
পঁচাত্তরের মতোই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে। এ সরকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, বরং ঐতিহাসিক ভুলগুলোর অন্ধ অনুকরণের পথই তারা বেছে নিয়েছে। হত্যা-নির্যাতন, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ এবং জেল-জুলুমের পথ ধরেছে সরকার। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব করে তোলার বহু আয়োজন তারা এরই মধ্যে করেছে। দেশের মানুষ ভয় করছে আরও একবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন শেখ পরিবারের এক সদস্য। সে জন্যই তারা গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য, র্যাবের হাতে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে মুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সাজানো অভিযোগ আর সাজানো মামলায় গ্রেফতার হওয়া বিএনপি ও ১৮ দলের নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা প্রত্যাহার করার দাবি।
মিথ্যা অভিযোগ সাজানো মামলা
বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, পূর্ববর্তী এক হরতালে তারা সচিবালয়ে পাঁচটি ককটেল বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন অথবা করিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে সড়কে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছিলেন কিংবা লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬ মে তারা জামিনের জন্য নিম্ন আদালতে সশরীরে হাজির হলে জামিন না দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
অনেকগুলো প্রশ্ন গিজগিজ করছে এখানে। নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অজুহাত সৃষ্টির জন্য উস্কানিদানের কৌশল ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। বহু দেশ কালে কালে যুগে যুগে সে কৌশল ব্যবহার করেছে—এমনকি ভারত শাসনের সময় ব্রিটিশরাও। সে কৌশল যে আওয়ামী লীগ জানে না সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। যেভাবে সচিবালয়ে ককটেল ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ের রাজপথে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা দুটোকে ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে সন্দেহ প্রবল হয় যে, সম্মিলিত বিরোধী ১৮ দলের গণতন্ত্রের আন্দোলন দলনের লক্ষ্যে ঘটনা দুটো শাসক দলের ভেতর থেকেই সাজানো হয়েছিল।
আন্দোলন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠলে এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চরমে উঠলে কর্মীরা সময় সময় শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু অঘটন ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেসব ঘটনায় প্রায় কখনোই শীর্ষ নেতাদের সম্মতি থাকে না। গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় জনসাধারণের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে। রাজনীতি করে যাঁরা শীর্ষ স্তরে উন্নীত হন তারা অবশ্যই জানেন, উচ্ছৃঙ্খল এবং বিশৃঙ্খল আচরণ জনসাধারণ পছন্দ করে না। কিছুকাল ধরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবং পরে ১৮ দলের ঐক্যজোট হরতাল প্রভৃতি কর্মসূচি দিতে ইতস্ত করেছে এবং তাতে করে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে; খালেদা জিয়া প্রমুখ নেতারা বারংবার বলেছেন, হরতাল দিয়ে সর্বসাধারণের অসুবিধার কারণ ঘটাতে তারা চান না, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র-লিপ্সু নির্যাতক সরকার তাদের জন্য উপায়ান্তর রাখেনি।
১৮টি বিভিন্ন দলের ৩৩ জন শীর্ষ নেতা নিজেরা সচিবালয়ে বোমা ফাটিয়েছেন এবং প্রায় একই সময়ে তিন-চার মাইল দূরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছেন, অথবা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে কর্মীদের ডেকে এসব ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন, উন্মাদ না হলে এমন দাবি কেউ করতে পারে না।
‘চোরেরও ধর্ম থাকে’, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ ইত্যাদি বহু প্রবচন সকলেরই জানা আছে। রাজনীতি একটা সম্মানজনক পেশা। অন্তত তেমনই হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা রাজনীতি করেন। বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি অন্তত পেশাগত সৌজন্য দেখানো তাদের কর্তব্য ছিল। কারাবন্দি নেতাদের প্রতি যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, যেভাবে তাদের ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে একই কারাগারে নেয়া হয়েছে তা থেকে ধরে নিতেই হবে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এ সরকারের সবাই উন্মাদ হয়ে গেছেন। তাদের ভরাডুবি যে অনিবার্য সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের আচরণগুলো এখন লাঠিপেটা খাওয়া সাপের মরণ-কামড় বলেই মনে হয়।
লোভনীয় সম্ভাবনা
কোনো দলের সাধারণ কর্মী কিংবা সমর্থকের কোনো দুষ্কর্মের জন্য যদি দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির সৃষ্টি করা হয়, তাহলে অত্যন্ত লোভনীয় একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী পাঁচ বছর এবং বর্তমানের প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তার ক্যাডার, দলীয় কর্মী এবং দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাব যে হাজার হাজার হত্যা, ধর্ষণ, ভূমিগ্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার সন্ত্রাস, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি দুষ্কর্ম করেছে সে জন্য শেখ হাসিনাকে ‘হুকুমের আসামি’ করে কোনো সময় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মামলা রুজু করা স্বাভাবিক হবে। সরকারের সদস্যদের মনে রাখতে হবে যে, দিন কারও সমানে যায় না। দিন পাল্টালে তারা যে ধরনের ব্যবহার আশা করবেন ঠিক সেভাবেই বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি তাদের আচরণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন যে, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি গদিতে থাকতে চান। তার মন্ত্রিরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সে আভাসই দিয়েছেন। মুক্ত নির্বাচন অসম্ভব করে দিয়ে তিনি ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের স্বৈরশাসকদের এবং বাংলাদেশে তার পিতার মতো স্বৈরশাসক হতে চান। কিন্তু একটা কথা তিনি ভুলে যাচ্ছেন। তিনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এটা বিংশ নয় একবিংশ শতাব্দী এবং বাংলাদেশের মানুষ ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যবাসী নয়।
তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের লক্ষ্যে। হাসিনার পিতার স্বৈরাচার তারা সহ্য করেনি। প্রকৃত হত্যা যদিও জনকয়েক সৈনিক করেছে কিন্তু শেখ মুজিবের পতনের পেছনে বাংলাদেশের মানুষের অন্তত মৌন সম্মতি ছিল। হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার পিতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি এবং সে জন্য বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। হাসিনার স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার বাসনা এ দেশের মানুষ মেনে নেবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে তিনি এ কারণ-সে কারণ দেখিয়ে, বিচারের দোহাই দিয়ে এবং না দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জেলে পুরেছেন। ভারত ও মার্কিনিদের মনোরঞ্জনের আশায় ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’দের ধরপাকড় চালিয়ে গেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশজোড়া তার স্বৈরতন্ত্রী বাসনার বিরোধীদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। প্রধান বিরোধী বিএনপি দলের উচিত ছিল তখন থেকেই এই পাইকারী ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। অপেক্ষাকৃত ছোট গণতান্ত্রিক দলগুলোরও উচিত ছিল বিএনপির ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সেটা তারা করেনি। সে জন্যই ফ্যাসিস্ট সরকার এখন তাদের সবার বিরুদ্ধে হাত বাড়াতে সাহস পাচ্ছে। গত ১৬ মে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ এং ১৮ জোটেরও কিছু কিছু নেতাকে জেলে পাঠিয়ে সে প্রমাণই দিয়েছে সরকার।
বিএনপি কোন পথে?
বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট কী করবে এখন? বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে একটা মহল এতদিন ‘সাংবিধানিক আন্দোলনের’ কথা বলে এই নির্যাতক স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। আমি নিজেও কয়েকটি কলামে বিরোধী দলকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম—এ সরকারকে যতই সময় দেয়া হবে ততই তারা বিরোধী দলের আন্দোলন আর গণতন্ত্রের পথকে অসম্ভব করে তুলবে। সরকার কি বিএনপিকে গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেনি? তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব, ক্যাডার ও গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে রক্তারক্তি ঘটায়নি সরকার? প্রাণহানি করেনি? বিএনপির প্রধান কার্যালয় কি ফ্যাসিস্ট কায়দায় কাঁটাতার আর পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে রাখেনি?
তাছাড়া কোন সংবিধান অনুযায়ী আন্দোলন করবেন তারা? যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা দলীয়কৃত পুলিশ, আমলা ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় আরও একটি সাজানো নির্বাচন করে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চায়? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করতে চায়?
বিএনপি এবং ১৮ দলের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল কিন্তু শাসক দলের ভেতরের উস্কানিদাতাদের দিয়ে সচিবালয়ে ককটেল ফাটিয়ে এবং তেজগাঁও এয়ারপোর্ট রোডে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের অজুহাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। একইভাবে যদি আন্দোলন-বিমুখদের ধরপাকড় শুরু হয় তাহলে তাদের হয়ে প্রতিবাদ করতে কারা এগিয়ে আসবে? আমার আগাগোড়া বিশ্বাস ছিল এই পিছুটান দেয়া ব্যক্তিরা পরোক্ষে হাসিনার বাকশালী পরিকল্পনাতেই মদদ দিচ্ছেন। লোকে সন্দেহ করছে তাদের কারও কারও মধ্যে বিদেশী প্রভাব সক্রিয় থাকতে পারে।
১৬ মে জেলে পাঠানো ৩৩ জন ছাড়াও রিজভী আহমেদ, খায়রুল কবির খোকনসহ আরও কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত ক’দিনে। ঢাকার মিডিয়ায় খবর ছাপা না হলেও জেলা পর্যায়ে বহু নেতাকর্মীকে ধরপাকড় চলছে। অচিহ্নিত গাড়িতে সাদা পোশাক পরিহিত লোকেরা এখন দেশব্যাপী ধরপাকড় চালাচ্ছে। এখন আর সন্দেহ নেই যে, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে বিরোধী দল ও জোটকে নেতৃত্বশূন্য এবং কর্মীবিহীন করে গণতন্ত্রের আন্দোলন নস্যাত্ করে দেয়া। আরও দুটো মতলব আছে তাদের। তারা আশা করছে, তাদের ইচ্ছা পূরণের আদালত বিরোধী দলের বহু নেতাকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে। নেতারা জেলে পচতে থাকলে নির্বাচন দিয়ে তারা জয়ী হতে পারবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করে।
‘কারার ওই লৌহ কপাট’
নেতাদের জেলে নেয়া হয়েছে সেটা এমন কিছু হতাশ হওয়ার ব্যাপার নয়। গান্ধী-নেহরুরা জেলে গিয়েই ইংরেজদের তাড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশেও বহু অন্যায় জনসাধারণ আন্দোলন করে ঠেকিয়েছে। আন্দোলন করে তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, বলতে গেলে দেশকে স্বাধীনও করেছে। এসব আন্দোলনে অজস্র মানুষ গ্রেফতার হয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন। শেখ হাসিনার পিতা আগরতলায় গিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। পাকিস্তানিরা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছিল। তাকে জেলে পোরা হলে দেশের মানুষ আন্দোলন করে তাকে মুক্ত করেছিল। এবারে আটক নেতাদের কেউ কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেননি। তারা শুধু জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তারা সবাই দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রকামী। দেশে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। কথা হচ্ছে বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারা আন্দোলন করে তাদের বন্দি নেতাদের মুক্ত করতে এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে পারবেন কি-না।
অথচ দেশের মানুষ প্রস্তুত আছে। নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনেকগুলো জেলাতেই কর্মীরা গত ১৭ মে হরতাল ডেকেছিলেন। তারপরই শুধু ঢাকা থেকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান হরতালের ডাক দেন। তা সত্ত্বেও সেদিনের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল খুবই সফল হয়েছিল। অর্থাত্ কর্মীদের মধ্যে ইচ্ছা ও উদ্দীপনার অভাব নেই। জনসাধারণ অতীতে বহুবার দেশের ডাকে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, একাত্তরে দেশ স্বাধীন করতে তিন লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের মধ্যে পিছুটানওয়ালাদের উত্পাত।
‘কুইক-কুইক-স্লো’ মনোভাব নিয়ে কোনো আন্দোলনই সফল হতে পারে না। ২০০৬ সালে ‘কুইক মার্চ! হল্ট!’ মার্কা আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ১/১১ সৃষ্টি করেনি। তারা লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ চালানো অসম্ভব করে দিয়েছিল। আন্দোলন সফল করতে হলে বিএনপি এবং ১৮ দলের জোটের নেতাদের সে পথই ধরতে হবে। প্রথম কাতারের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সারির নেতারা তো আছেনই। তারা গ্রেফতার হলে তৃতীয় কাতারের নেতারা এগিয়ে আসবেন। কিন্তু এ অভিযাত্রা তাদের সফল করতেই হবে। তারা সবাই জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ব্যর্থ হলে জাতি কখনও তাদের ক্ষমা করবে না। (লন্ডন : ২০.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com
ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল পঁচাত্তরে। সংসদে মাত্র তিন মিনিটের আলোচনার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। সবগুলো রাজনৈতিক দলকে তিনি নিষিদ্ধ করেন, এমনকি আওয়ামী লীগকেও। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন চারখানি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। প্রস্তুতি হিসেবে আগের বছরেই জরুরি ক্ষমতা আইনের বলে অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এসবেরও পটভূমি ছিল রক্ষী বাহিনীর হাতে ৪০ হাজার খুন, সর্বস্তরে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যেও অবাধ দুর্নীতি, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু।
একই পটভূমি এখন বাংলাদেশেও চলছে। মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ যদি দাবি করেন যে, তিনি দুর্নীতি করছেন না তাহলে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত কর্ণবিদারী অট্টহাসি শুরু হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সরকার সবাই এখন বেপরোয়া দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তাগিদ দিচ্ছে। র্যাব এখন রক্ষীবাহিনী হয়ে গেছে। তারা হাসিনার ক্যাডার আর আওয়ামী লীগের ঘাতকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। খুনের সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম করা। সাংবাদিকদের হত্যা, চ্যানেল-ওয়ান বন্ধ, একুশে টেলিভিশন, ইসলামী চ্যানেল প্রভৃতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার মিডিয়া জগতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে ৯ মাস জেল খাটানো হয়েছে। শুনেছি এখনও ৫৩টি সাজানো মামলা ঝুলে আছে তার বিরুদ্ধে, প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। সরকার ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদকে নিউইয়র্ক দূতাবাসে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে আর বাংলাদেশে একজন বিচারপতি গায়ে পড়ে তার বই ‘দেয়াল’ প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এখন আর কোনো নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। অর্থনৈতিক সঙ্কট, বেসামাল দ্রব্যমূল্য এবং বিদ্যুত্ ও পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত।
পঁচাত্তরের মতোই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে। এ সরকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, বরং ঐতিহাসিক ভুলগুলোর অন্ধ অনুকরণের পথই তারা বেছে নিয়েছে। হত্যা-নির্যাতন, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ এবং জেল-জুলুমের পথ ধরেছে সরকার। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব করে তোলার বহু আয়োজন তারা এরই মধ্যে করেছে। দেশের মানুষ ভয় করছে আরও একবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন শেখ পরিবারের এক সদস্য। সে জন্যই তারা গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য, র্যাবের হাতে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে মুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সাজানো অভিযোগ আর সাজানো মামলায় গ্রেফতার হওয়া বিএনপি ও ১৮ দলের নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা প্রত্যাহার করার দাবি।
মিথ্যা অভিযোগ সাজানো মামলা
বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, পূর্ববর্তী এক হরতালে তারা সচিবালয়ে পাঁচটি ককটেল বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন অথবা করিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে সড়কে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছিলেন কিংবা লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬ মে তারা জামিনের জন্য নিম্ন আদালতে সশরীরে হাজির হলে জামিন না দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
অনেকগুলো প্রশ্ন গিজগিজ করছে এখানে। নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অজুহাত সৃষ্টির জন্য উস্কানিদানের কৌশল ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। বহু দেশ কালে কালে যুগে যুগে সে কৌশল ব্যবহার করেছে—এমনকি ভারত শাসনের সময় ব্রিটিশরাও। সে কৌশল যে আওয়ামী লীগ জানে না সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। যেভাবে সচিবালয়ে ককটেল ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ের রাজপথে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা দুটোকে ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে সন্দেহ প্রবল হয় যে, সম্মিলিত বিরোধী ১৮ দলের গণতন্ত্রের আন্দোলন দলনের লক্ষ্যে ঘটনা দুটো শাসক দলের ভেতর থেকেই সাজানো হয়েছিল।
আন্দোলন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠলে এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চরমে উঠলে কর্মীরা সময় সময় শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু অঘটন ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেসব ঘটনায় প্রায় কখনোই শীর্ষ নেতাদের সম্মতি থাকে না। গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় জনসাধারণের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে। রাজনীতি করে যাঁরা শীর্ষ স্তরে উন্নীত হন তারা অবশ্যই জানেন, উচ্ছৃঙ্খল এবং বিশৃঙ্খল আচরণ জনসাধারণ পছন্দ করে না। কিছুকাল ধরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবং পরে ১৮ দলের ঐক্যজোট হরতাল প্রভৃতি কর্মসূচি দিতে ইতস্ত করেছে এবং তাতে করে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে; খালেদা জিয়া প্রমুখ নেতারা বারংবার বলেছেন, হরতাল দিয়ে সর্বসাধারণের অসুবিধার কারণ ঘটাতে তারা চান না, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র-লিপ্সু নির্যাতক সরকার তাদের জন্য উপায়ান্তর রাখেনি।
১৮টি বিভিন্ন দলের ৩৩ জন শীর্ষ নেতা নিজেরা সচিবালয়ে বোমা ফাটিয়েছেন এবং প্রায় একই সময়ে তিন-চার মাইল দূরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছেন, অথবা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে কর্মীদের ডেকে এসব ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন, উন্মাদ না হলে এমন দাবি কেউ করতে পারে না।
‘চোরেরও ধর্ম থাকে’, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ ইত্যাদি বহু প্রবচন সকলেরই জানা আছে। রাজনীতি একটা সম্মানজনক পেশা। অন্তত তেমনই হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা রাজনীতি করেন। বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি অন্তত পেশাগত সৌজন্য দেখানো তাদের কর্তব্য ছিল। কারাবন্দি নেতাদের প্রতি যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, যেভাবে তাদের ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে একই কারাগারে নেয়া হয়েছে তা থেকে ধরে নিতেই হবে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এ সরকারের সবাই উন্মাদ হয়ে গেছেন। তাদের ভরাডুবি যে অনিবার্য সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের আচরণগুলো এখন লাঠিপেটা খাওয়া সাপের মরণ-কামড় বলেই মনে হয়।
লোভনীয় সম্ভাবনা
কোনো দলের সাধারণ কর্মী কিংবা সমর্থকের কোনো দুষ্কর্মের জন্য যদি দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির সৃষ্টি করা হয়, তাহলে অত্যন্ত লোভনীয় একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী পাঁচ বছর এবং বর্তমানের প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তার ক্যাডার, দলীয় কর্মী এবং দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাব যে হাজার হাজার হত্যা, ধর্ষণ, ভূমিগ্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার সন্ত্রাস, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি দুষ্কর্ম করেছে সে জন্য শেখ হাসিনাকে ‘হুকুমের আসামি’ করে কোনো সময় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মামলা রুজু করা স্বাভাবিক হবে। সরকারের সদস্যদের মনে রাখতে হবে যে, দিন কারও সমানে যায় না। দিন পাল্টালে তারা যে ধরনের ব্যবহার আশা করবেন ঠিক সেভাবেই বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি তাদের আচরণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন যে, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি গদিতে থাকতে চান। তার মন্ত্রিরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সে আভাসই দিয়েছেন। মুক্ত নির্বাচন অসম্ভব করে দিয়ে তিনি ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের স্বৈরশাসকদের এবং বাংলাদেশে তার পিতার মতো স্বৈরশাসক হতে চান। কিন্তু একটা কথা তিনি ভুলে যাচ্ছেন। তিনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এটা বিংশ নয় একবিংশ শতাব্দী এবং বাংলাদেশের মানুষ ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যবাসী নয়।
তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের লক্ষ্যে। হাসিনার পিতার স্বৈরাচার তারা সহ্য করেনি। প্রকৃত হত্যা যদিও জনকয়েক সৈনিক করেছে কিন্তু শেখ মুজিবের পতনের পেছনে বাংলাদেশের মানুষের অন্তত মৌন সম্মতি ছিল। হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার পিতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি এবং সে জন্য বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। হাসিনার স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার বাসনা এ দেশের মানুষ মেনে নেবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে তিনি এ কারণ-সে কারণ দেখিয়ে, বিচারের দোহাই দিয়ে এবং না দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জেলে পুরেছেন। ভারত ও মার্কিনিদের মনোরঞ্জনের আশায় ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’দের ধরপাকড় চালিয়ে গেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশজোড়া তার স্বৈরতন্ত্রী বাসনার বিরোধীদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। প্রধান বিরোধী বিএনপি দলের উচিত ছিল তখন থেকেই এই পাইকারী ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। অপেক্ষাকৃত ছোট গণতান্ত্রিক দলগুলোরও উচিত ছিল বিএনপির ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সেটা তারা করেনি। সে জন্যই ফ্যাসিস্ট সরকার এখন তাদের সবার বিরুদ্ধে হাত বাড়াতে সাহস পাচ্ছে। গত ১৬ মে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ এং ১৮ জোটেরও কিছু কিছু নেতাকে জেলে পাঠিয়ে সে প্রমাণই দিয়েছে সরকার।
বিএনপি কোন পথে?
বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট কী করবে এখন? বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে একটা মহল এতদিন ‘সাংবিধানিক আন্দোলনের’ কথা বলে এই নির্যাতক স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। আমি নিজেও কয়েকটি কলামে বিরোধী দলকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম—এ সরকারকে যতই সময় দেয়া হবে ততই তারা বিরোধী দলের আন্দোলন আর গণতন্ত্রের পথকে অসম্ভব করে তুলবে। সরকার কি বিএনপিকে গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেনি? তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব, ক্যাডার ও গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে রক্তারক্তি ঘটায়নি সরকার? প্রাণহানি করেনি? বিএনপির প্রধান কার্যালয় কি ফ্যাসিস্ট কায়দায় কাঁটাতার আর পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে রাখেনি?
তাছাড়া কোন সংবিধান অনুযায়ী আন্দোলন করবেন তারা? যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা দলীয়কৃত পুলিশ, আমলা ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় আরও একটি সাজানো নির্বাচন করে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চায়? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করতে চায়?
বিএনপি এবং ১৮ দলের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল কিন্তু শাসক দলের ভেতরের উস্কানিদাতাদের দিয়ে সচিবালয়ে ককটেল ফাটিয়ে এবং তেজগাঁও এয়ারপোর্ট রোডে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের অজুহাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। একইভাবে যদি আন্দোলন-বিমুখদের ধরপাকড় শুরু হয় তাহলে তাদের হয়ে প্রতিবাদ করতে কারা এগিয়ে আসবে? আমার আগাগোড়া বিশ্বাস ছিল এই পিছুটান দেয়া ব্যক্তিরা পরোক্ষে হাসিনার বাকশালী পরিকল্পনাতেই মদদ দিচ্ছেন। লোকে সন্দেহ করছে তাদের কারও কারও মধ্যে বিদেশী প্রভাব সক্রিয় থাকতে পারে।
১৬ মে জেলে পাঠানো ৩৩ জন ছাড়াও রিজভী আহমেদ, খায়রুল কবির খোকনসহ আরও কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত ক’দিনে। ঢাকার মিডিয়ায় খবর ছাপা না হলেও জেলা পর্যায়ে বহু নেতাকর্মীকে ধরপাকড় চলছে। অচিহ্নিত গাড়িতে সাদা পোশাক পরিহিত লোকেরা এখন দেশব্যাপী ধরপাকড় চালাচ্ছে। এখন আর সন্দেহ নেই যে, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে বিরোধী দল ও জোটকে নেতৃত্বশূন্য এবং কর্মীবিহীন করে গণতন্ত্রের আন্দোলন নস্যাত্ করে দেয়া। আরও দুটো মতলব আছে তাদের। তারা আশা করছে, তাদের ইচ্ছা পূরণের আদালত বিরোধী দলের বহু নেতাকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে। নেতারা জেলে পচতে থাকলে নির্বাচন দিয়ে তারা জয়ী হতে পারবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করে।
‘কারার ওই লৌহ কপাট’
নেতাদের জেলে নেয়া হয়েছে সেটা এমন কিছু হতাশ হওয়ার ব্যাপার নয়। গান্ধী-নেহরুরা জেলে গিয়েই ইংরেজদের তাড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশেও বহু অন্যায় জনসাধারণ আন্দোলন করে ঠেকিয়েছে। আন্দোলন করে তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, বলতে গেলে দেশকে স্বাধীনও করেছে। এসব আন্দোলনে অজস্র মানুষ গ্রেফতার হয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন। শেখ হাসিনার পিতা আগরতলায় গিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। পাকিস্তানিরা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছিল। তাকে জেলে পোরা হলে দেশের মানুষ আন্দোলন করে তাকে মুক্ত করেছিল। এবারে আটক নেতাদের কেউ কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেননি। তারা শুধু জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তারা সবাই দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রকামী। দেশে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। কথা হচ্ছে বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারা আন্দোলন করে তাদের বন্দি নেতাদের মুক্ত করতে এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে পারবেন কি-না।
অথচ দেশের মানুষ প্রস্তুত আছে। নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনেকগুলো জেলাতেই কর্মীরা গত ১৭ মে হরতাল ডেকেছিলেন। তারপরই শুধু ঢাকা থেকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান হরতালের ডাক দেন। তা সত্ত্বেও সেদিনের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল খুবই সফল হয়েছিল। অর্থাত্ কর্মীদের মধ্যে ইচ্ছা ও উদ্দীপনার অভাব নেই। জনসাধারণ অতীতে বহুবার দেশের ডাকে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, একাত্তরে দেশ স্বাধীন করতে তিন লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের মধ্যে পিছুটানওয়ালাদের উত্পাত।
‘কুইক-কুইক-স্লো’ মনোভাব নিয়ে কোনো আন্দোলনই সফল হতে পারে না। ২০০৬ সালে ‘কুইক মার্চ! হল্ট!’ মার্কা আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ১/১১ সৃষ্টি করেনি। তারা লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ চালানো অসম্ভব করে দিয়েছিল। আন্দোলন সফল করতে হলে বিএনপি এবং ১৮ দলের জোটের নেতাদের সে পথই ধরতে হবে। প্রথম কাতারের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সারির নেতারা তো আছেনই। তারা গ্রেফতার হলে তৃতীয় কাতারের নেতারা এগিয়ে আসবেন। কিন্তু এ অভিযাত্রা তাদের সফল করতেই হবে। তারা সবাই জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ব্যর্থ হলে জাতি কখনও তাদের ক্ষমা করবে না। (লন্ডন : ২০.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন