॥ সিরাজুর রহমান ॥
অমৃতে এত তাড়াতাড়ি কেন অরুচি হলো, কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভাবছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির জন্য হাসিনা এত হরতাল করলেন, রক্ত ঝরালেন, সে পদ্ধতি ঠেকানোর জন্য কেন তিনি দেশের সর্বনাশ করছেন? জবাবটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে জড়িত।
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নব্বই সালের ডিসেম্বরে লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান হন কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তাকে এ পদ দেয়ার ব্যাপারে বড় দুটো দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সম্মতি ছিল। যেভাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার দায়িত্ব (সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ) পালন করেছিলেন দেশে-বিদেশে তার প্রচুর সুখ্যাতি হয়েছিল।
সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পুরো সময়জুড়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অকান্ত আন্দোলন করেছেন। অন্য প্রধান দলের নেত্রী হাসিনা ওয়াজেদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি অখুশি নন। তখন আওয়ামী লীগের সরকারি মুখপত্র ছিল বাংলার বাণী পত্রিকা। সে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাফল্য কামনা করে মুনাজাত করা হয়েছিল।
সে ৯ বছরের বেশির ভাগ সময়জুড়ে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ এরশাদের পক্ষেই ছিলেন। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ সংসদ নির্বাচন ডাকেন। সে নির্বাচন যে কেমন হবে সে সম্বন্ধে কারো সংশয় ছিল না। ১৯ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও অন্য ছোট দলগুলো এক যৌথ বৈঠকে ৬ মে তারিখের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু যৌথ বৈঠকের সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে দিয়ে ২১ তারিখে হাসিনা ঘোষণা করেন যে ৬ মে তারিখের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে।
ভোটারবিহীন সে নির্বাচনে এরশাদ হাসিনাকে হাইকোর্ট দেখিয়েছিলেন। তার শেকড়বিহীন জাতীয় পার্টিকে সংসদে ২৪০ আসন দিয়ে আওয়ামী লীগকে দিয়েছিলেন মাত্র ৬০টি আসন। স্বভাবতই হাসিনা খুশি হতে পারেননি। তিনি ঘোষণা করেন যে আওয়ামী লীগ সংসদে যাবে না। এরশাদ বেকায়দায় পড়েছিলেন। একদলীয় সংসদকে দেশে কিংবা বিদেশে কেউ স্বীকৃতি দেবে না। সামরিক স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করলেন তিনি। হাসিনাকে নিয়ে তিন ঘণ্টার মোটর ভ্রমণে গেলেন তিনি। তারপরই হাসিনা সংসদের বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
৯ বছরের সংগ্রামে খালেদা জিয়াকে যে কত নির্যাতন আর ভীতিপ্রদর্শন সহ্য করতে হয়েছে সেটা রীতিমতো এক ইতিহাস হবে। শেষ অবধি ছাত্র-জনতা খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করে গণতন্ত্রের আন্দোলনে শরিক হতে হাসিনাকে বাধ্য করে। সারা এশিয়াব্যাপী বিবিসির লাইভ কনসার্টের বাংলাদেশ অংশ পরিচালনার জন্য আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আন্দোলন গতি পেতে তখন আর দেরি হয়নি। সামরিক আইন ও কার্ফ্যু জারি করে এবং সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে এরশাদ শেষ রক্ষার চেষ্টা করেন। জনসাধারণকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে তিনি টেলিভাষণে ঘোষণা দেন যে তিনি শিগগিরই নির্বাচন দেবেন এবং নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পদত্যাগ করবেন।
অনেকেই তখন ভয় করছিলেন যে হাসিনা এরশাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। হাসিনা দাবি করেছিলেন যে এরশাদের সরকার তার টেলিফোন কেটে দিয়েছে (পরে শুনেছিলাম যে সেটা সত্যি ছিল না)। আমি লন্ডনে টেলিফোন করে বিবিসিকে বলেছিলাম যে এরশাদের ভাষণ সম্বন্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য আমার সহকর্মীরা যেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোন করেন। তারা উভয়েই সরাসরি এরশাদের প্রস্তাব বাতিল করে দেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সামরিক আইন ও কার্ফ্যু ভঙ্গ করে জনতা সড়কে বেরিয়ে পড়ে, ‘মানি না, মানি না’ বলে তারা স্লোগান দিচ্ছিল। এর পরে এরশাদের পতন মাত্র কিছু ঘণ্টার ব্যাপার ছিল।
অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৯১) সাধারণ নির্বাচন ডাকেন। সে নির্বাচনের মতো জনতার ঢল বাংলাদেশের আর কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। নির্বাচনের খবর দিতে আমি আবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকা ও মফঃস্বলের সাতটি নির্বাচন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম আমি। সর্বত্রই দীর্ঘ সারিবদ্ধ ভোটদাতারা আমাকে বলেছিলেন যে তারা খালেদা জিয়াকে ভোট দিতে এসেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনের নির্যাতনের সময় তারা খালেদা জিয়াকেই দেখেছে, তার আগুনঝরা কণ্ঠের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শুনেছে। তিনি কোন দলের সে প্রশ্ন তখন ওঠেনি। তার বিরাট বিজয় সুনিশ্চিত ছিল।
জনতার সন্দেহাতীত রায় সত্ত্বেও হাসিনা ওয়াজেদ পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ১০ বছর আগে ভারত থেকে তিনি এই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন যে বাংলাদেশ তার পৈতৃক সম্পত্তি; যত অন্যায়ই তিনি করেন না কেন তার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ জনতা তাকেই ভোট দেবেন। বাংলাদেশের মানুষের ‘অকৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে’ হাসিনা ক্ষমা করতে পারেননি। তিনি রাজনীতিকে সংসদ থেকে পথে টেনে নামিয়েছিলেন, দফায় দফায় ও লাগাতার মিলে মোট ১৭৩ দিন হরতাল ডেকেছিলেন। বস্তুত লাগাতার হরতাল কথাটা চালুই করেছিলেন হাসিনা। আন্দোলন করে তিনি খালেদা জিয়ার সরকারকে উপড়ে ফেলতে পারেননি। অগত্যা অন্য পথ ধরলেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ও দুষ্ট ইতিহাস
জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করার আন্দোলন শুরু করলেন শেখ হাসিনা। সে আন্দোলনে বহু হরতাল হয়েছে, সহিংসতাও ঘটেছে অনেক। বেশ কয়েকটি মৃত্যুও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে। ২০ মে তারিখে জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটা সামরিক অভ্যুত্থানেরও ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার সরকার রাজনীতিতে শান্ত পরিবেশ সৃষ্টির আশায় সংসদের সংক্ষিপ্ত অধিবেশন ডেকে সংসদের ১৩ নম্বর সংশোধনী পাস করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু হয়।
আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ী হলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। শেষে জাতীয় পার্টির সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ব্যাপকভাবে জানা আছে যে জুন মাসের সে নির্বাচনের আগে আগে হাসিনা ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য জামায়াতের তৎকালীন নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্যি সরকার গঠনের পর মনোনীত মহিলা সদস্যদের নিয়ে আওয়ামী লীগ গরিষ্ঠতা অর্জন করে। তখন থেকে তারা আবার পুরনো স্বভাব অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে গালিগালাজ শুরু করে।
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হয় ২০০১ সালে। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়েছিল। নির্বাচনী এলাকায় যারা ভোট পরিচালনা, গণনা করবেন এবং প্রিসাইডিং অফিসার হবেন সেসব পদে আওয়ামী লীগের সমর্থক আমলাদের নিযুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে যারা পরিচিত ছিলেন না তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়। হাসিনার কোনো সন্দেহ ছিল না যে সাজানো নির্বাচনে তিনি বিপুল জয়লাভ করবেন।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসারে সদ্য-সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত সচিব পদমর্যাদার মাত্র ১২ জন আমলাকে বদলি করেন। তাতেই আওয়ামী লীগ মহলে ‘গেল, গেল’ রব শুরু হয়। নির্বাচনে বিএনপি বিপুল গরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে। তখন থেকে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ওপর হাসিনার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। এখন তিনি সাহাবুদ্দিন ও লতিফুর রহমান উভয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং আরো নানান গালিগালাজ শুরু করেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রমাণ পেলেন যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি তার বিজয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
যেভাবে তারা ক্ষমতা পেতে চায়
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। সেদিন বিকেল থেকেই হাসিনা ওয়াজেদের ‘লগি-লাঠি-বৈঠার’ লাগাতার হরতাল শুরু হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর রাজপথে লগি-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এক ডজনেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়। সড়ক, নৌপথ ও বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করা হয়, রেলওয়ের লোহার রেলগুলো সরিয়ে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে গৃহবন্দী করে বঙ্গভবনের পাসি, টেলিফোন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়া হয়।
এভাবে আওয়ামী লীগ ফখরুদ্দীন আহমদকে শিখণ্ডি করে জেনারেল মইন ইউ আহমদের অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় আসার পথ করে দেয়। পরের বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্বভ্রমণে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে তিনি সে কথা স্বীকার করেছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন যে সে সরকার তার ‘আন্দোলনের ফসল’ এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের সব কার্যকলাপ তিনি বৈধ করে দেবেন। অবৈধভাবে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে সে সরকার ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শ’ এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় একটা মাস্টারপ্ল্যান করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে হাসিনাকে বিরাট বিজয় দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সম্বন্ধে হাসিনা ওয়াজেদের অরুচির এই হচ্ছে ইতিহাস।
ক্ষমতা পেয়ে হাসিনা আমলাতন্ত্র ও পুলিশে আমূল পরিবর্তন আনেন। দূরবীণ দিয়ে দেখলেও আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া অন্য কাউকে যাতে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো দায়িত্বের জন্য পাওয়া না যায় এভাবে তিনি সেটা নিশ্চিত করলেন। তারপরে সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক বিধিতেই হাত দিলেন তিনি। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীটি বাতিল ঘোষণা করেন; কিন্তু বলেন যে দেশ ও জাতির স্বার্থে আরো কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে করা প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতির রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশের আগেই বিরোধী দল বর্জিত সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে। সরকার ঘোষণা করে যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।
সেটা যে আরেকটি সাজানো নির্বাচনে হাসিনা ওয়াজেদের ‘বিরাট জয়ের’ প্রস্তুতি ছিল সেটা কাউকে বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মাত্র গত সোমবার বলেছেন যে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৭৫টির নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত। অর্থাৎ তিনি আগামী নির্বাচনে নিজ দলকে ১৭৫টি আসন দেয়ার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীর নীলনকশা অনুযায়ী বাকি আসনগুলো কি বিএনপি, ১৮ দলীয় জোট এবং সে জোটের সমর্থক বিকল্প ধারাকে দেয়া হবে বলে ভাবছেন কেউ? অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এরশাদের সাথে ১৯৮২ সাল থেকে হাসিনার একটা রাজনৈতিক নাড়ির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, পরস্পরের ওপর তাদের প্রভাব রহস্যময়। এরশাদকে পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দলের নেতা করা হবে বলে হাসিনা নিজেই বলেছেন। সুতরাং বিএনপি এবং অন্য বিরোধী দলগুলোকে দু-চারটির বেশি আসন দেয়া হাসিনার নীল নকশার অন্তর্ভুক্ত নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন অপরিহার্য
এবং ঠিক সে কারণেই বিএনপি ও অন্য সব গণতন্ত্রকামী দল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেমেছে। হানিফসহ আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এবং তাদের কোনো কোনো কলম সন্ত্রাসী অন্ধকারে শিষ দিয়ে সাহস সঞ্চারের চেষ্টার মতো করে বলছেন যে খালেদা জিয়া আন্দোলন করতে জানেন না, তিনি আন্দোলনের ‘গ্রামার’ (ব্যাকরণ) শেখেননি।
প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। খালেদা যে আন্দোলনের গ্রামার শেখেননি সে কথা দেশের মানুষকে কেউ বলে দেয়নি। তিনি যেখানেই গেছেন হাজারে হাজারে এবং লাখো লাখো মানুষ তার কথা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন। তিনি সভা-সমাবেশ কিংবা হরতাল ডাকলে আওয়ামী লীগের হৃৎকম্পন শুরু হয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ দিয়ে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা কোনো কাজেই লাগছে না তাদের। তারা বিএনপি ও সম্মিলিত জোটের মিছিলের ওপর ক্যাডার ও গুণ্ডাদের লেলিয়ে দিচ্ছে। তারা সহিংসতা ও নাশকতা চালাচ্ছে এবং সরকার সেসব অভিযোগে গ্রেফতার করছে তাদের নয়, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করলেও নানা টালবাহানায় সরকার তাদের মুক্তি দিচ্ছে না। ওই দিকে দেশের প্রত্যন্ত থেকে প্রত্যন্ত পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূলপর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নানা সাজানো অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলে পুরে রাখা হচ্ছে।
খালেদা জিয়াকে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা তারা শুরু করেছে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই। পল্টন ময়দান ও মুক্তাঙ্গন প্রভৃতি ঐতিহ্যিক সভা-সমাবেশের স্থানগুলো বিএনপির জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছে সরকার। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাড়া রাজধানীর আর কোথাও বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাতেও নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। প্রায়ই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাঁটাতারের বেড়া ও পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। সমাবেশে বিএনপি কয়টা মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে পারবে এবং সমাবেশ কোন সীমানার মধ্যে সীমিত রাখতে হবে সেটাও স্থির করে দিচ্ছে সরকার।
এখন আরো একটা নতুন কৌশল নিয়েছে সরকার। দেশের জেলাগুলো থেকে মানুষ রাজধানীতে আসে মোটরলঞ্চ, দূরপাল্লার বাস ও ব্যক্তিগত মোটরগাড়িতে। এসবই সরকার বন্ধ করে দিচ্ছে। রেলের যাত্রীদের তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে কেউ খালেদা জিয়ার সমাবেশে যেতে চায় কি না। রাজধানীতেও বাস ও গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকছে। অর্থাৎ বিএনপি সভা ডাকছে আর সরকার অঘোষিত হরতাল করে দেশ অচল করে দিচ্ছে। তাতে কি সরকারের কৌশল কোনো কাজে লাগছে? মোটেই না। খালেদা জিয়ার ১৩ মে আর ১১ জুনের সমাবেশ সে প্রমাণই দিয়েছে। বহু লাখ মানুষ এসেছিল এ দু’টি সমাবেশে। মফঃস্বল থেকে মানুষ আসতে না পারলেও রাজধানীর অধিবাসীরা সমাবেশে এসেছে লাখে লাখে। সভা-সমাবেশে যাওয়া যাদের ধাতে নেই সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে তারাও এসেছেন।
দেশবাসী কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না
সরকারের অসদুদ্দেশ্য বুঝে নিতে কারোর অসুবিধা হচ্ছে না। তারা চায় বিরোধী দলকে সরকারের সমালোচনা করতে দেয়া হবে না, বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের এবং হাজারে হাজারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের আটক রেখে তারা নিজেদের নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন করবে এবং ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। সে ষড়যন্ত্র সফল হবে কি? আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষকে বহু, বহু প্রকারে প্রতারিত করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের এবং হাসিনা ওয়াজেদের কোনো প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি। বিদ্যুতের ও খাবার পানির অভাব বহু গুণে বেড়ে গেছে।
এবারে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। তাপমাত্রা প্রায় সর্বত্র রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রচণ্ড গরমে পাখা চালানোর কিংবা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বাতি জ্বালানোর বিদ্যুৎ নেই। রান্না করার জন্য নেই গ্যাস। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বিশুদ্ধ পানি নেই। আওয়ামী লীগের লোকেদের রাতারাতি বড় লোক করার জন্য মজুদদারীকে উৎসাহ করা হয়েছে। তাতে চাল-ডাল থেকে শুরু করে সব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। মধ্যবিত্তের জীবন এখন দুঃসহ। সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে ৩৩ লাখ লোক শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। তাদের সে টাকা আওয়ামী লীগের কুমিরেরা খেয়েছে। এখন সে টাকা হালাল করার জন্য বাজেটে বিধান করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি সম্ভবত সারা বিশ্বের রেকর্ডই ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান সরকারকে চোর বলে রায় দিয়েছে। টেন্ডারবাণিজ্য নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গদলগুলোর মধ্যেই সহিংসতা চলছে। মাত্র গত মঙ্গলবার সড়ক ভবনে শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাতে পাঁচজন আহত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার পরিস্থিতি যে জঘন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বহুবার তার নিন্দা করেছে। র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যার নিন্দা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। র্যাব এখন মানুষ গুম করতে শুরু করেছে। দুই বছর আগে ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। তারপর থেকে শ’ দুয়েক মানুষ গুম হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই নদীতে কিংবা জলাভূমিতে লাশ কিংবা কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। দেশের মানুষ যে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে জয়ী করবে না এসব হচ্ছে তার কিছু কারণ।
সে জন্যই খালেদা জিয়ার সভা-সমাবেশে রেকর্ডসংখ্যক লোকের সমাগম হয়। বিএনপি নেত্রী তার আন্দোলনে সংযম দেখাতে গিয়ে অনেক সমালোচনা সয়েছেন। আওয়ামী লীগ রক্তারক্তি করার প্রস্তুতি নিয়েছিল ১২ মে তারিখের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে। খালেদা জিয়া সে কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে দিয়ে তার শান্তি-কামনার প্রমাণ দিয়েছেন। গত রোববারের মহাসমাবেশেও তিনি উগ্র কোনো কর্মসূচি এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন ঈদুল ফিতর পর্যন্ত তিনি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবেন না।
তার এই সংযত আচরণকেই আওয়ামী লীগ ও তাদের কলম সন্ত্রাসীরা দুর্বলতা এবং ব্যাকরণজ্ঞানের অভাব বলে বিদ্রƒপ করছে। তাতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান কিংবা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের ভয়ে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের শেষ রফা হবে না। তিউনিসিয়ার বেন আলী, মিসরের হোসনি মোবারক ও ইয়েমেনের সালেহ প্রমাণ পেয়ে গেছেন একবিংশ শতকে মানুষ স্বৈরতন্ত্রকে বরদাশত করতে রাজি নয়। গণতন্ত্রের ঢলের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছেন। এর থেকে তারও পরিত্রাণের আশা নেই। হাসিনা ওয়াজেদ এবং আওয়ামী লীগ বাকশালী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। হানিফসহ কোনো কোনো নেতা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন সে কথা। বাংলাদেশের মাটি নরম কিন্তু অতি নিষ্ঠুর। এ দেশের মানুষও দেখতে নরম হলেও তাদের রক্তে আগুন আছে। হাসিনার পিতার স্বৈরতন্ত্র তারা সহ্য করেনি। তার স্বৈরতন্ত্রের চক্রান্তও তারা সহ্য করবে না।
লন্ডন, ১৩ জুন ২০১২
serajurrahman34@gmail.com
অমৃতে এত তাড়াতাড়ি কেন অরুচি হলো, কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভাবছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির জন্য হাসিনা এত হরতাল করলেন, রক্ত ঝরালেন, সে পদ্ধতি ঠেকানোর জন্য কেন তিনি দেশের সর্বনাশ করছেন? জবাবটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে জড়িত।
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নব্বই সালের ডিসেম্বরে লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান হন কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তাকে এ পদ দেয়ার ব্যাপারে বড় দুটো দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সম্মতি ছিল। যেভাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার দায়িত্ব (সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ) পালন করেছিলেন দেশে-বিদেশে তার প্রচুর সুখ্যাতি হয়েছিল।
সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পুরো সময়জুড়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অকান্ত আন্দোলন করেছেন। অন্য প্রধান দলের নেত্রী হাসিনা ওয়াজেদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি অখুশি নন। তখন আওয়ামী লীগের সরকারি মুখপত্র ছিল বাংলার বাণী পত্রিকা। সে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাফল্য কামনা করে মুনাজাত করা হয়েছিল।
সে ৯ বছরের বেশির ভাগ সময়জুড়ে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ এরশাদের পক্ষেই ছিলেন। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ সংসদ নির্বাচন ডাকেন। সে নির্বাচন যে কেমন হবে সে সম্বন্ধে কারো সংশয় ছিল না। ১৯ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও অন্য ছোট দলগুলো এক যৌথ বৈঠকে ৬ মে তারিখের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু যৌথ বৈঠকের সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে দিয়ে ২১ তারিখে হাসিনা ঘোষণা করেন যে ৬ মে তারিখের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে।
ভোটারবিহীন সে নির্বাচনে এরশাদ হাসিনাকে হাইকোর্ট দেখিয়েছিলেন। তার শেকড়বিহীন জাতীয় পার্টিকে সংসদে ২৪০ আসন দিয়ে আওয়ামী লীগকে দিয়েছিলেন মাত্র ৬০টি আসন। স্বভাবতই হাসিনা খুশি হতে পারেননি। তিনি ঘোষণা করেন যে আওয়ামী লীগ সংসদে যাবে না। এরশাদ বেকায়দায় পড়েছিলেন। একদলীয় সংসদকে দেশে কিংবা বিদেশে কেউ স্বীকৃতি দেবে না। সামরিক স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করলেন তিনি। হাসিনাকে নিয়ে তিন ঘণ্টার মোটর ভ্রমণে গেলেন তিনি। তারপরই হাসিনা সংসদের বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
৯ বছরের সংগ্রামে খালেদা জিয়াকে যে কত নির্যাতন আর ভীতিপ্রদর্শন সহ্য করতে হয়েছে সেটা রীতিমতো এক ইতিহাস হবে। শেষ অবধি ছাত্র-জনতা খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করে গণতন্ত্রের আন্দোলনে শরিক হতে হাসিনাকে বাধ্য করে। সারা এশিয়াব্যাপী বিবিসির লাইভ কনসার্টের বাংলাদেশ অংশ পরিচালনার জন্য আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আন্দোলন গতি পেতে তখন আর দেরি হয়নি। সামরিক আইন ও কার্ফ্যু জারি করে এবং সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে এরশাদ শেষ রক্ষার চেষ্টা করেন। জনসাধারণকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে তিনি টেলিভাষণে ঘোষণা দেন যে তিনি শিগগিরই নির্বাচন দেবেন এবং নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পদত্যাগ করবেন।
অনেকেই তখন ভয় করছিলেন যে হাসিনা এরশাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। হাসিনা দাবি করেছিলেন যে এরশাদের সরকার তার টেলিফোন কেটে দিয়েছে (পরে শুনেছিলাম যে সেটা সত্যি ছিল না)। আমি লন্ডনে টেলিফোন করে বিবিসিকে বলেছিলাম যে এরশাদের ভাষণ সম্বন্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য আমার সহকর্মীরা যেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোন করেন। তারা উভয়েই সরাসরি এরশাদের প্রস্তাব বাতিল করে দেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সামরিক আইন ও কার্ফ্যু ভঙ্গ করে জনতা সড়কে বেরিয়ে পড়ে, ‘মানি না, মানি না’ বলে তারা স্লোগান দিচ্ছিল। এর পরে এরশাদের পতন মাত্র কিছু ঘণ্টার ব্যাপার ছিল।
অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৯১) সাধারণ নির্বাচন ডাকেন। সে নির্বাচনের মতো জনতার ঢল বাংলাদেশের আর কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। নির্বাচনের খবর দিতে আমি আবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকা ও মফঃস্বলের সাতটি নির্বাচন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম আমি। সর্বত্রই দীর্ঘ সারিবদ্ধ ভোটদাতারা আমাকে বলেছিলেন যে তারা খালেদা জিয়াকে ভোট দিতে এসেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনের নির্যাতনের সময় তারা খালেদা জিয়াকেই দেখেছে, তার আগুনঝরা কণ্ঠের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শুনেছে। তিনি কোন দলের সে প্রশ্ন তখন ওঠেনি। তার বিরাট বিজয় সুনিশ্চিত ছিল।
জনতার সন্দেহাতীত রায় সত্ত্বেও হাসিনা ওয়াজেদ পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ১০ বছর আগে ভারত থেকে তিনি এই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন যে বাংলাদেশ তার পৈতৃক সম্পত্তি; যত অন্যায়ই তিনি করেন না কেন তার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ জনতা তাকেই ভোট দেবেন। বাংলাদেশের মানুষের ‘অকৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে’ হাসিনা ক্ষমা করতে পারেননি। তিনি রাজনীতিকে সংসদ থেকে পথে টেনে নামিয়েছিলেন, দফায় দফায় ও লাগাতার মিলে মোট ১৭৩ দিন হরতাল ডেকেছিলেন। বস্তুত লাগাতার হরতাল কথাটা চালুই করেছিলেন হাসিনা। আন্দোলন করে তিনি খালেদা জিয়ার সরকারকে উপড়ে ফেলতে পারেননি। অগত্যা অন্য পথ ধরলেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ও দুষ্ট ইতিহাস
জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করার আন্দোলন শুরু করলেন শেখ হাসিনা। সে আন্দোলনে বহু হরতাল হয়েছে, সহিংসতাও ঘটেছে অনেক। বেশ কয়েকটি মৃত্যুও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে। ২০ মে তারিখে জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটা সামরিক অভ্যুত্থানেরও ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার সরকার রাজনীতিতে শান্ত পরিবেশ সৃষ্টির আশায় সংসদের সংক্ষিপ্ত অধিবেশন ডেকে সংসদের ১৩ নম্বর সংশোধনী পাস করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু হয়।
আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ী হলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। শেষে জাতীয় পার্টির সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ব্যাপকভাবে জানা আছে যে জুন মাসের সে নির্বাচনের আগে আগে হাসিনা ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য জামায়াতের তৎকালীন নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্যি সরকার গঠনের পর মনোনীত মহিলা সদস্যদের নিয়ে আওয়ামী লীগ গরিষ্ঠতা অর্জন করে। তখন থেকে তারা আবার পুরনো স্বভাব অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে গালিগালাজ শুরু করে।
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হয় ২০০১ সালে। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়েছিল। নির্বাচনী এলাকায় যারা ভোট পরিচালনা, গণনা করবেন এবং প্রিসাইডিং অফিসার হবেন সেসব পদে আওয়ামী লীগের সমর্থক আমলাদের নিযুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে যারা পরিচিত ছিলেন না তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়। হাসিনার কোনো সন্দেহ ছিল না যে সাজানো নির্বাচনে তিনি বিপুল জয়লাভ করবেন।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসারে সদ্য-সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত সচিব পদমর্যাদার মাত্র ১২ জন আমলাকে বদলি করেন। তাতেই আওয়ামী লীগ মহলে ‘গেল, গেল’ রব শুরু হয়। নির্বাচনে বিএনপি বিপুল গরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে। তখন থেকে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ওপর হাসিনার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। এখন তিনি সাহাবুদ্দিন ও লতিফুর রহমান উভয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং আরো নানান গালিগালাজ শুরু করেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রমাণ পেলেন যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি তার বিজয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
যেভাবে তারা ক্ষমতা পেতে চায়
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। সেদিন বিকেল থেকেই হাসিনা ওয়াজেদের ‘লগি-লাঠি-বৈঠার’ লাগাতার হরতাল শুরু হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর রাজপথে লগি-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এক ডজনেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়। সড়ক, নৌপথ ও বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করা হয়, রেলওয়ের লোহার রেলগুলো সরিয়ে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে গৃহবন্দী করে বঙ্গভবনের পাসি, টেলিফোন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়া হয়।
এভাবে আওয়ামী লীগ ফখরুদ্দীন আহমদকে শিখণ্ডি করে জেনারেল মইন ইউ আহমদের অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় আসার পথ করে দেয়। পরের বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্বভ্রমণে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে তিনি সে কথা স্বীকার করেছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন যে সে সরকার তার ‘আন্দোলনের ফসল’ এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের সব কার্যকলাপ তিনি বৈধ করে দেবেন। অবৈধভাবে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে সে সরকার ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শ’ এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় একটা মাস্টারপ্ল্যান করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে হাসিনাকে বিরাট বিজয় দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সম্বন্ধে হাসিনা ওয়াজেদের অরুচির এই হচ্ছে ইতিহাস।
ক্ষমতা পেয়ে হাসিনা আমলাতন্ত্র ও পুলিশে আমূল পরিবর্তন আনেন। দূরবীণ দিয়ে দেখলেও আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া অন্য কাউকে যাতে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো দায়িত্বের জন্য পাওয়া না যায় এভাবে তিনি সেটা নিশ্চিত করলেন। তারপরে সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক বিধিতেই হাত দিলেন তিনি। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীটি বাতিল ঘোষণা করেন; কিন্তু বলেন যে দেশ ও জাতির স্বার্থে আরো কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে করা প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতির রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশের আগেই বিরোধী দল বর্জিত সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে। সরকার ঘোষণা করে যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।
সেটা যে আরেকটি সাজানো নির্বাচনে হাসিনা ওয়াজেদের ‘বিরাট জয়ের’ প্রস্তুতি ছিল সেটা কাউকে বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মাত্র গত সোমবার বলেছেন যে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৭৫টির নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত। অর্থাৎ তিনি আগামী নির্বাচনে নিজ দলকে ১৭৫টি আসন দেয়ার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীর নীলনকশা অনুযায়ী বাকি আসনগুলো কি বিএনপি, ১৮ দলীয় জোট এবং সে জোটের সমর্থক বিকল্প ধারাকে দেয়া হবে বলে ভাবছেন কেউ? অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এরশাদের সাথে ১৯৮২ সাল থেকে হাসিনার একটা রাজনৈতিক নাড়ির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, পরস্পরের ওপর তাদের প্রভাব রহস্যময়। এরশাদকে পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দলের নেতা করা হবে বলে হাসিনা নিজেই বলেছেন। সুতরাং বিএনপি এবং অন্য বিরোধী দলগুলোকে দু-চারটির বেশি আসন দেয়া হাসিনার নীল নকশার অন্তর্ভুক্ত নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন অপরিহার্য
এবং ঠিক সে কারণেই বিএনপি ও অন্য সব গণতন্ত্রকামী দল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেমেছে। হানিফসহ আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এবং তাদের কোনো কোনো কলম সন্ত্রাসী অন্ধকারে শিষ দিয়ে সাহস সঞ্চারের চেষ্টার মতো করে বলছেন যে খালেদা জিয়া আন্দোলন করতে জানেন না, তিনি আন্দোলনের ‘গ্রামার’ (ব্যাকরণ) শেখেননি।
প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। খালেদা যে আন্দোলনের গ্রামার শেখেননি সে কথা দেশের মানুষকে কেউ বলে দেয়নি। তিনি যেখানেই গেছেন হাজারে হাজারে এবং লাখো লাখো মানুষ তার কথা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন। তিনি সভা-সমাবেশ কিংবা হরতাল ডাকলে আওয়ামী লীগের হৃৎকম্পন শুরু হয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ দিয়ে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা কোনো কাজেই লাগছে না তাদের। তারা বিএনপি ও সম্মিলিত জোটের মিছিলের ওপর ক্যাডার ও গুণ্ডাদের লেলিয়ে দিচ্ছে। তারা সহিংসতা ও নাশকতা চালাচ্ছে এবং সরকার সেসব অভিযোগে গ্রেফতার করছে তাদের নয়, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করলেও নানা টালবাহানায় সরকার তাদের মুক্তি দিচ্ছে না। ওই দিকে দেশের প্রত্যন্ত থেকে প্রত্যন্ত পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূলপর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নানা সাজানো অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলে পুরে রাখা হচ্ছে।
খালেদা জিয়াকে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা তারা শুরু করেছে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই। পল্টন ময়দান ও মুক্তাঙ্গন প্রভৃতি ঐতিহ্যিক সভা-সমাবেশের স্থানগুলো বিএনপির জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছে সরকার। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাড়া রাজধানীর আর কোথাও বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাতেও নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। প্রায়ই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাঁটাতারের বেড়া ও পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। সমাবেশে বিএনপি কয়টা মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে পারবে এবং সমাবেশ কোন সীমানার মধ্যে সীমিত রাখতে হবে সেটাও স্থির করে দিচ্ছে সরকার।
এখন আরো একটা নতুন কৌশল নিয়েছে সরকার। দেশের জেলাগুলো থেকে মানুষ রাজধানীতে আসে মোটরলঞ্চ, দূরপাল্লার বাস ও ব্যক্তিগত মোটরগাড়িতে। এসবই সরকার বন্ধ করে দিচ্ছে। রেলের যাত্রীদের তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে কেউ খালেদা জিয়ার সমাবেশে যেতে চায় কি না। রাজধানীতেও বাস ও গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকছে। অর্থাৎ বিএনপি সভা ডাকছে আর সরকার অঘোষিত হরতাল করে দেশ অচল করে দিচ্ছে। তাতে কি সরকারের কৌশল কোনো কাজে লাগছে? মোটেই না। খালেদা জিয়ার ১৩ মে আর ১১ জুনের সমাবেশ সে প্রমাণই দিয়েছে। বহু লাখ মানুষ এসেছিল এ দু’টি সমাবেশে। মফঃস্বল থেকে মানুষ আসতে না পারলেও রাজধানীর অধিবাসীরা সমাবেশে এসেছে লাখে লাখে। সভা-সমাবেশে যাওয়া যাদের ধাতে নেই সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে তারাও এসেছেন।
দেশবাসী কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না
সরকারের অসদুদ্দেশ্য বুঝে নিতে কারোর অসুবিধা হচ্ছে না। তারা চায় বিরোধী দলকে সরকারের সমালোচনা করতে দেয়া হবে না, বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের এবং হাজারে হাজারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের আটক রেখে তারা নিজেদের নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন করবে এবং ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। সে ষড়যন্ত্র সফল হবে কি? আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষকে বহু, বহু প্রকারে প্রতারিত করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের এবং হাসিনা ওয়াজেদের কোনো প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি। বিদ্যুতের ও খাবার পানির অভাব বহু গুণে বেড়ে গেছে।
এবারে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। তাপমাত্রা প্রায় সর্বত্র রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রচণ্ড গরমে পাখা চালানোর কিংবা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বাতি জ্বালানোর বিদ্যুৎ নেই। রান্না করার জন্য নেই গ্যাস। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বিশুদ্ধ পানি নেই। আওয়ামী লীগের লোকেদের রাতারাতি বড় লোক করার জন্য মজুদদারীকে উৎসাহ করা হয়েছে। তাতে চাল-ডাল থেকে শুরু করে সব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। মধ্যবিত্তের জীবন এখন দুঃসহ। সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে ৩৩ লাখ লোক শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। তাদের সে টাকা আওয়ামী লীগের কুমিরেরা খেয়েছে। এখন সে টাকা হালাল করার জন্য বাজেটে বিধান করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি সম্ভবত সারা বিশ্বের রেকর্ডই ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান সরকারকে চোর বলে রায় দিয়েছে। টেন্ডারবাণিজ্য নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গদলগুলোর মধ্যেই সহিংসতা চলছে। মাত্র গত মঙ্গলবার সড়ক ভবনে শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাতে পাঁচজন আহত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার পরিস্থিতি যে জঘন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বহুবার তার নিন্দা করেছে। র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যার নিন্দা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। র্যাব এখন মানুষ গুম করতে শুরু করেছে। দুই বছর আগে ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। তারপর থেকে শ’ দুয়েক মানুষ গুম হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই নদীতে কিংবা জলাভূমিতে লাশ কিংবা কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। দেশের মানুষ যে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে জয়ী করবে না এসব হচ্ছে তার কিছু কারণ।
সে জন্যই খালেদা জিয়ার সভা-সমাবেশে রেকর্ডসংখ্যক লোকের সমাগম হয়। বিএনপি নেত্রী তার আন্দোলনে সংযম দেখাতে গিয়ে অনেক সমালোচনা সয়েছেন। আওয়ামী লীগ রক্তারক্তি করার প্রস্তুতি নিয়েছিল ১২ মে তারিখের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে। খালেদা জিয়া সে কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে দিয়ে তার শান্তি-কামনার প্রমাণ দিয়েছেন। গত রোববারের মহাসমাবেশেও তিনি উগ্র কোনো কর্মসূচি এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন ঈদুল ফিতর পর্যন্ত তিনি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবেন না।
তার এই সংযত আচরণকেই আওয়ামী লীগ ও তাদের কলম সন্ত্রাসীরা দুর্বলতা এবং ব্যাকরণজ্ঞানের অভাব বলে বিদ্রƒপ করছে। তাতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান কিংবা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের ভয়ে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের শেষ রফা হবে না। তিউনিসিয়ার বেন আলী, মিসরের হোসনি মোবারক ও ইয়েমেনের সালেহ প্রমাণ পেয়ে গেছেন একবিংশ শতকে মানুষ স্বৈরতন্ত্রকে বরদাশত করতে রাজি নয়। গণতন্ত্রের ঢলের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছেন। এর থেকে তারও পরিত্রাণের আশা নেই। হাসিনা ওয়াজেদ এবং আওয়ামী লীগ বাকশালী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। হানিফসহ কোনো কোনো নেতা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন সে কথা। বাংলাদেশের মাটি নরম কিন্তু অতি নিষ্ঠুর। এ দেশের মানুষও দেখতে নরম হলেও তাদের রক্তে আগুন আছে। হাসিনার পিতার স্বৈরতন্ত্র তারা সহ্য করেনি। তার স্বৈরতন্ত্রের চক্রান্তও তারা সহ্য করবে না।
লন্ডন, ১৩ জুন ২০১২
serajurrahman34@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন