বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

জেল-জুলুম দিয়ে গণআন্দোলন দমন করা যায় না



সিরাজুর রহমান
দেশটাকে ঠেলতে ঠেলতে আওয়ামী লীগ সরকার একেবারে অতল গহ্বরের ধারে নিয়ে এসেছে। মাত্র দুটো ব্যাপারই ঘটতে পারে এখন : দেশ যদি অতলে তলিয়ে যায়, শ্মশান-নৃত্যের মতো করে আওয়ামী লীগওয়ালারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার চালাবে। আর দেশ যদি টিকে থাকে, তলিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশকে এখন এই দুই সম্ভাবনার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।
ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল পঁচাত্তরে। সংসদে মাত্র তিন মিনিটের আলোচনার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। সবগুলো রাজনৈতিক দলকে তিনি নিষিদ্ধ করেন, এমনকি আওয়ামী লীগকেও। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন চারখানি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। প্রস্তুতি হিসেবে আগের বছরেই জরুরি ক্ষমতা আইনের বলে অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এসবেরও পটভূমি ছিল রক্ষী বাহিনীর হাতে ৪০ হাজার খুন, সর্বস্তরে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যেও অবাধ দুর্নীতি, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু।
একই পটভূমি এখন বাংলাদেশেও চলছে। মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ যদি দাবি করেন যে, তিনি দুর্নীতি করছেন না তাহলে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত কর্ণবিদারী অট্টহাসি শুরু হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সরকার সবাই এখন বেপরোয়া দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তাগিদ দিচ্ছে। র্যাব এখন রক্ষীবাহিনী হয়ে গেছে। তারা হাসিনার ক্যাডার আর আওয়ামী লীগের ঘাতকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। খুনের সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম করা। সাংবাদিকদের হত্যা, চ্যানেল-ওয়ান বন্ধ, একুশে টেলিভিশন, ইসলামী চ্যানেল প্রভৃতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার মিডিয়া জগতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে ৯ মাস জেল খাটানো হয়েছে। শুনেছি এখনও ৫৩টি সাজানো মামলা ঝুলে আছে তার বিরুদ্ধে, প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। সরকার ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদকে নিউইয়র্ক দূতাবাসে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে আর বাংলাদেশে একজন বিচারপতি গায়ে পড়ে তার বই ‘দেয়াল’ প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এখন আর কোনো নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। অর্থনৈতিক সঙ্কট, বেসামাল দ্রব্যমূল্য এবং বিদ্যুত্ ও পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত।
পঁচাত্তরের মতোই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে। এ সরকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, বরং ঐতিহাসিক ভুলগুলোর অন্ধ অনুকরণের পথই তারা বেছে নিয়েছে। হত্যা-নির্যাতন, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ এবং জেল-জুলুমের পথ ধরেছে সরকার। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব করে তোলার বহু আয়োজন তারা এরই মধ্যে করেছে। দেশের মানুষ ভয় করছে আরও একবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন শেখ পরিবারের এক সদস্য। সে জন্যই তারা গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য, র্যাবের হাতে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে মুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সাজানো অভিযোগ আর সাজানো মামলায় গ্রেফতার হওয়া বিএনপি ও ১৮ দলের নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা প্রত্যাহার করার দাবি।

মিথ্যা অভিযোগ সাজানো মামলা
বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, পূর্ববর্তী এক হরতালে তারা সচিবালয়ে পাঁচটি ককটেল বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন অথবা করিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে সড়কে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছিলেন কিংবা লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬ মে তারা জামিনের জন্য নিম্ন আদালতে সশরীরে হাজির হলে জামিন না দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
অনেকগুলো প্রশ্ন গিজগিজ করছে এখানে। নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অজুহাত সৃষ্টির জন্য উস্কানিদানের কৌশল ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। বহু দেশ কালে কালে যুগে যুগে সে কৌশল ব্যবহার করেছে—এমনকি ভারত শাসনের সময় ব্রিটিশরাও। সে কৌশল যে আওয়ামী লীগ জানে না সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। যেভাবে সচিবালয়ে ককটেল ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ের রাজপথে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা দুটোকে ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে সন্দেহ প্রবল হয় যে, সম্মিলিত বিরোধী ১৮ দলের গণতন্ত্রের আন্দোলন দলনের লক্ষ্যে ঘটনা দুটো শাসক দলের ভেতর থেকেই সাজানো হয়েছিল।
আন্দোলন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠলে এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চরমে উঠলে কর্মীরা সময় সময় শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু অঘটন ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেসব ঘটনায় প্রায় কখনোই শীর্ষ নেতাদের সম্মতি থাকে না। গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় জনসাধারণের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে। রাজনীতি করে যাঁরা শীর্ষ স্তরে উন্নীত হন তারা অবশ্যই জানেন, উচ্ছৃঙ্খল এবং বিশৃঙ্খল আচরণ জনসাধারণ পছন্দ করে না। কিছুকাল ধরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবং পরে ১৮ দলের ঐক্যজোট হরতাল প্রভৃতি কর্মসূচি দিতে ইতস্ত করেছে এবং তাতে করে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে; খালেদা জিয়া প্রমুখ নেতারা বারংবার বলেছেন, হরতাল দিয়ে সর্বসাধারণের অসুবিধার কারণ ঘটাতে তারা চান না, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র-লিপ্সু নির্যাতক সরকার তাদের জন্য উপায়ান্তর রাখেনি।
১৮টি বিভিন্ন দলের ৩৩ জন শীর্ষ নেতা নিজেরা সচিবালয়ে বোমা ফাটিয়েছেন এবং প্রায় একই সময়ে তিন-চার মাইল দূরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছেন, অথবা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে কর্মীদের ডেকে এসব ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন, উন্মাদ না হলে এমন দাবি কেউ করতে পারে না।
‘চোরেরও ধর্ম থাকে’, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ ইত্যাদি বহু প্রবচন সকলেরই জানা আছে। রাজনীতি একটা সম্মানজনক পেশা। অন্তত তেমনই হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা রাজনীতি করেন। বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি অন্তত পেশাগত সৌজন্য দেখানো তাদের কর্তব্য ছিল। কারাবন্দি নেতাদের প্রতি যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, যেভাবে তাদের ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে একই কারাগারে নেয়া হয়েছে তা থেকে ধরে নিতেই হবে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এ সরকারের সবাই উন্মাদ হয়ে গেছেন। তাদের ভরাডুবি যে অনিবার্য সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের আচরণগুলো এখন লাঠিপেটা খাওয়া সাপের মরণ-কামড় বলেই মনে হয়।
লোভনীয় সম্ভাবনা
কোনো দলের সাধারণ কর্মী কিংবা সমর্থকের কোনো দুষ্কর্মের জন্য যদি দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির সৃষ্টি করা হয়, তাহলে অত্যন্ত লোভনীয় একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী পাঁচ বছর এবং বর্তমানের প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তার ক্যাডার, দলীয় কর্মী এবং দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাব যে হাজার হাজার হত্যা, ধর্ষণ, ভূমিগ্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার সন্ত্রাস, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি দুষ্কর্ম করেছে সে জন্য শেখ হাসিনাকে ‘হুকুমের আসামি’ করে কোনো সময় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মামলা রুজু করা স্বাভাবিক হবে। সরকারের সদস্যদের মনে রাখতে হবে যে, দিন কারও সমানে যায় না। দিন পাল্টালে তারা যে ধরনের ব্যবহার আশা করবেন ঠিক সেভাবেই বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি তাদের আচরণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন যে, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি গদিতে থাকতে চান। তার মন্ত্রিরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সে আভাসই দিয়েছেন। মুক্ত নির্বাচন অসম্ভব করে দিয়ে তিনি ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের স্বৈরশাসকদের এবং বাংলাদেশে তার পিতার মতো স্বৈরশাসক হতে চান। কিন্তু একটা কথা তিনি ভুলে যাচ্ছেন। তিনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এটা বিংশ নয় একবিংশ শতাব্দী এবং বাংলাদেশের মানুষ ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যবাসী নয়।
তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের লক্ষ্যে। হাসিনার পিতার স্বৈরাচার তারা সহ্য করেনি। প্রকৃত হত্যা যদিও জনকয়েক সৈনিক করেছে কিন্তু শেখ মুজিবের পতনের পেছনে বাংলাদেশের মানুষের অন্তত মৌন সম্মতি ছিল। হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার পিতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি এবং সে জন্য বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। হাসিনার স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার বাসনা এ দেশের মানুষ মেনে নেবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে তিনি এ কারণ-সে কারণ দেখিয়ে, বিচারের দোহাই দিয়ে এবং না দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জেলে পুরেছেন। ভারত ও মার্কিনিদের মনোরঞ্জনের আশায় ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’দের ধরপাকড় চালিয়ে গেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশজোড়া তার স্বৈরতন্ত্রী বাসনার বিরোধীদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। প্রধান বিরোধী বিএনপি দলের উচিত ছিল তখন থেকেই এই পাইকারী ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। অপেক্ষাকৃত ছোট গণতান্ত্রিক দলগুলোরও উচিত ছিল বিএনপির ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সেটা তারা করেনি। সে জন্যই ফ্যাসিস্ট সরকার এখন তাদের সবার বিরুদ্ধে হাত বাড়াতে সাহস পাচ্ছে। গত ১৬ মে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ এং ১৮ জোটেরও কিছু কিছু নেতাকে জেলে পাঠিয়ে সে প্রমাণই দিয়েছে সরকার।
বিএনপি কোন পথে?
বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট কী করবে এখন? বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে একটা মহল এতদিন ‘সাংবিধানিক আন্দোলনের’ কথা বলে এই নির্যাতক স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। আমি নিজেও কয়েকটি কলামে বিরোধী দলকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম—এ সরকারকে যতই সময় দেয়া হবে ততই তারা বিরোধী দলের আন্দোলন আর গণতন্ত্রের পথকে অসম্ভব করে তুলবে। সরকার কি বিএনপিকে গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেনি? তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব, ক্যাডার ও গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে রক্তারক্তি ঘটায়নি সরকার? প্রাণহানি করেনি? বিএনপির প্রধান কার্যালয় কি ফ্যাসিস্ট কায়দায় কাঁটাতার আর পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে রাখেনি?
তাছাড়া কোন সংবিধান অনুযায়ী আন্দোলন করবেন তারা? যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা দলীয়কৃত পুলিশ, আমলা ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় আরও একটি সাজানো নির্বাচন করে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চায়? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করতে চায়?
বিএনপি এবং ১৮ দলের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল কিন্তু শাসক দলের ভেতরের উস্কানিদাতাদের দিয়ে সচিবালয়ে ককটেল ফাটিয়ে এবং তেজগাঁও এয়ারপোর্ট রোডে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের অজুহাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। একইভাবে যদি আন্দোলন-বিমুখদের ধরপাকড় শুরু হয় তাহলে তাদের হয়ে প্রতিবাদ করতে কারা এগিয়ে আসবে? আমার আগাগোড়া বিশ্বাস ছিল এই পিছুটান দেয়া ব্যক্তিরা পরোক্ষে হাসিনার বাকশালী পরিকল্পনাতেই মদদ দিচ্ছেন। লোকে সন্দেহ করছে তাদের কারও কারও মধ্যে বিদেশী প্রভাব সক্রিয় থাকতে পারে।
১৬ মে জেলে পাঠানো ৩৩ জন ছাড়াও রিজভী আহমেদ, খায়রুল কবির খোকনসহ আরও কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত ক’দিনে। ঢাকার মিডিয়ায় খবর ছাপা না হলেও জেলা পর্যায়ে বহু নেতাকর্মীকে ধরপাকড় চলছে। অচিহ্নিত গাড়িতে সাদা পোশাক পরিহিত লোকেরা এখন দেশব্যাপী ধরপাকড় চালাচ্ছে। এখন আর সন্দেহ নেই যে, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে বিরোধী দল ও জোটকে নেতৃত্বশূন্য এবং কর্মীবিহীন করে গণতন্ত্রের আন্দোলন নস্যাত্ করে দেয়া। আরও দুটো মতলব আছে তাদের। তারা আশা করছে, তাদের ইচ্ছা পূরণের আদালত বিরোধী দলের বহু নেতাকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে। নেতারা জেলে পচতে থাকলে নির্বাচন দিয়ে তারা জয়ী হতে পারবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করে।
‘কারার ওই লৌহ কপাট’
নেতাদের জেলে নেয়া হয়েছে সেটা এমন কিছু হতাশ হওয়ার ব্যাপার নয়। গান্ধী-নেহরুরা জেলে গিয়েই ইংরেজদের তাড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশেও বহু অন্যায় জনসাধারণ আন্দোলন করে ঠেকিয়েছে। আন্দোলন করে তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, বলতে গেলে দেশকে স্বাধীনও করেছে। এসব আন্দোলনে অজস্র মানুষ গ্রেফতার হয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন। শেখ হাসিনার পিতা আগরতলায় গিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। পাকিস্তানিরা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছিল। তাকে জেলে পোরা হলে দেশের মানুষ আন্দোলন করে তাকে মুক্ত করেছিল। এবারে আটক নেতাদের কেউ কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেননি। তারা শুধু জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তারা সবাই দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রকামী। দেশে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। কথা হচ্ছে বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারা আন্দোলন করে তাদের বন্দি নেতাদের মুক্ত করতে এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে পারবেন কি-না।
অথচ দেশের মানুষ প্রস্তুত আছে। নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনেকগুলো জেলাতেই কর্মীরা গত ১৭ মে হরতাল ডেকেছিলেন। তারপরই শুধু ঢাকা থেকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান হরতালের ডাক দেন। তা সত্ত্বেও সেদিনের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল খুবই সফল হয়েছিল। অর্থাত্ কর্মীদের মধ্যে ইচ্ছা ও উদ্দীপনার অভাব নেই। জনসাধারণ অতীতে বহুবার দেশের ডাকে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, একাত্তরে দেশ স্বাধীন করতে তিন লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের মধ্যে পিছুটানওয়ালাদের উত্পাত।
‘কুইক-কুইক-স্লো’ মনোভাব নিয়ে কোনো আন্দোলনই সফল হতে পারে না। ২০০৬ সালে ‘কুইক মার্চ! হল্ট!’ মার্কা আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ১/১১ সৃষ্টি করেনি। তারা লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ চালানো অসম্ভব করে দিয়েছিল। আন্দোলন সফল করতে হলে বিএনপি এবং ১৮ দলের জোটের নেতাদের সে পথই ধরতে হবে। প্রথম কাতারের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সারির নেতারা তো আছেনই। তারা গ্রেফতার হলে তৃতীয় কাতারের নেতারা এগিয়ে আসবেন। কিন্তু এ অভিযাত্রা তাদের সফল করতেই হবে। তারা সবাই জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ব্যর্থ হলে জাতি কখনও তাদের ক্ষমা করবে না। (লন্ডন : ২০.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com

গোয়েবলসের পদাঙ্ক অনুসরণ

গোয়েবলসের পদাঙ্ক অনুসরণ


॥ সিরাজুর রহমান ॥

অ্যাডলফ হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাভারিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করপোরাল পর্যন্ত হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে তাকে নবগঠিত জঙ্গি রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠানো হয়। কিন্তু হিটলার নিজেই সে দলে যোগ দেন। হারম্যান গোয়েরিং, রুডলফ হেস, জোসেফ গোয়েবলস প্রমুখের ছোট একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি প্রথমে জার্মানির ক্ষমতা এবং ক্রমে ক্রমে বাকি ইউরোপ দখলের পরিকল্পনা করতে থাকেন। 
ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি সংসদীয় রাজনীতিতে ঢুকে হিটলার কিছুকালের মধ্যেই সে দলের নেতৃত্ব দখল করেন। সে দল রাইখস্টাগে (সংসদ) কিছু আসনও পেয়েছিল কিন্তু হিটলারের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। কিশোর-যুবক ও ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলে তিনি জার্মান আধিপত্য, বিশুদ্ধ আর্য জার্মান রক্ত ইত্যাদি মন্ত্র তাদের মাথায় ঢোকাতে থাকেন। হিটলার তাদের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন যে ইহুদি, কমিউনিস্ট, ট্রেড ইউনিয়নপন্থীরা জার্মান জাতিকে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, আর একশ্রেণীর লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাদের হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে। যুব-কিশোর সংগঠনগুলোকে তিনি এসব শ্রেণীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। 
হিটলারের ভীতিকর উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতালিপ্সাকে বাগ মানাতে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ ১৯৩২ সালে তাকে চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) নিয়োগ করেন। কিন্তু হিটলার হিন্ডেনবার্গের মতলব বুঝে ফেলেছিলেন। তার সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো ১৯৩৩ সালে রাইখস্টাগ পুড়িয়ে দেয়। হিটলার অগ্নিকাণ্ডের সব দোষ চাপিয়ে দেন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। কমিউনিস্ট, ইহুদি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ওপর হামলা শুরু হয়। হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের লিখিত বই, সাময়িকী ইত্যাদি পোড়ানোর কাজ শুরু হয়। জার্মানিতে নাৎসিবাদ এসেছিল এভাবে। 
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন নাৎসিদের প্রচারবিদ। তিনি মনে করতেন বারবার একই কথা প্রচার করা হলে সে কথা শ্রোতার মস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে যায়, মিথ্যাকেও সাধারণ মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করতে শেখে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাকে এবং তার ছোট বোন রেহানাকে রেখেছিল বিশেষ তত্ত্বাবধানে। ভারতীয় নাগরিকদের সাথে তাদের সামাজিক দেখা-সাক্ষাতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ধারণা করা যেতে পারে, সর্বক্ষণ তাদের ভারতের স্বার্থের দিকগুলোই বোঝানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের যেসব রাজনীতিককে ভারত তার স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করে না তাদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের দুই কন্যার মন বিষিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় ছয় বছর ধরে। কিন্তু আর কী করতেন শেখ হাসিনা? এমনও কি হতে পারে যে, নাৎসিদের ক্ষমতাপ্রাপ্তি ও ক্ষমতা স্থায়ী করার কলাকৌশল সম্বন্ধেই পড়ছিলেন অথবা সে বিষয়ে কারো পরামর্শ শুনছিলেন তিনি।
গত প্রায় ২৯ মাসে শেখ হাসিনার উক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার দেখা যাবে, তিনি প্রকৃতই গোয়েবলসের প্রচার-দর্শনে বিশ্বাস করেন। দু-একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে থাকেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়, তার রাজনৈতিক বিরোধীরা ক্ষমতা পেলে তারা চুরি করে। প্রথমেই দেখা যাক দেশের মানুষকে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাসিনা ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নেমেছিলেন এবং গত ২৯ মাসে দেশের মানুষ কী পেয়েছে।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া, দ্রব্যমূল্য সামলে রাখা, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়া, দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলা, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব মিডিয়ায় প্রকাশ করা ইত্যাদি। এই প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে কোনটি রক্ষা করা হয়েছে বলে আপনি এবং আপনারা বিশ্বাস করেন?

বিদ্যুতের সয়লাব দেখছেন প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে এ বছর অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে বলে পত্রিকায় পড়েছি। এত বেশি উষ্ণতা আমি জীবনে মাত্র একবার দেখেছি মিসরে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা আর আরিজোনার মরুভূমিতে তাপমাত্রা এ রকম কিংবা তার চেয়েও কিছু উঁচুতে ওঠে বলে শুনেছি। নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের মানুষ এমন অস্বাভাবিক গরমে অভ্যস্ত নয়, সে জন্য প্রস্তুতও নয় তারা। এই তীব্র গরমে পাখা চালাতে পারলে জীবন একটু সহনীয় হয়ে উঠতে পারত, রাতে তারা একটু ঘুমোতে পারত। বিদ্যুৎ নেই, বাতি জ্বলে না, পাখা চলে না। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আর মশার কামড়ে এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটে যায়। সবাই স্বীকার করবেন দিবারাত্রির মধ্যে কিছুটা সময় গভীর নিদ্রায় বিশ্রাম নিতে না পারলে শারীরিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না, এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে মানুষের আয়ু হ্রাস হয়।
ত্রিপুরা রাজ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যন্ত্রপাতি নেয়া হয়েছে। সে জন্য তিতাস নদীতে এবং তার শাখা-প্রশাখা ও খালে বাঁধ দিয়ে পানির স্রোত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে তাতে। আরো শুনেছিলাম যে, সে বিদ্যুৎ কারখানার জন্য বাংলাদেশের গ্যাস ভারতকে দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। অনেক বড় বড় কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা। বিনা টেন্ডারে ভাড়া করা যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ডার দেয়া হয়েছিল বহু হাজার কোটি টাকার।
তার কোনো সুফল বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পায়নি। বিদ্যুতের অভাব আর রেকর্ড মাত্রার গরমে দেশের মানুষের প্রাণ হাঁসফাঁস করছে, তারা ঘুমাতে পারছে না। তারা স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে বিক্ষোভ করছে, সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে তাদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ থাকবে বলে আশা করা যায় না। কিন্তু ওই যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনা টেন্ডারে ব্যয় করা হয়েছে তার কী হলো? শোনা যাচ্ছে, এ বাবদ ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটা ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ গ্রুপগুলোর মালিক আওয়ামী লীগের নেতারা, কোনো কোনোটির মালিক আবার প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় বলে শোনা গেছে। প্রধানমন্ত্রী গোয়েবলসীয় প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। তার ধারণা বিদ্যুৎ দিয়ে তিনি দেশকে সয়লাব করে দিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা অল্পবিস্তর সবাই জানেন। এই সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির দু’টি ঘটনার বিবরণ বিশ্বব্যাংক সরকারকে দিয়েছিল। ব্যাংক বলেছে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রমুখ দাতা দেশ ও সংস্থা বিশ্বব্যাংকের মতোই বলেছে যে, দুর্নীতির সাজা না হলে তারাও অর্থ জোগান দেবে না। বিশ্বব্যাংক গত সপ্তাহে আরো সাতটি দুর্নীতি সম্বন্ধে সরকারকে তদন্ত করতে বলেছে।

তারা বাড়িতে এসে চোর বলে যাচ্ছেন
এসব অভিযোগই হয়েছে পূর্ববর্তী যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের আমলের ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে। তার বিরুদ্ধে দেশেও অজস্র অভিযোগ ছিল। এমনকি দেশের বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনও করেছিলেন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তাকে এমন একটি দফতরে বদলি করা হয়েছে যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ আরো বেশি বলে শুনেছি। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞ মহলগুলো সন্দেহ করেন সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু নিজের জন্য নয়, আরো ওপরের কারো কারো এজেন্ট হিসেবে দুর্নীতি করছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে সরকারের অনিচ্ছাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং স্বাভাবিক সাহায্যদাতারা পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থসাহায্য দেবে না। দেশে ও বিদেশে সরকারের অপরিসীম দুর্নাম ছড়াচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রীসহ বিদেশীরা বাংলাদেশে এসেও দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তম্বি করছেন। 
এ সরকারের বহু ত্রুটির মতো আরেকটা বদগুণ হচ্ছে তাদের ফাঁকা দম্ভ। তারা বলছে বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই পদ্মা সেতু তৈরি করবে। এখানে-সেখানে তারা সেতুর জন্য ঋণপ্রাপ্তির তদবির চালাচ্ছে। শোনা গেছে, একমাত্র মালয়েশিয়া থেকে একটা প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু তারা সুদ চাইছে বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হারে। সে সুদ শোধ করতে হবে দেশের মানুষকে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই বলে দিয়েছেন চড়া হারে সুদ নেয়ার কোনো চুক্তি হলে বিএনপি সে চুক্তি অনুমোদন করবে না। অর্থাৎ ক্ষমতায় এলে (যেটা এখন অপরিহার্য মনে হচ্ছে) বিএনপি সরকার সে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে না। এমতাবস্থায় কোনো দেশ বা ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেবে বলে মনে হয় না।
আকাশচুম্বী দুর্নীতির অভিযোগ চাপা দেয়ার মতলবে শেখ হাসিনা আবার গোয়েবলসের শরণাপন্ন হয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তিনি জাগিয়ে তুলেছেন, বলেছেন যে বিরোধী দলের নেতার দুর্নীতির বিচার না হলে আর কোনো (দুর্নীতির) বিচার হবে না। হবে কী করে? গদি পেয়েই হাসিনার সরকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮৬টি দুর্নীতি-দুষ্কৃতির মামলা তুলে নিয়েছে। 
এগুলোর মধ্যে ১৫টি মামলা ছিল স্বয়ং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে। একটা মামলা ছিল ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান ক্রয়সংক্রান্ত। সেই মিগ-২৯ বিমানগুলোর কী হয়েছিল কেউ কি জানেন? আরেকটা মামলা ছিল অস্বাভাবিক চড়া দামে কোরিয়া থেকে বিনা টেন্ডারে কোনো রকম অস্ত্রশস্ত্রবিহীন ফ্রিগেট যুদ্ধজাহাজ ক্রয়সংক্রান্ত। আগেই বলেছি, হাসিনার বর্তমান সরকার প্রথম সুযোগেই সেসব মামলা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দোষ এবং সাফসুতরো ঘোষণা করে দিয়েছে। 

খুনি নিজেই তার বিচার করবে 
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরো ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। নিজেদের দুর্নীতির অপরাধ নিজেরা ধুয়েমুছে ফেলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তুলনা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আরেকটা দৃষ্টান্তই দেখুন। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হাতেনাতে ধরা পড়ল। অন্তত সাধারণ বুদ্ধির মানুষ সেটাই মনে করে। সেই গুরুতর অভিযোগ তদন্তের জন্য সুরঞ্জিত নিজে মন্ত্রীর গদিতে বসে তার অনুগত ও অধীনস্থ দু’জন রেল কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। এমন তদন্ত পৃথিবীর কোনো দেশে কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করবে বলে আমার মনে হয় না। 
তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল বলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ২০ ঘণ্টার মধ্যেই (শোনা যায় ভারতের নির্দেশে) শেখ হাসিনা আবার তাকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনেন। তারই নিয়োজিত এবং তার অনুগত ব্যক্তিদের তদন্ত কমিটি এখন বলেছে যে গভীর রাতে সুরঞ্জিতের সহকারী একান্তসচিব ও অন্য দু’জন রেল কর্মকর্তা যে ৭০ লাখ (অথবা চার কোটি ৭০ লাখ) টাকা নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন তার সাথে সুরঞ্জিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ সরকার আর বেশিদিন গদিতে থাকলে খুনি নিজের অপরাধ নিয়ে তদন্ত করবে এবং নিজেকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করবে। দুর্নীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং সুরঞ্জিত দোষী কি না প্রমাণ দিতে পারতেন গাড়ির চালক আজম খান। কিন্তু সে ঘটনার পর থেকেই তাকে গুম করে ফেলা হয়েছে। গোয়েবলসের অনুকরণেই ভিন্নমতাবলম্বী চিন্তাধারার টুঁটি টিপে মারা হচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল বইটি প্রকাশের আগেই সেন্সরশিপের কবলে পড়েছে। সরকারের অনুগত না হলে টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দেশের বহু জেলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে শাসকদলের গুণ্ডারা। দুর্নীতির অভিযোগ ফাঁস করার চেষ্টা করতে গিয়ে টেলিসাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর সাগর সরোয়ার খুন হয়েছেন।
হাসিনা নতুন স্লোগান ধরেছেন গোয়েবলসের অনুকরণেই। তিনি দাবি করছেন ‘বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে অনুকরণীয়’। তার সরকার এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যে বাংলাদেশ আছে সেটা অবশ্যই অনুকরণীয়। বহু বহু সৌকর্য ও সদগুণ আছে বাংলাদেশের মানুষের। কিন্তু যেহেতু মাথা দিয়ে মানুষ চেনা যায় সেহেতু শাসকদের পরিচয় দিয়ে কোনো দেশের বিচার হয় বিশ্বসমাজে। বিশ্বের নেতারা আমাদের দেশে এসেও এ দেশের সরকারকে চোর আর দুর্নীতিবাজ বলে যাচ্ছেন, সেটাকে কেউ অনুকরণযোগ্য মনে করবে না। 
অসংলগ্ন, পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্যই যোগ্য দাবিদার হতেন। তিনি বলে চলেছেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি হয়নি এবং শিগগিরই সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তদন্ত করার জন্য তিনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যাংক ব্যবসায়ীর অধীনে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন, বলেছিলেন যে তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তদন্তের প্রতিবেদনে নাম ধরে অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়েছিল। আবুল মাল আবদুল মুহিত লুটেরাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেননি, কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়নি। 

পুকুরচুরি আর সমুদ্রচুরি
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আবার মুখ খুলেছেন। নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্রণা সয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সুশাসনের অভাবের জন্য দুর্নীতি আর আইনের শাসনের অপব্যবহার দায়ী।’ মুহিত সেখানেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো বলেছেন, ‘পুলিশ ও বিচার বিভাগ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত।’ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ বাহিনী যে আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসেবে কাজ করছে সেটা সবাই জানে, তারা আরো জানে যে এ দেশে এখন ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচার আশা করা যায় না। এখন সেসব সমর্থন করলেন অর্থমন্ত্রী, সব উন্নত দেশেই যে পদটিকে প্রধানমন্ত্রীর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
শেখ হাসিনা এখন কী করবেন? তিনি কি মুহিতকে বরখাস্ত করবেন? আমার মনে হয় না। হাসিনা কি সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন? সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কি মন্ত্রিসভায় ফেরত নিতে বাধ্য হননি? হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয় প্রধানমন্ত্রীদেরও করতে হয়।
হলফ করে এ কথা বলব না যে, খালেদা জিয়ার পূর্ববর্তী তিনটি সরকারের আমলে দুর্নীতি হয়নি। আমার মনে হয় খালেদা জিয়া নিজেও সে দাবি করবেন না। আধুনিক কালে কোনো দেশই জোর গলায় নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত বলে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু দুর্নীতিরও সীমা এবং প্রকারভেদ থাকে। কেউ গাছটার যতœ নেয়, ফল পাকলে পেড়ে খায়; অন্যদের অত ধৈর্য সয় না। ফল পাকলে গাছটাকে কেটে তারা ফল নিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগকে অবশ্যই শেষোক্ত দলে ফেলতে হবে। খালেদা জিয়ার আমলে দুর্নীতিকে যদি পুকুরচুরি বলা যায় শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতিকে অবশ্যই বঙ্গোপসাগর-চুরি বলতেই হবে। তাদের ধৈর্য ও সংযম বলে কিছু নেই। তারা সব কিছুই যথাসত্বর লুটেপুটে খেতে চায়। ১৯৭২-৭৫ সালে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কথা একটু আগেই বলেছিলাম। আর বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি আবারো যে দেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে সে কথা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই স্বীকার করলেন।
খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে হাসিনা যে অনবরত দুর্নীতির অভিযোগ করে যাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং গোয়েবলসীয় দর্শন দ্বারা পরিচালিত। সচিবালয়ে বোমা ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ে একখানি গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির মহাসচিবসহ ৩৩ জনকে কাশিমপুর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলে কয়েদ রাখা যে আশায় করা হয়েছে খালেদা ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগও একই আশায় করা হচ্ছে। সেটা এই যে অভিযোগ প্রমাণ হোক না হোক তার কাদা কিছু পরিমাণে এই নেতাদের গায়ে লেগে থাকবে এবং হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তার থেকে কিছু ফায়দা উঠাতে পারবে। 
লন্ডন, ২২.০৫.১২
serajurrahman34@gmail.com

বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

বিকৃত মানসিকতা সরকারকে অমানুষিক করে তুলেছে



সিরাজুর রহমান
আগেও বহুবার বলেছি এসব কথা—একাধিক বইতে এবং বহু প্রবন্ধ ও কলামে। নতুন পাঠকদের অবগতির জন্য পুনরাবৃত্তি পুরনো শ্রোতাদের বিরক্তি ঘটাবে না আশা করি।
বিবিসি থেকে ১৯৬৯ সালে ‘পাকিস্তানের রাজনীতি’ শীর্ষক একপ্রস্থ সাক্ষাত্কার প্রচার করেছিলাম। তত্কালীন পাকিস্তানের উভয় দিকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম সেজন্য। সেপ্টেম্বরের এক সকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিতে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যাই। মুজিব ভাই ভোরে ভোরে যেতে বলেছিলেন। ভাবী আমাদের নাশতা খাওয়ালেন। সাক্ষাত্কার ছাড়াও পুরনো পরিচয়ের জের ধরে অনেক কথা হয়েছিল।
তখন জোর জল্পনা-কল্পনা চলছিল যে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। সে বছরের জুন মাসে মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। বস্তুত গণআন্দোলনের তোড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার জুন মাসে তাঁকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তাঁর নজিরবিহীন জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করি। তিনি বললেন, দেশে লোকে আমাকে চেনে, জানি; কিন্তু বিদেশে তো কেউ আমাকে চেনে না। আমি বললাম, আপনি লন্ডনে আসুন, বিশ্বমিডিয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো।
সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন এবং আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলাম। ব্রিটিশ ও বিদেশি মিলে ৪১ সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি। বিবিসিতে বাংলায় আমি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাত্কার প্রচার করি। ভাষ্যকার এভান চার্লটনের সঙ্গে তাঁর ইংরেজি সাক্ষাত্কার বিবিসির আরও কয়টি বিদেশি অনুষ্ঠান বিভাগ অনুবাদ করে প্রচার করেছিল।
ভারতে প্রায় ছয় বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন। কিছুদিন পরেই তিনি লন্ডনে আসেন। আমি ঠিক করেছিলাম তাঁকেও মিডিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। বিবিসি বুশ হাউসের বার্তা বিভাগে তাঁর জন্য আমি একটা চা-চক্রের আয়োজন করি। আশা ছিল বিবিসির সব বিভাগের কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে একান্তে তাঁর আলোচনার সুযোগ হবে। কিন্তু হাসিনা এলেন এক পাল চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে। একান্ত আলাপের সুযোগ রইল না। অগত্যা সহকর্মী জন রেনার আর আমি তাঁকে স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলাম বাংলা ও ইংরেজিতে সাক্ষাত্কারের জন্য।
ইংরেজি সাক্ষাত্কারে জন গোড়াতেই হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে তাঁর ভালো লাগছে কিনা। তিনি বললেন, মোটেই না, রাজনীতি তাঁর ভালো লাগে না, রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন। জন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন আপনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হতে গেলেন। আরও বিস্ময় অবশিষ্ট ছিল আমাদের জন্য। হাসিনা বললেন, ওরা তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে, মাকে হত্যা করেছে, ভাইদের হত্যা করেছে, তাঁদের জন্য বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি, প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন।
ইশারায় জনের অনুমতি নিয়ে আমি স্টুডিয়ো ম্যানেজারকে বললাম, রেকর্ডিং থামিতে দিতে। নেত্রীকে বুঝিয়ে বললাম, তাঁর এসব কথা বিবিসি থেকে প্রচারিত হলে রাজনীতিতে তাঁর ক্ষতি হবে। আমার কথা যেন তাঁর বিশ্বাস হলো না। তখন আমি বললাম, বাংলাদেশের সব মানুষেরই তো বাবা-মা খুন হয়নি, তারা কেন প্রতিশোধ নিতে ভোট দিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করবে। যা হোক, সে অংশটা বাদ দিয়ে আবার শেখ হাসিনার সাক্ষাত্কারের রেকর্ডিং শুরু হলো।
হাসিনার প্রতিশোধ
তার পর থেকে বহুবার আমার মনে হয়েছে, হাসিনার সে উক্তিগুলো কথার কথা ছিল না, সত্য সত্যই তাঁর রাজনীতিতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ-বাসনা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের ওপর, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপরই প্রতিশোধ নিতে চান এবং সে স্পৃহা তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন আছেন। তার আগেও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। উভয় মেয়াদেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ। প্রতিশোধের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের অনুপস্থিতিতে ডানে-বাঁয়ে যাকে পাচ্ছেন সবার বিরুদ্ধেই তিনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন বলে মনে হয়। ছায়াছবিতে হয়তো দেখেছেন, গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ চলতে নায়ক রামদা দিয়ে ডানে-বাঁয়ে কুপিয়ে পথ করে নিচ্ছেন।
ছিয়ান্নব্বইতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা একটা সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন। তারা বহু হত্যা-নির্যাতন করেছে। বহু চোরচোট্টা, দাগাবাজ আর খুনি এই ক্যাডারে ঢুকে পড়েছিল। ঢাকার মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. এইচবি ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডাররা বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। লক্ষ্মীপুরে গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে ছিনতাই করে। তাঁর বস্তাভর্তি টুকরো টুকরো লাশ পরে নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। শামিম ওসমানের অত্যাচারে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শামিমের আফিসে মজুত বোমা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁরা কি শাড়ি পরেন নাকি, কেন তাঁরা একটার বদলে দশটা লাশ ফেলতে পারেন না।
চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা ক্যাডারদের মতো আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর গুণ্ডাদেরও লেলিয়ে দিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন করার কাজে। কয়েক হাজার লোককে তারা খুন করেছে। সেইসঙ্গে দলীয়কৃত পুলিশ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। র্যাব কয়েকশ’ কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। এখন আবার চলছে ‘গুম’ করার পালা। সর্বশেষ গুম হয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এবং এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তাঁর ড্রাইভার। তার কয়েক দিন আগে গুম হন সুরঞ্জিতের সহকারী একান্ত সচিবের ড্রাইভার, যিনি সে দুর্নীতি বিজিবির কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া ড্রাইভারদের গুম করার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না।
বহু হাজার মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে এবং হচ্ছে সরকারের প্রতিভূদের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা ৭৮৬টি মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। হালে ঘোষণা করা হয়েছে, আরও ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। ১৯ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বহু দুষ্কৃতকারীকে কারামুক্ত করা হয়েছে। এদের এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর আগাগোড়া ব্যর্থতা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মর্মান্তিক ইতিহাস। তার ওপরও পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি জাতির রক্ত চুষে খেয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি ব্যবসায়িক ‘গ্রুপ’ এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। তেত্রিশ লাখ স্বল্পবিত্ত মানুষ নিজেদের যত্সামান্য সঞ্চয় শেয়ারবাজারে নিয়োগ করেছিলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল সেটাও লুট করেছে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশের ভেতর টাকার স্বল্পতার এই হচ্ছে কারণ।
সরকারের নিয়ন্ত্রিত তদন্ত কমিটি লুটেরাদের তালিকাসহ যে রিপোর্ট দিয়েছে সরকার সেটাও গুম করে ফেলেছে। এই লুটপাটের যারা হোতা তাদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংক দু-দুটি প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজদের নামও বলে দিয়েছে। সেসব নাম প্রকাশ করার সাহস হচ্ছে না সরকারের। জনসাধারণ সঙ্গতভাবেই ধরে নিয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন।
বিপন্ন স্বাধীনতা, বিপন্ন সার্বভৌমত্ব
বাংলাদেশে এখন আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, বিচার নেই, সুশাসন নেই। সময়ে হয়তো সেসবেরও সংস্কার করা সম্ভব হতো, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ‘কমপ্রোমাইস’ করে সে সম্ভাবনার দ্বারও রুদ্ধ করে দিয়েছেন। ভারতকে বিনা মাশুলে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী এবং বন্দরগুলো, অর্থাত্ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মূল উপাদানগুলো উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একথা সর্বত্রই বলাবলি হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের ক্ষতি করে ভারতের কল্যাণ-চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন।
শুনেছি, বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগগুলোতে ভারতীয়রা উপদেষ্টা হয়েছেন। দুর্নীতি ধরা পড়ায় রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সীমান্তের ওপারের নির্দেশে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তাঁকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ প্রকৃতই বিপন্ন। এসব কি প্রমাণ করে না, শেখ হাসিনার প্রতিশোধ নেয়ার পালা আজও শেষ হয়নি? তাঁর নিহত বাবা-মা ও ভাইদের জন্য কেউ কাঁদেনি বলে আজও তিনি বাংলাদেশের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন?
বাংলাদেশের স্বল্পকালের রক্তঝরা ইতিহাসে বহু হিংস্রতা ও রক্তপাত ঘটেছে। পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগের চার নেতা কারাগারেই নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের কারও কারও ছেলেকে হাসিনা তাঁর সরকারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সর্বসাধারণ মনে করেছিল, বংশধরদের মন্ত্রীপদ দিয়ে হাসিনা নিহত নেতাদের স্মৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একটু খতিয়ে দেখলে মনে হবে, শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর প্রতিশোধের অভিযানে সহযোদ্ধাই খুঁজতে চেয়েছেন। বিকল্প ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরে হাসিনার প্রতিশোধ-স্পৃহা তাঁদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।
হাসিনার প্রথম সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। জেলে নিহত নেতাদের একজন ছিলেন তাঁর বাবা। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত প্রায়ই সাধারণ বুদ্ধিকে আহত করেছে। একসময়ে উচ্চ আদালতের বহু সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম বিচারকদের ভয় দেখাতে ‘গজারি কাঠের’ লাঠিধারী ব্যক্তিদের মিছিল নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ভবন প্রদক্ষিণ করেছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্যি তেমন কিছু করার প্রয়োজন হয়নি। সরকার গঠনের শুরু থেকেই ‘কমিটেড’ আওয়ামী লীগপন্থীদের বিচারক নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে সরকার-সমর্থকদের গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা পূরণের রায়গুলো সম্ভব হচ্ছে সে কারণে।
পার্ট-টাইম মন্ত্রীর পার্ট-টাইম মস্তিষ্ক
কারাগারে নিহত নেতাদের অন্য একজনের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অনেকেই বলে থাকেন, উভয় পদেই তিনি ‘পার্ট-টাইম’ দখলদার। ভাং কিংবা আফিমখোর ব্যক্তি যেমন মাঝে মাঝে সজাগ হয়ে চিত্কার করে ওঠে, সৈয়দ আশরাফও তেমনি কিছুদিন নীরব থেকে হঠাত্ করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন। তখন মনে হয়, অতীতের রাজা-বাদশাহদের মতো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করে ছাড়তেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, সৈয়দ আশরাফের মস্তিষ্কও তাঁর মতোই পার্ট-টাইম কাজ করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এর আগে দু’বারের সফর বাতিল করার পর ৫ মে ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বলে গেছেন, মার্কিন সরকার চায়, সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। সব দলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সংলাপের পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন তিনি। তাঁরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় দেশের মানুষ। মোটামুটি একই সময় লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও বলেছেন একই কথা।
হিলারি ক্লিনটন আরও একটা হুশিয়ারি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, এমন কাউকে সত্বর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান নিযুক্ত করতে হবে, যাতে এই বিশ্ববিদিত প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে না যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর বর্তমান সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকের এবং গ্রামীণ ফোনের ওপর যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলের লোলুপ দৃষ্টি আছে সেসব কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন হিলারি। তাঁর হুশিয়ারি ছিল সেজন্য।
‘গোমর ফাঁক’ হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় পার্ট-টাইম মন্ত্রী, পার্ট-টাইম মহাসচিব এবং ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফ গাত্রদাহ সামলাতে পারেননি। অমার্জিত এবং গণ্ডমূর্খের মতো আবোল-তাবোল সমালোচনা করেছেন তিনি ড. ইউনূস এবং কিছু পরিমাণে হিলারি ক্লিনটনের। সেইসঙ্গে নোবেল পুরস্কার কমিটি এবং যাঁরা কমিটির কাছে ড. ইউনুসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, পরোক্ষভাবে তাঁদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেছেন অন্তঃসারশূন্য সৈয়দ আশরাফ। আশরাফ বলেছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে হলে নাকি কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থামাতে হয়। কোন কেতাবে তিনি পড়েছেন সে কথা? ড. ইউনূসের বিশ্ব-সম্মানিত ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার জন্য কেন তাঁর আকুতি?
কোথায় রানী রাসমণি আর কোথায় রইস্যার নানী?
বিশ্বনেতারা কি এতই হাভাতে যে ‘হোয়াইট ওয়াইন’ খেয়ে তাঁরা কাউকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সুপারিশ করবেন? অথবা নোবেল কমিটির সদস্যরা হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে কাউকে পুরস্কার দেবেন? তাই যদি হবে তাহলে শেখ হাসিনা কেন কূটনীতিকদের দেশে দেশে তদবির করতে পাঠিয়েও নোবেল পুরস্কার পেলেন না? আগের বারে তো আমলাদের বহু দেশে পাঠিয়ে ডক্টরেট খরিদ করানো হয়েছিল। তাও একটা-দুটো নয়, পুরো এক ডজন। বিশ্বনেতাদের কিংবা নোবেল কমিটিকে হোয়াইট ওয়াইন খাওয়ানোর সামর্থ্য কি হাসিনার আমলাদের আর কূটনীতিকদের ছিল না?
বুদ্ধিহীনতার প্রতিযোগিতায় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে টেক্কা দিয়েছেন হাসিনার শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। তিনিও সিদ্ধান্ত করেছেন, ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। তাহলে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি কি এই দুই মূর্খ মন্ত্রীর নেত্রী? দিলীপ বড়ুয়ার বিদ্যার আরেকটা মাপকাঠি—তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধে কথা বলতে হলে রাজনীতিতে নামতে হবে ড. ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। অরাজনীতিকদের কি ভোট দেয়ার অধিকার নেই? কেন তাঁরা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না?
শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের এই হচ্ছে নমুনা। মন্ত্রীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লোকের মুখে মুখে। আরও কয়েকজন ষোলো আনা অথর্ব। অর্থমন্ত্রী কখন কী বলেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে এখন দেশের মানুষের মতো বিদেশিরাও হাসাহাসি করে।
ব্যতিক্রম মনে হয় সোহেল তাজকে। তাঁর বাবা তাজউদ্দিন আহমদ একাত্তরে নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পঁচাত্তরে জেলে নিহত নেতাদের তিনি অন্যতম। হাসিনা সোহেলকে স্বরাষ্ট্র দফতরে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। কিছুকাল পরেই তিনি আমেরিকায় পরিবারের কাছে ফিরে যান। প্রথমে তিনি ছুটির আবেদন করেন, পরে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান। তাঁর পদত্যাগ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেন, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আড়াই বছরের বেতন-ভাতা ইত্যাদি ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়েছে। সোহেল তাজ তার প্রতিবাদ করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও পদত্যাগপত্র পাঠান স্পিকারের কাছে। হয়তো গণভবনের নির্দেশেই স্পিকার সোহেলের পদত্যাগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে যাচ্ছেন। সোহেল তাজ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, বলেছেন, অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ গৃহীত এবং ব্যাংক থেকে তাঁর প্রাপ্য নয়, এমন টাকা ফেরত নেয়া না হলে তিনি অনেক গোমর ফাঁক করে দেবেন।
ধারণা করা হয় মন্ত্রীপদে কিছুকাল থেকেই সোহেল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুর্নীতি আর অপকর্মের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন। গা-বাঁচানোর জন্যই তিনি আমেরিকায় ফেরত গিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে, সরকার কেন চায় না যে তিনি মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিন? একটা কারণ অবশ্যই এই যে, তাঁর আসন শূন্য হলে সেখানে উপনির্বাচন দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের গণসমর্থন-হীনতা প্রমাণ হয়ে যাবে। অন্য একটা কারণ অবশ্যই নিহিত আছে সোহেল তাজের হুমকির মধ্যে। কী গোপন তথ্য তিনি ফাঁস করতে চান এবং সে ভয়ে সরকারই বা কেন এমন আতঙ্কিত?
প্রাচ্যের মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতেও বিশ্বাস করা হয় যে, বিধাতা কাউকে ধ্বংস করার আগে তাকে উন্মাদ করে দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের আর সে দলের নেতাদের কাণ্ডকারখানা কি সে অবস্থারই ইঙ্গিত দেয় না? (লন্ডন, ১৩.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

ভিআইপিদের সফর বাংলাদেশকে কোথায় রেখে গেছে

ভিআইপিদের সফর বাংলাদেশকে কোথায় রেখে গেছে


॥ সিরাজুর রহমান ॥

যে ব্যক্তি এবং যে জাতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি তারা সব সময়ই আশা করে বসে থাকে ‘আত্মীয়বাড়ির লোকেরা’ তাদের জন্য মণ্ডা-মিঠাই আনবে, তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। কোথাকার কোন বিদেশী তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা বাংলাদেশে আসবেন সে নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়ার মাতামাতিতেও আমাদের পরমুখাপেক্ষিতার প্রমাণ বহন করে।
হিলারি কিনটন কিংবা প্রণব মুখার্জি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। স্বল্প সফরে হলেও তারা এসেছিলেন এবং তারা চলেও গেছেন। মামাবাড়ির অতিথিরা চলে যাওয়ার পর শিশুরা ভাবতে বসে, মিষ্টি কি তারা যথেষ্ট খেয়েছে, আরো কিছু খেতে পারলে মজা বেশি হতো। হিলারি আর প্রণবের সফরের পরে মিডিয়ারও যেন হয়েছে সে অবস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি। বহু দেশে বহু ব্যাপারে সে এখনো কলকাঠি ঘোরায়। বাংলাদেশে অত্যন্ত দৃশ্যমান ভাবে ঘুরিয়েছিল ২০০৬-২০০৮ সালে। ভারতের রাষ্ট্রদূত আর কিছু পরিমাণে হলেও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে সাথে নিয়ে তারা একটা বর্ণচোরা সেনাশাসন চালু করেছিল। এখন আর বুঝতে বাকি নেই, একটা ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা অনুযায়ী বিএনপিকে ধ্বংস করা এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা ভারত-মার্কিন আজ্ঞাবহ সরকার স্থাপন করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই তিনটি দেশের পরিকল্পনা আর ইকোনমিস্ট সাপ্তাহিকীর ভাষায় ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শে’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর হিসাবে কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিল। অন্য বড় পৃষ্ঠপোষককে উপেক্ষা করে তিনি নিকটতম পৃষ্ঠপোষক ভারতের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ড. ইউনূসকে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বরখাস্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বহু দেশে ইউনূসের বহু গুণগ্রাহী ও বন্ধুকে আহত করেছেন। হিলারি কিনটন তখন দীর্ঘ টেলিফোন বার্তায় চাঁচাছোলা ভাষায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে মার্কিন কলকাঠি নাড়ানোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেছনের দরজা দিয়ে সে কথোপকথনের আক্ষরিক বিবরণ বিশ্ব মিডিয়ায় ফাঁসও করে দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভুল করেছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, আমেরিকা তার নতুন পাওয়া বন্ধু ভারতকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। সুতরাং ওয়াশিংটনকে হেনস্তা করে আসলে তিনি দিল্লিকে বিশেষ সন্তুষ্ট করেননি। দিল্লি তাকে চিরকাল গদিতে আসীন রাখবে এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি দিল্লির সব চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মার্কিন সরকারের অসন্তুষ্টির প্রমাণ হিসেবে হিলারি কিনটন বাংলাদেশে দু’টি প্রস্তাবিত ও নির্ধারিত সফর বাতিল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও দিল্লির প্রভাবে ওয়াশিংটন ঢাকার প্রতি তার বিরক্তির বাড়াবাড়ি হতে দেয়নি। গত সপ্তাহে (৫ মে) একই দিনে হিলারি কিনটন আর ভারতের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত সফরে হলেও ঢাকা আগমন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। 

হিলারির ক্রোধের কি উপশম হয়েছে?
হিলারি ঢাকা এসেছিলেন চীন থেকে। তার বেইজিং সফরের সময় অন্ধ মানবাধিকার আইনজীবী চেনের ব্যাপার নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে লক্ষণীয় উত্তেজনা দেখা দেয়। হিলারির আসল উদ্দেশ্য তাতে কতখানি প্রভাবিত হয়েছে বলা কঠিন। বাহ্যতই তিনি অর্থনৈতিক বিষয়াদি (মূলত চীনের কাছে আমেরিকার বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি ও ঋণ) এবং সাধারণভাবেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার কার্যকাল শেষ হয়ে যেতে পারে। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু ও পরিচিতদের তিনি বিদায় সম্ভাষণ জানাতে চাইবেন।
কিন্তু আরেকটা ব্যাপার এখন ওয়াশিংটনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি করে চলেছে। ভারত মহাসাগরে বেশ ক’টি নৌঘাঁটি তৈরি করেছে সে। এতদঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব অত্যধিক বেড়ে যাক সেটা ওয়াশিংটনের কাম্য নয়। আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়া নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে একটা স্বাভাবিক বৈরিতা ভারতেরও আছে। তবে চীনের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক বিরোধ হচ্ছে সীমান্ত নিয়ে। বিশেষ করে অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার মালিকানা নিয়ে ১৯৬২ সালের নভেম্বরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে, কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে একটা বলয় ও বেষ্টনী তৈরি করা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অভিন্ন স্বার্থ।
সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও আমেরিকা অনুরূপ একটা বেষ্টনী তৈরি করেছিল। তখন ভারত ছিল সোভিয়েটের প্রধান মিত্র। মার্কিন বেষ্টনী সে জন্য তৈরি হয়েছিল অবিভক্ত পাকিস্তানকে নিয়ে। কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা সেন্টো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিয়াটোতে পাকিস্তান সদস্য হয়েছিল। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় ১৯৭০-৭১ সালে বেইজিংয়ের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে অনেক উন্নতি হয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর ওয়াশিংটনের মনোযোগ পড়ে চীনের দিকে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে মত ও পথের ভিন্নতার কারণে পাক-মার্কিন সম্পর্ক এখন বড়জোর একটা ‘ক্ষুব্ধ পারস্পরিক সহনশীলতার’ স্তরে নেমে এসেছে। তা ছাড়া পাকিস্তান এখন চীনের সাথে বন্ধুত্বকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে। 
আরো একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। চীনের বিরুদ্ধে তারা মিত্র হলেও ভারত মহাসাগরে প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে পারস্পরিক একটা রেষারেষিও আছে তাদের মধ্যে। বিগত কয়েক বছরে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে দেখেছে দিল্লির চোখ দিয়ে। দিল্লির প্রতি নতজানু ভাব দেখে মার্কিনিরা ধরেই নিয়েছিল যে, বাংলাদেশ মার্কিনিদের নতুন মিত্র ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে না। কিন্তু অতি সম্প্রতি এতদঞ্চলে ওয়াশিংটনের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। 

উপদেশের পরিস্থিতিতে তৃতীয় মাত্রা
মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা খুবই সীমিত আকারে কিছু রাজনৈতিক সংস্কার করেছেন। তাদের এক ইঞ্চি সংস্কারের বিনিময়ে ওয়াশিংটন ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ইতোমধ্যে কয়েক গজ পুরস্কার দিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারকে। ওয়াশিংটন আশা করছে, বিনিময়ে চীনের প্রভাব কাটিয়ে মিয়ানমার পশ্চিমের দিকে ঝুঁকবে। তেমন অবস্থায় চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন বলয়টি বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রসারিত হবে। তা ছাড়া মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে বিপুল গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় মার্কিন তেল কম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগে নেমেছে। এই বিনিয়োগ রক্ষার নামে বঙ্গোপসাগরে একটা ‘ফুটপ্রিন্ট’ স্থাপন ওয়াশিংটনের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। অর্থাৎ ভারতের চোখ দিয়ে দেখার পরিবর্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ওয়াশিংটন এখন সরাসরি নিজের চোখ দিয়েই দেখবে। হিলারি কিনটন ও প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত সফরকে এ আলোকেই দেখতে হবে। 
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানেই যার সাথে কথা বলেছেন, সবাইকে তিনি বলে দিয়েছেন, আগামী বছর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় ওয়াশিংটন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে এবং অন্যত্রও তিনি বলেছেন, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য বড় দুই দলকে সংলাপে বসতে হবে। ১৮ দলের জোটের প্রতিনিধি খালেদা জিয়া এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রমুখ যাদের সাথে তার দেখা হয়েছে, তারা সবাই হিলারিকে পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ছাড়া গত্যন্তর নেই।
হিলারি নিজেও কিছু স্পষ্ট কথা বলে গেছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে। তিনি বলে গেছেন, ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশ হওয়া এবং বস্ত্র শ্রমিকদের নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যা সম্বন্ধে তদন্ত হতে হবে। (প্রায় একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বলেছে, গুম আর খুনের ঘটনাগুলো বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপন করছে।) বাংলাদেশে মানবাধিকারের শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধেও হিলারি সরকারকে তম্ভি করে গেছেন। সরকারকে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন, গ্রামীণ ব্যাংককে অনুপযুক্ত কারো হাতে ন্যস্ত করা ওয়াশিংটনের গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, আমিনুল ইসলামের হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন না হলে মার্কিন আমদানিকারকেরা বাংলাদেশকে সুনজরে দেখবে না অর্থাৎ বাংলাদেশের রফতানি (বিশেষ করে বিনা শুল্কে রফতানি) বৃদ্ধি পাবে না। 

প্রণব মুখার্জির নতুন বোধোদয়?
সবচেয়ে বড় কথা, হিলারি কিনটন বাংলাদেশ সরকারের আয়োজিত নৈশভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে তিনি জানিয়ে দিয়ে গেলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর ওয়াশিংটন মোটেই প্রীত নয়।
প্রণব মুখার্জি বাহ্যত এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের যবনিকাপাত করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে, সেটা অছিলামাত্র ছিল। কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথাও তিনি ঘোষণা করেছেন। যেমন গত বছর বাংলাদেশকে ১.৭৫ শতাংশ সুদে দেয়া ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের ২০ কোটি মওকুফ ঘোষণা করেছেন তিনি এবং বলেছেন, সুদের হারও কমিয়ে ১ শতাংশ করা হবে। মনে হচ্ছেÑ এখানে কিছু ছাড় দিয়ে ভারত করিডোর, ট্র্যানজিট এবং বাংলাদেশী বন্দরগুলোর ব্যবহারও অনুদান হিসেবেই পেতে চায় বর্তমান সরকারের কাছ থেকে। প্রণব মুখার্জি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সাথে পুরনো চুক্তিগুলো কার্যকর করার লক্ষ্যে সর্বভারতীয় জনমত সৃষ্টি করতে চায়। 
দুই দেশের সম্পর্কে সব কিছুই যে সঠিক পথে যাবে না এ উক্তি থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ৬৫ বছর ধরে ভারত বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশী জমি ও ছিটমহল ইত্যাদি দখল করে আছে। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্তগুলোও ভারত পালন করেনি। দিল্লির দিক থেকে বক্তব্য : সব অঙ্গরাজ্যের সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না বলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যাচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর উপলক্ষে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। শেষ মুহূর্তে সই করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে সামান্যতম পানি দেয়ার ব্যাপারেও বেঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছেÑ দিল্লি এ রাজ্য-সে রাজ্যের অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করছে না এবং লোকসান হচ্ছে বাংলাদেশের। এমন অনির্ভরযোগ্য চুক্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রণব মুখার্জির সফরের পরে দিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশকে কোনো আশার বাণী শোনানো হয়নি।

সুস্থ পরিবর্তন?
প্রণব বাবু এর আগে কোনো কোনো সফরে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ না করে কূটনৈতিক অসৌজন্য দেখিয়েছিলেন। আলোচ্য সফরে তিনি বেগম জিয়ার সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করেছেন। আর একটা আশার কথা তিনি শুনিয়ে গেছেন এ সফরে। তিনি বলেছেন, ভারত বন্ধুত্ব করতে চায় বাংলাদেশের সাথে, বিশেষ কোনো দলের সাথে নয়। এত দিন পর্যন্ত ভারতীয় মন্ত্রীদের মধ্যে প্রণব বাবুই বেশি সোচ্চারভাবে বলতেন, ভারত শেখ হাসিনাকে গদিতে বহাল রাখবে। বাংলাদেশে কোন দল নির্বাচনে জয়ী হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন ইত্যাদি সব ব্যাপারে ভারত যদি প্রকৃতই হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে সেটা প্রকৃত সুসম্পর্কের জন্য সহায়ক হতে পারে।
হিলারি ও প্রণবের সফরের পর থেকে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া কৌতুককর। সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের রণহুঙ্কার কিছুটা কমেছে। শাসক দলের মহাসচিব সংলাপের প্রয়োজন স্বীকার করে নিয়েছেন বলেই মনে হয়। ওদিকে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে এক সপ্তাহের জন্য হলেও আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। মার্কিন ও ভারতীয় মন্ত্রীদের সফরকে সম্মান দেখিয়ে এগুলো বিএনপি নেতাদের ফাঁদে ফেলার জন্য আওয়ামী লীগের চালও হতে পারে। অন্য দিকে বিএনপির যে মহলটি আন্দোলনের বিপক্ষে তাদের ভাবখানা এমন যে, তারা লঙ্কা বিজয় করে ফেলেছেন। সেটা খুবই ভুল হচ্ছে বলে ধারণা। 
খুব সম্ভবত এ কৌশল আওয়ামী লীগ নিচ্ছে বিএনপির আন্দোলনকে শুধু ঝিমিয়ে দেয়া নয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। আন্দোলন করে তারা যে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাতে পারে, সেটা প্রমাণ করা বিএনপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চোখ রাঙিয়েছে, আন্দোলনের ভয় দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের সে দেমাগ অক্ষত থাকতে দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। বিদেশের চাপে পরবর্তী নির্বাচনে যদি বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট জয়ীও হয়, তাহলেও কথা থেকে যাবে কত দিন তারা খালেদা জিয়াকে শান্তিতে শাসন করতে, গদিতে টিকে থাকতে দেবে। গণ-আন্দোলনের জোয়ার পুরোপুরি থিতিয়ে পড়ার আগে ১৮ দলের জোটের নেতাদের উচিত হবে এ সরকারকে শেষ ধাক্কা দেয়া, এটা প্রমাণ করা যে, ভবিষ্যতে আর আন্দোলন-হরতালের হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে পারবে না।
সরকার এখনো তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনেনি। ইলিয়াস আলীকে তারা এখনো মুক্তি দেয়নি। শীর্ষ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলাগুলো এখনো তুলে নেয়া হয়নি। বরং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রমুখ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আন্দোলনে ঢিল দিলে বিএনপি নেতারা দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হবেন। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কেউ আর কখনো আন্দোলনে যাবে না। 
(লন্ডন, ০৯.০৫.১২) 
serajurrahman34@gmail.com

মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ রাজনীতি এখন আর সম্ভব নয়



সিরাজুর রহমান
গভীর সঙ্কটে এখন বাংলাদেশ। সঙ্কট সবারই। সরকারের সামনে মহাচ্যালেঞ্জ। তারা গদি চিরস্থায়ী করতে চায়। সেজন্য তাদের প্রয়োজন ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ এবং নিজেদের আত্মাকেও বিকিয়ে দেয়া। দেশের মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ : তারা সীমাতীত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা হাতছাড়া হতে দেবে না। সরকারবিরোধী বিএনপি এবং গণতন্ত্রকামী ১৮ দলের জোটের জন্য চ্যালেঞ্জ : যে কোনো মূল্যে তারা এই ফ্যাসিস্ট সরকারের অসদুদ্দেশ্য প্রতিহত করবেই।
সরকার এখন মরিয়া। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে জনসাধারণ যেমন সংগঠিত ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে ছলে-বলে-কৌশলে সেটাকে দলন করা না গেলে গদি আর টেঁকে না। শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর ভারতে নির্বাসিত ছিলেন। তখন তার ও তার বোনের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের ওপর। অনেকে বলেন, সে সময় র‘ তার মগজ ধোলাই করে দিয়েছিল। ভারতের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু তাঁর মাথায় ঢোকে না। গদি পাওয়ার দিনটি থেকে তিনি সব বিরুদ্ধ রাজনৈতিক সত্তাকে বিলুপ্ত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন।
বিরোধী দলকে সভা-সমিতি কিংবা মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো অপকৌশলই বাদ দেয়া হয়নি। সরকারের বিরোধী ও সমালোচক হাজার হাজার নেতাকর্মীকে খুন করা কিংবা কয়েদ করে রাখা হয়েছে। ভারত ও আমেরিকার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় ইসলামী সন্ত্রাসী অপবাদ দিয়ে টুপি-দাড়ি-পরিহিত অজস্র বিশ্বাসীকে বন্দী করা হয়েছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকারবিরোধী ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের জেলে ও রিম্যান্ডে নির্যাতন করা হচ্ছে।
প্রধান বিরোধী বিএনপি দলে আন্দোলনের মত ও পথ নিয়ে মতদ্বৈধের কারণে অথর্ব ও স্বাধীনতার দুশমন সরকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব করে সুযোগ ও ইনিশিয়েটিভ হাতছাড়া করা হয়েছে। ছোটখাটো গণতান্ত্রিক দলগুলো স্বতন্ত্র অস্তিত্বের দম্ভের কারণে ঐক্যবদ্ধ হতে অযথা বিলম্ব করেছে। সুযোগকে প্রথম সুযোগেই গ্রহণ করতে হবে—এ মর্মে প্রবাদ বহু দেশে বহু ভাষাতেই আছে। কিন্তু সেগুলো এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের কানে পৌঁছায়নি বলেই মনে হয়। সরকার সে সুযোগে গণতন্ত্রের সব পথে পদে পদে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছে। যতই দিন যাচ্ছে বিরোধী দলগুলোর কাজ ততই দুরূহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জনসাধারণ গোড়া থেকেই এ সরকারকে চিনে ফেলেছে। দশ টাকা কেজির চাল, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্, বিনামূল্যে ফার্টিলাইজার ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি যে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রাতারাতি ধনকুবের বানানোর অজুহাত ছিল সেটা বুঝে উঠতে কারও কষ্ট হয়নি। এটাও তারা বুঝে গেছে যে, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের প্রতিশ্রুতি শুধুই জনসাধারণকে প্রতারণা করার ছল ছিল। কিন্তু যখন থেকে তারা বুঝতে পেরেছে যে তাদের স্বাধীনতা বিপন্ন, ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি‘ লেখা নামাবলী গায়ে দিয়ে এ সরকার তাদের দেশকে ভারতের হাতে তুলে দিতে উদ্যত হয়েছে, তখন থেকে সাধারণ মানুষও আন্দোলনমুখী হয়ে উঠেছে, এ সরকারের অসদুদ্দেশ্যগুলো প্রতিহত করতে তারা রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত হয়েছে। খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের আন্দোলনে ষোলআনা সমর্থনের এই হচ্ছে কারণ।

নির্যাতনের মানচিত্র
গদি হারানোর ভয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছে সরকার। অত্যাচার নির্যাতন হিটলারের ফ্যাসিস্ট নািসদেরও হার মানাতে চলেছে। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি নানা নামে বিনাবিচারে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী বিচার-বহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল ১৫৪, ২০১০ সালে ১২৭ এবং ২০১১ সালে ৮৪ জন। গত মাসে (এপ্রিল) বিচার-বহির্ভূতভাবে খুন হয়েছে ১১ জন। আন্তর্জাতিক সমালোচনার তোড়ে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করা হলেও গুম করে খুনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে গুম হয়েছিল ২ জন। ২০১০ সালে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৮ আর ২০১১ সালে ৩০ জন। এ যাবত্ গুম হওয়াদের সংখ্যা ১২২-এ দাঁড়িয়েছে বলে বিভিন্ন হিসাবে জানা যাচ্ছে।
সর্বশেষ গুম হয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। তিনি বরাক নদীর ওপর ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন; তিতাস নদী আর ১৪টি শাখা নদী ও খালে বাঁধ বেঁধে উত্তর-পূর্ব ভারতে যন্ত্রপাতি কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর জন্য বিশাল বিশাল ট্রেইলার পাঠানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অনেকের মতে, তাঁকে গুম করার পেছনে আরও একটা বড় কারণ আছে। এ ঘটনার আগে আগেই রেল মন্ত্রণালয়কে ঘিরে বিরাট একটা দুর্নীতি ধরা পড়ে যায়। মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিবের গাড়ি থেকে গভীর রাতে ৭০ লাখ (কোনো কোনো খবর অনুযায়ী চার কোটি ৭০ লাখ) টাকা পাওয়া যায়। সে গাড়িতে আরও ছিলেন বাংলাদেশ রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক এবং নিরাপত্তা প্রধান। সে রাতে এবং পরদিন তারা সবাই বলেছিলেন যে, সে গভীর রাতে তারা যাচ্ছিলেন রেলমন্ত্রীর বাসায়।
সুরঞ্জিত ও সরকার গোড়ায় দুর্নীতির এই রাঘব বোয়ালকে চাপা দিতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টার মতোই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। শোনা যায় বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে হাসিনা আগে থাকতেই সুরঞ্জিতের পদত্যাগ চেয়েছিলেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে সীমান্তের ওপার থেকে। পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গভীর রাতে আবার তাকে মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দেয়া হলো। শোনা যায় তার আগে আগেই ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন।
সুরঞ্জিতের দুর্নীতি এবং ইলিয়াসকে গুম
সভ্য দেশে হলে এ কেলেঙ্কারির কারণে শুধু সুরঞ্জিতই নন, গোটা সরকারকেই পদত্যাগ করতে হতো। বর্তমান বাংলাদেশকে সুসভ্য দেশ বলতে হলে এ দেশের বর্তমান সরকারকে অসভ্য বলতেই হবে। অন্যায় স্বীকার করে পদত্যাগ করার মতো মাহাত্ম্য এ সরকারে কারও আছে বলে বিশ্বাস করা যায় না। অনেকেই বিশ্বাস করেন, সুরঞ্জিতকে নিয়ে কেলেঙ্কারি থেকে জনমতকে ভিন্নমুখী করা ইলিয়াস আলীকে গুম করার আরও একটা কারণ ছিল।
বাংলাদেশের মন্ত্রীরা হয় এদেশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, নতুবা তারা মিথ্যা কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আরও একবার সেটা প্রমাণ করলেন। তিনি বলেছেন, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া উদ্বেগের ব্যাপার হলেও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগের বিষয় নয়। মানুষকে ছিনতাই করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, কারও কারও লাশ পাওয়া গেলেও অধিকাংশেরই আর কোনো সন্ধান মিলছে না—এসব যদি উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতি না হয় তাহলে দীপু মনির আবার স্কুলজীবন থেকে শুরু করে কিছু লেখাপড়া শিখে আসা উচিত। দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে অজ্ঞতা ও হৃদয়হীনতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। বিশ্বসমাজ অনেক আগেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ওকাদা গত শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কিছু সমস্যা আছে।’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় দীপু মনির উপস্থিতিতেই বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যা আর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য অনুরোধ করেছেন। ড. ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে বৈঠকে হিলারি বলেছেন, আমিনুল ইসলামের হত্যা সম্বন্ধে তদন্তে সরকারের ব্যর্থতা মার্কিন ক্রেতাদের কাছে ভুল সঙ্কেত পাঠাবে। নির্লজ্জ এবং হৃদয়হীন না হলে দীপু মনি বলতে পারতেন না, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগের বিষয় নয়।’
ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মন্ত্রীদের উল্টোপাল্টা এবং পরস্পরবিরোধী উক্তি বস্তার ভেতর ছুঁচোদের উন্মাদ ছুটোছুটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোড়ায় বলেছিলেন, ইলিয়াস আলী খালেদা জিয়ার নির্দেশে আত্মগোপন করে আছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনা গণভবনে স্বামীর মুক্তির প্রার্থনা নিয়ে শেখ হাসিনার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। সে হৃদয়বিদারি পরিস্থিতিতে হাসিনা লুনাকে বলেছিলেন যে তার স্বামীর সন্ধান করা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য।
কিন্তু তার আগেই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী মন্নুজান ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে বিধবা বলে উল্লেখ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন যে ইলিয়াসকে জীবিত উদ্ধারে সরকার আশাবাদী। আর দলের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন, ‘নিজের সৃষ্ট সন্ত্রাসের দ্বারাই ইলিয়াস আলী খুন হয়েছেন।’ এ কয়টি উক্তি থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এ সরকার, এ মন্ত্রিসভাকে কিছুতেই সুগঠিত কিংবা সুশৃঙ্খল বলা যাবে না। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ হয়তো ঠিকই বলেছেন যে ইলিয়াস আলীর খবর জানেন একমাত্র শেখ হাসিনা। কেননা, কোনো কোনো তথাকথিত নিরাপত্তা সংস্থার কাজকর্ম সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও কিছু জানেন বলে মনে হয় না।

গণতন্ত্রের আন্দোলন
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি এ সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমান পর্যায়ের আন্দোলন ও হরতাল শুরু করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবিতে। দেশের অন্যতম শীর্ষ আইনবেত্তা ড. কামাল হোসেন গত সপ্তাহে আবারও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যে রায়ে আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন সে একই রায়ে আদালত আরও বলেছিলেন যে দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আগামী আরও কয়টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে হতে পারে। কিন্তু রায়ের এ অংশের পরোয়া না করেই সরকার সে পদ্ধতি বাতিল করে দেয়।
স্মরণীয় এই যে, ১৯৯৬ সালে এ পদ্ধতির দাবিতে শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে হরতাল ও আন্দোলন করেছিলেন এবং সে আন্দোলনে প্রচুর রক্ত ঝরেছিল। সে পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার যে আদাজল খেয়ে লেগেছেন তার কারণ বুঝতে কারও বাকি নেই। দলীয়কৃত প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পরিচালনায় সাজানো-পাতানো নির্বাচন ছাড়া হাসিনা ও তার সরকারের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। বিএনপির আন্দোলনে দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। সব আকারের গণতন্ত্রমনা দলগুলোর জোট গঠনের ফলে আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। খালেদা জিয়া সরকারকে ‘আলটিমেটাম’ দিয়েছিলেন ১০ জুনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা না হলে তারা সরকারের পতনের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করবেন।
তারপর থেকে পরিস্থিতির নাটকীয় ও শোচনীয় অবনতি ঘটেছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি ইলিয়াস আলীকে গুম করা মাত্র একটা ব্যাপার। ইলিয়াসকে গুম করার বিরুদ্ধে ১৮ দলের জোটের প্রতিবাদ মিছিলের ভেতরে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ঢুকে একটা নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন স্বয়ং স্বীকার করেছেন, প্রতিপক্ষের হরতাল ঠেকাতে তিনি এই ক্যাডারদের নামিয়েছেন। তারা বিশ্বনাথে তিনজন, লক্ষ্মীপুরে একজনসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। বিশেষ করে বিশ্বনাথে প্রমাণ হয়েছে, যে বুলেটে বিরোধী জোটের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ কিংবা র্যাবের অস্ত্রশস্ত্রে সেসব বুলেট ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
শাসক দলের চররা মিছিলের ভিড় থেকে সচিবালয়ে ককটেল বোমা ছুড়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের কাছে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে এবং এ জাতীয় আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পুলিশ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদসহ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে এবং দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে তাদের বাসভবনে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে। অধিকাংশ নেতাই সরকারের মতলব বুঝতে পেরেছেন, অন্য কোথাও সরে থেকেছেন।
সরকারের উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল নেতাদের (ব্রিটিশ আমলের মতো) জেলে পুরে রাখলে নেতৃত্ব ও নির্দেশনার অভাবে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়বে। বাস্তবেও অনেকেরই এখন সে আশঙ্কা। মে দিবস এবং হিলারি ক্লিনটন ও প্রণব মুখার্জির সফর উপলক্ষে ১৮ দলের হরতাল স্থগিত রাখা হয়েছে। সবাই স্বীকার করবেন, গণআন্দোলনের প্রকৃতি এই যে অগ্রগতি স্থগিত করা হলে সে আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পায়।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আন্দোলন স্থগিত রাখা কিংবা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া না হলে জনগণ নিজেরা উদ্যোগী হয়েই আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম। গান্ধী-নেহরু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশরা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বকে জেলে পুরে রাখলেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। একাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় সহযোগিতা করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সবাই পালিয়ে গিয়ে দিল্লি সরকারের অতিথি হয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ থেমে যায়নি, মেজর জিয়াউর রহমান প্রমুখ বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তা ও কিছু বুদ্ধিজীবীর অনুপ্রেরণায় সাধারণ মানুষও দেশ স্বাধীন করতে এগিয়ে এসেছিল, স্বাধীনতার জন্য তারা প্রাণ দিয়েছিল।

রিমান্ডের নির্যাতন
অতীতে যেমন দেখা গেছে, এবারও কোনো কোনো মহল সরকারের হয়ে নির্লজ্জ দালালি শুরু করে দিয়েছে। এ সরকারের আমলে লাভবান হয়েছেন এফবিসিসিআইর সদস্যরা। শান্তিতে মুনাফার অঙ্ক বৃদ্ধি করে যাওয়ার লক্ষ্যে এ সংস্থা হরতাল নিষিদ্ধ করে আইন করার দাবি জানিয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় হরতাল কেউই চায় বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু যে যে কারণে হরতাল হচ্ছে সে কারণগুলো দূর করার জন্য কী করেছেন এফবিসিসিআইয়ের সদস্যরা? হিলারি ক্লিনটন যে কূটনৈতিক ভাষায় বলে গেলেন, আমিনুল ইসলামের হত্যার তদন্ত না হলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পাবে না, সে ব্যাপারে কী করছে এফবিসিসিআই? দলীয়কৃত পুলিশ-র্যাব আর আওয়ামী লীগের ক্যাডারগুলো যে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করছে সে ব্যাপারে কী করছে তারা? অথবা পাইকারি ধরপাকড় ও ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে?
বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারা বলছেন গ্রেফতারের ভয়ে নয়, রিমান্ডের ভয়েই তারা ধরা দিচ্ছেন না। সেটা অবশ্যই সত্যি কথা। বর্তমান সরকারের আমলে গ্রেফতার ও বিচারের মধ্যবর্তী পর্যায়ে রিম্যান্ড নামক নতুন একটা নির্যাতনযন্ত্র সংযুক্ত হয়েছে। বিচারের আগেই বন্দিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়, তাতে নিশ্চয়ই সরকারের শীর্ষ নেতাদের কারও কারও গায়ের জ্বালা মেটে। দেশের মানুষ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে রিমান্ডে নির্যাতন চালিয়ে তারেক রহমানের কোমর ভেঙে দেয়া হয়েছিল। সে অবস্থার জন্য এখনও তার চিকিত্সা চলছে।
নেতাদের ভয়ভীতি ও আশঙ্কার প্রতি জনসাধারণের ষোলআনা সহানুভূতি আছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে ১০ জুন পর্যন্ত ঝিমিয়ে পড়ে থাকলে আন্দোলন অবশ্যই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তারপরে আবার আন্দোলনে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। আমার মনে হয়, এ অবস্থায় নেতাদের উচিত জনসাধারণকে আগেভাগেই সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয়া। সে নির্দেশগুলো হবে : তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা, ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফিরিয়ে দেয়া, আটক নেতাদের মুক্তি ও তাদের প্রতি ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করা এবং জামিন প্রভৃতি বিচার পদ্ধতিতে বাধা দেয়ার জন্য র্যাব ও পুলিশ দিয়ে উচ্চ আদালতের বেষ্টনী তুলে নেয়া পর্যন্ত লাগাতার হরতাল ও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
তারপর নেতারা সর্বসাধারণের সামনে এবং সম্ভব হলে সভা-সমাবেশ ডেকে সদলবলে গ্রেফতারবরণ করতে পারেন। তাতে বিশ্বব্যাপী জোরালো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। তেমন অবস্থায় এ সরকারও খুব সম্ভবত তাদের ওপর নির্যাতন চালাতে সাহস পাবে না। তাছাড়া সাময়িকভাবে গ্রেফতার এড়াতে পারলেও তাদের কেউ কেউ যে ‘গুম’ হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? মনে রাখতে হবে ‘গুম’ হওয়ার চাইতে গ্রেফতার হওয়া অনেক ভালো। তাছাড়া সাধারণ মানুষ যেখানে অহরহ নির্যাতিত হচ্ছে সেখানে নেতারা নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপন করে থাকলে জনমনে ভালো ধারণা সৃষ্টি হয় না। (লন্ডন, ০৬.০৫.১২)
serajurrahman@btinternet.com

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

অন্যায়ের দেশ- আজকের বাংলাদেশ

অন্যায়ের দেশÑ আজকের বাংলাদেশ


॥ সিরাজুর রহমান ॥

কলকাতায় আমার স্কুলজীবনের শেষ দু-তিন বছর অনেক দেখেছি। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে দু-একটা করে আন্দোলন হতো নানা অসিলায়। আসল লক্ষ্য অবশ্যই ছিল ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে। প্রায়ই দেখা যেত মিছিলের ভিড় থেকে কেউ একজন পুলিশের দিকে একটা ঢিল ছুড়ল। আর যায় কোথায়! দ্রুম-দ্রাম গুলিবর্ষণ শুরু করল পুলিশ, কিছু লোক লুটিয়ে পড়ল, পিচ ঢাকা কালো রাস্তা লাল হয়ে গেল তাজা রক্তে।
কথাটার উৎপত্তি ফরাসি ভাষা থেকেÑ অ্যাজাং প্রভকেৎররাÑ পুলিশের গোয়েন্দা কিংবা ভাড়া করা লোক, যারা উসকানি দিয়ে জনতাকে দুষ্কৃত করতে এবং পুলিশকে গুলি চালানো এবং অন্যান্য নির্যাতনে প্ররোচনা দেয়। বর্তমান বাংলাদেশে ব্যাপারটা অহরহ ঘটছে। এখানে ঢাকঢাক গুড়গুড়ের প্রয়োজন নেই। পুলিশে আর শাসক দলের গুণ্ডাতে কোনো তফাত নেই। উভয়েরই লক্ষ্য হলো দেশে যারা গণতন্ত্র চায় এবং যারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরতন্ত্রী শাসনের অবসান চায়, যেকোনো প্রকারেই হোক তাদের নিরস্ত করতে হবে, এমনকি খুন করে হলেও। শাসক দলের গুণ্ডারা বেকায়দায় পড়লে আজকের বাংলাদেশে পুলিশ তাদের সংরক্ষণ দেয়। এই হচ্ছে তফাত।
সে কালের মানুষ ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে তারা ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। বহু খুন করে, বহু রক্ত ঝরিয়েও ব্রিটিশরা তাদের নিরস্ত করতে পারেনি। আজকের বাংলাদেশের মানুষ একটা ব্যর্থ, অপদার্থ, নির্যাতক আর একটি বিদেশী রাষ্ট্রের অঙ্গুলি তাড়নে পরিচালিত সরকারকে বিতাড়িত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দলীয়কৃত পুলিশ, ঘাতক দল এবং সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দাদের অত্যাচার-নির্যাতনে তারা নিরস্ত হবে না।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ক্ষমতাসীন সরকারের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বেলায়? দেশের মানুষ মনে করে বিগত সাড়ে তিন বছরে হাজার হাজার প্রাণহানি হয়েছে সরকারের নির্দেশে। এ সরকার গদি চিরস্থায়ী করতে চায়। অন্য কোনো বিবেচনা তাদের মাথায় আসে না। দায়িত্ববোধের তো প্রশ্নই ওঠে না। এই যে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন হলো এই সাড়ে তিন বছরে, তার কোনো একটির সুরাহা হয়েছে কি? 
স্বামী-স্ত্রী দু’জন সাংবাদিক খুন হলেন। মেহেরুন রুনি আর সাগরের পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি করলেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে মিডিয়াকে বললেন, তিনি তার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু শিশুটিকে যারা পিতৃ-মাতৃ হারা করল তাদের কী শাস্তি হলো? খুনিরা কি ধরা পড়ল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনি খুনিদের পাকড়াও করবেন। বহু ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারো ঢাকঢোল পিটিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, রুনি আর সাগরের ঘাতকদের গ্রেফতারের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কী লাভ হলো তাতে? হাইকোর্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ডেকে তম্ভি করলেন, তারা বললেন, খুনিদের গ্রেফতারে তারা অপারগ, তারপর দায়িত্ব দেয়া হলো র‌্যাবকে। র‌্যাবই বা কী ভোজবাজি দেখিয়েছে? আমরা গোড়ার দিন থেকে বলে এসেছি, সাংবাদিক দম্পতির খুনের কোনো সুরাহা হবে না, খুনিরা ধরা পড়বে না, কেননা তারা সরকারের হুকুমের লোক, সরকারের ভেতরের কারো না কারো নির্দেশে সরকারের ভেতরের দুর্নীতির খবর ফাঁস করা বন্ধ করার মতলবে তাদের খুন করা হয়েছে। প্রমাণ হয়ে গেল দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি আসলে ছিল সত্য ধামাচাপা দেয়ার কারসাজি।
ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন দুই সপ্তাহ হতে চলল। তার ওপর সরকারের ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের আক্রোশ অবশ্যই ছিল। ইলিয়াস প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন, তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন, বৃহত্তর সিলেটে আওয়ামী লীগের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষক দেশ ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে সেসব নদীর পানি মধ্য ভারতে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাক তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। তারা টিপাইমুখে বরাক নদীর ওপর বাঁধ তৈরি করছে। 
হাসিনার সরকারের মুখ থেকে প্রতিবাদের টুঁ শব্দটিও উচ্চারিত হচ্ছে না। ইলিয়াস আলী বৃহত্তর সিলেটে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করলেন, লাখ লাখ লোক সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাল। উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী যন্ত্রপাতি এবং হয়তো ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতরে এসে তিতাস নদী ও ১৪টি খালে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিলো। তার বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ কণ্ঠ উচ্চারিত হলো ইলিয়াস আলী তাতেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। দেশে ও বিদেশে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, প্রায় সবাই বলছে, তার গুম হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকার এবং র‌্যাবের হাত আছে। 
কেন? র‌্যাব এর আগেও শতাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুম করেছে এবং সরকারের নীরবতা দেখে প্রমাণ হচ্ছে, সরকার ও শাসক দলের নির্দেশে এই গুম ও খুন করার ঘটনাগুলো ঘটছে। অন্তত এটা তো প্রমাণ হয়েছে যে, খুনিদের খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা সরকারের দিক থেকে হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকায় সংসদগুলো এবং সংসদ সদস্যরা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো অবিলম্বে ইলিয়াস আলীর মুক্তি দাবি করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা উল্টোপাল্টা এবং পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছেন। ঠিক যে রকমটা করা হয়েছিল রুনি আর সাগরের হত্যার ব্যাপারে। অর্থাৎ সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার সব রকমের চেষ্টা চলছে।
ইলিয়াস আলীর শোকাতুর স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা তার মুক্তির জন্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। তাতে কোনো ফল হয়নি। পাষাণের হৃদয় এতটুকু কম্পিত হয়নি। তার স্ত্রী উপায়ান্তরবিহীন হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারাও ইলিয়াস আলীকে মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সরকারের ইচ্ছা থাকলে কাজটা মোটেই কঠিন নয়। 

এ আন্দোলন যে কারণে অপরিহার্য 
ইলিয়াস আলীকে র‌্যাব কিংবা অন্য কোনো তথাকথিত নিরাপত্তা এজেন্সি গুম করে থাকলে সরকার হুকুম দিলেই তাকে ছেড়ে দেয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়হীন পরিহাস অনুযায়ী খালেদা জিয়ার নির্দেশে যদি ইলিয়াস আলী আত্মগোপন করে থাকেন তাহলেও এত দিনে তাকে খুঁজে বের করা পুলিশ, র‌্যাব কিংবা সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের উচিত ছিল। তারা দেশের সব মানুষের হাঁড়ির খবর রাখছে, দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার, গুম কিংবা খুন করছে, আর এই বিখ্যাত নেতার খোঁজ পাওয়ার সাধ্যি তাদের হলো না? উন্মাদ না হলে সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। 
সোজা আঙুলে ঘি বের করা না গেলে আঙুল একটা বাঁকা করতে হয় বৈকি! ১৮ দলের জোটকে সেজন্যই আন্দোলনের পথ ধরতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা সবাই স্বীকার করেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিশেষ করে বিএনপি যত আন্দোলন করেছে প্রত্যেকটি ছিল শান্তিপূর্ণ। ১২ মার্চ ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে রক্তারক্তি করার লক্ষ্যে একই দিন আওয়ামী লীগও ঢাকায় কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে খালেদা জিয়া তার কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে দেন। কিন্তু যেখানেই আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর গুণ্ডারা ময়দানে নেমে পড়েছে, কিছু কিছু অশান্তি মাত্র সেখানেই হয়েছে।
বিদেশী মিডিয়ায় এবং ইন্টারনেটে খবর ছড়াচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের এক শ’ নেতা-কর্মীকে দেরাদুনে ভারতীয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এদের নাম দেয়া হয়েছে ক্রুসেডার। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ইউরোপের খ্রিষ্টান রাজারা ফিলিস্তিনের মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন সেটাকে বলা হতো ক্রুসেড। সে নাম ধার নিয়ে আওয়ামী লীগ কি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে? স্পষ্টতই ভারতের এ আচরণ বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করার প্ররোচনা। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার খবরে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এতে তিনজন নিহত হয়েছেন। দেখা গেছে, যে গুলিতে তারা মারা গেছে, সে গুলি ব্যবহারের উপযোগী কোনো অস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশের নেই। তাহলে গুলি চালাল কারা? ভারতের দেয়া উন্নত অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগের ক্রুসেডাররা? 
অ্যাজাং প্রভকেৎরের (উসকানিদাতা) প্রশ্ন সে জন্যই উঠছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, হরতালে শান্তি রক্ষা করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়; হরতাল প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগ কর্মীরাও মাঠে নামবে। গত রবি ও সোমবারের হরতালে তারা মাঠে নেমেছে এবং ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপের অনেকগুলো ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি আর এসব অঘটনের মধ্যে যোগাযোগ খুঁজে বের করতে দেশের মানুষের এতটুকু অসুবিধা হবে না। 

এত অন্যায় আগে কেউ দেখেছে? 
ব্রিটিশ রাজের শেষের দিনগুলোতে তাদের যেন মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। জেল-জুলুম তখন মানবতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গদি হারানোর ভয়ে আওয়ামী লীগ সরকারেরও হয়েছে সে অবস্থা। সন্ত্রাস চালিয়ে তাদের কোনো লাভ হয়নি। তারা এখন গ্রেফতার, পাইকারি মামলা, বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি ইত্যাদি দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। সচিবালয়ে কারা ককটেল ফাটিয়েছে? গাড়ি-বাস কারা ভাঙচুর করেছে? ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির অজুহাত হিসেবে অ্যাজাং প্রভকেৎররা যে সেসব ঘটনা ঘটায়নি তার প্রমাণ কোথায়? অপদার্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লেজুড় টুকু বলেছেন, এসব ঘটনার জন্য বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘হুকুমের আসামি। একই কারণে আওয়ামী লীগ গুণ্ডাদের, দলীয়কৃত পুলিশ ও র‌্যাবের খুন-খারাবির জন্য সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা কি হুকুমের আসামি নন?
এই সরকার গদি পেয়ে প্রথমেই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮৬টা মামলা তুলে নিয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা ছিল তারা ‘হুকুমের আসামি’ ছিলেন না, তাদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। ১৫টি জাজ্বল্যমান দুর্নীতির মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। খুনের আসামিও ছিল অনেকে। একজন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচ বি এম ইকবাল। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ১৯৯৬ সালে খিলগাঁওয়ে বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। সে ঘটনার আলোকচিত্র প্রায় সব পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন খুনিকে এ সরকার এ যাবৎ মুক্তি দিয়েছে। এখন আবার আরো ২৯৭ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর দুষ্কৃতির মামলা তুলে নেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অবশ্যই এরা সবাই আওয়ামী লীগের দুষ্কৃতকারী। অন্যায় আর অবিচারের এর চেয়ে জঘন্য দৃষ্টান্ত আর কোথায় পাওয়া যাবে?
ধরপাকড় আর তল্লাশি ব্রিটিশরা চালিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের নাভিশ্বাস ওঠার পরে। পাকিস্তানিরা চালিয়েছিল একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরে? কী লাভ হয়েছে তাতে? ব্রিটিশ রাজ কিংবা পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ কি টিকে থেকেছে? নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার কত দিন টিকে ছিল? এ সরকারেরও দিন শেষ হয়ে আসছে বলেই মনে হয়। গত রোববার রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে। তার ফলাফল কী হয়েছে সরকার কি দেখতে পায়নি? সাধারণ মানুষ দেখেছে, সোমবারের হরতাল আরো বেশি সফল হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে, তারা একটা ক্রান্তিলগ্নে এসে ঠেকেছে : হয় আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারকে হঠাতে হবে, নয়তো এ দেশে শান্তিতে বাস অসম্ভব হয়ে যাবে, খুব সম্ভবত আবার তারা ভারতের উপনিবেশে পরিণত হবে। আওয়ামী লীগ যেমন মরণ কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে, দেশের মানুষও এখন বেপরোয়া। তারা একটা গণ-বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
খরার মাঠে মৃতকল্প গরু যখন ঠ্যাং ছোড়াছুড়ি করে, আকাশে তখন শকুনের ঘুরপাক খাওয়া শুরু হয়। ২০০৬ সালের শেষের দিকে এই আলামত আমরা দেখেছি। ভারত আর আমেরিকা থেকে ছোট-বড় কর্মকর্তাদের পদধূলি দানের বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। দিল্লির দূত বীণা সিক্রি সুধা সদনকে তার দ্বিতীয় আফিসে পরিণত করেছিলেন। মার্কিন দূত কালা জাহাঙ্গীর বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সচিবালয় আর সুধা সদনের মধ্যে ছোটাছুটি করে। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারতে রাজনৈতিক সফর করেছেন, অর্ধ ডজন ঘোড়া উপহার নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এসবের ফলাফল ছিল একটা ষড়যন্ত্র এবং একটা মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচন। আর হ্যাঁ, ভারতের বস্তাবস্তা টাকা আর পরামর্শ। বিগত কিছুকাল থেকে মার্কিন ও অন্য বিদেশী কর্মকর্তাদের আনাগোনা আর ঢাকায় কূটনীতিকদের ছোটাছুটি সেসব কথাই মনে করিয়ে দেয়।

ভিআইপি সফর
গরিবের দুয়ারে হাতির পা। তাও আবার একটা নয়, দুই-দুই জোড়া। একই দিন ঢাকায় আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন, আর ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। কিন্তু গর্বে কোনো বাংলাদেশীর বুক ফুলে উঠছে কি? ভাবছি!
হিলারি কিনটন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক নম্বর প্রিয় ব্যক্তি নন। বাংলাদেশে হিলারি ও তার স্বামীর, বস্তুত আরো অনেক দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রিয়ভাজন হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূস তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের দৌলতে বিশ্বব্যাপী মর্যাদা পেয়েছেন। অপকৌশলে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব থেকে শেখ হাসিনা তাকে সরিয়ে দিয়েছেন। অনেকগুলো কারণের কথা লোকে বলাবলি করে। আগেরবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ডজনখানেক ডক্টরেট তিনি ক্রয় করেছিলেন। এবারে তার সখ হয়েছিল একটা নোবেল পুরস্কারের। নোবেল পুরস্কার কমিটি তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি, বিশ্বসমাজও কমিটির সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে। ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
লোকে আরো বলে, আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের বয়লারে যারা কয়লা জোগায় তাদের কেউ কেউ গ্রামীণ ব্যাংক নামক বস্তুটিকে হাতে পেতে চায়। অন্যরা বলে, গ্রামীণফোনের ওপর কারো কারো লোলুপ দৃষ্টি আছে। এ আবদার উপেক্ষা করা কি কঠিন কাজ নয়? সমস্যা হচ্ছে মুহাম্মদ ইউনূস হাল ধরে থাকতে এই দ্বিমুখী আবদার রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। অতএব ইউনূসকে যেতেই হয়েছে। বিশ্ব নেতারা যথেষ্ট সহানুভূতি দিয়ে হাসিনার সমস্যাগুলো বিবেচনা করেননি। হিলারি কিনটন তো জোর প্রতিবাদই করেছিলেন। এমনকি গোসা করে বাংলাদেশে গোটা দুয়েক সফরও তিনি বাতিল করেছিলেন। সেসব হজম করে হিলারি আসছেন। মনে হচ্ছে গরজ বড় বালাই! 
প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় বিদেশী অতিথি। ভারতীয় নেতাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে সোচ্চারভাবে শেখ হাসিনাকে গদিতে বহাল রাখার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। হাসিনা এখন মহাসমস্যায় আছেন। তার সরকারের জনপ্রিয়তা এখন মাইনাসে নেমে গেছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘ইলিমিনেট’ করার ‘স্ট্র্যাটেজি’ তিনি গদি পাওয়ার প্রথম দিন থেকেই নিয়ে রেখেছিলেন। বিরোধী দলগুলোর কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে তার ক্যাডারগুলো এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্য বলে বর্ণিত গুণ্ডারা। 
তাদের মদদ দিয়েছে র‌্যাব নামে বর্ণিত বর্ণচোরা রক্ষীবাহিনী। তারা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ারের’ নামে কয়েক শ’ রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুলি করে মেরেছে। বিশ্বব্যাপী তাদের অপকর্মের সমালোচনা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ‘ক্রসফায়ারের’ সংখ্যা হ্রাস করার জন্য তাদের ওপর তাগিদ এসেছে। কিন্তু তারা ‘কোটা‘ পূরণ করছে ঠিকই। গত বছর দুয়েকে তারা বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী ১০০ থেকে ১২২ জন সরকারের বিরোধী ও সমালোচক নেতাকর্মীকে গুম করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেলেও অন্যরা এখনো নিখোঁজ আছে। এ রকমের গুম আর খুন করেছিল একাত্তরের রাজাকার আর আলবদররা। তাদের বিচারের নামে হাসিনা রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। আজকের রাজাকার আর আলবদরদের বিচারও হতে হবে। 

আফগানিস্তানে বাংলাদেশী সৈন্য? 
গরজ বড় বালাই। গরজে পড়েই হিলারি ও প্রণব মুখার্জিকে একই সময়ে হাসিনার দরবারে আসতে হচ্ছে। চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশকে ভারত ছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রধান মিত্র। সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকা পাকিস্তানের সাথে জোট বেঁধেছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন আর নেই। আমেরিকার বড় ভাবনা এখন চীনকে নিয়ে। চীন এখন এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি। চীনের কাছে ঋণে আমেরিকার মাথা পর্যন্ত বন্ধক আছে। সে চীন এখন এক নম্বর সামরিক পরাশক্তি হতে চলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তারে আমেরিকা আর ভারত সমানে উদ্বিগ্ন। চীনের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকা আর ভারত এখন হাতে হাত মিলিয়েছে। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে বলয় সৃষ্টিতে তারা বাংলাদেশকেও জোটে ভেড়াতে চায়। এতে যে বাংলাদেশের সর্বনাশ হবে, তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না।
আমেরিকার আরো গরজ আছে। নিত্য তালেবানের পিটানি খেয়ে আমেরিকা এখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সে শূন্যস্থান পূরণের জন্য তার ভাড়াটে সৈন্য প্রয়োজন। অনেক ঠেকে পাকিস্তান এখন আর আফগানিস্তানে আমেরিকাকে মদদ দিতে রাজি নয়। অন্য দিকে শেখ হাসিনা এখন স্বাধীন প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিবর্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভাড়াটে বাহিনী হিসেবেই ব্যবহার করতে চান। তাতে কিছু বিদেশী মুদ্রা আসে। ভারতেরও সেটাই মতলব। আসলে ভারত চায় না, বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকুক। কূটনৈতিকপাড়ায় নাকি বলা-কওয়া হচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে হিলারি হাসিনা ওয়াজেদের কাছে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব দিতে পারেন।
গণতন্ত্রী ১৮ দলের আন্দোলনে হিলারি কিনটন কোনো রকম সমর্থন দেবেন বলে আশা করা যায় না। তবু সৌজন্যের খাতিরে ভিআইপিদের সফর উপলক্ষে ১৮ দলের নেতারা তাদের হরতাল মুলতবি রেখেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া এবং ১৮ দলের নেতাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে তারা যেন কোনো ভিআইপির ফাঁদে পা না দেন। মিষ্টি কথায় ভুলে তারা যদি আন্দোলন বন্ধ করতে রাজি হন, তাহলে হাসিনা হালে পানি পাবেন এবং ১৮ দলের আন্দোলনের কবর তৈরি হবে। দেশবাসী এখন হাসিনা সরকারের পতনের জন্য সম্পূর্ণ সংগঠিত। নেতারা হাসিনাকে দম নিতে দিলে জনতা সেটাকে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলেই বিবেচনা করবে, নতুন করে তাদের সংগঠিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। 

(লন্ডন, ০১.০৫.১২) 
serajurrahman@btinternet.com

ইলিয়াসের মুক্তি পর্যন্ত হরতাল কেন চলতেই থাকবে



সি রা জু র র হ মা ন
এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যা ও গুম করার ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীগুলোর কোনো কোনোটি জড়িত। বিএনপি নেতা এবং ভারতের পানি আগ্রাসন, বিশেষ করে টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সংগ্রামী ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নিয়ে সরকারের সমর্থক পত্রিকাগুলোতেও যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিচ্ছেন তাঁরাও নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। এটাও সন্দেহাতীত প্রমাণ করে যে অন্তত একটি তথাকথিত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী এই গুম করার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ সেটা বিশ্বাস করতে চান না। একটা কারণ তাঁরা আওয়ামী লীগের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। বড় কারণটা এই যে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যা যা ঘটেছে সেটা তাঁদের জানতে দেয়া হয়নি। ‘সঠিক ইতিহাসের’ নামে তাঁদের ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব।’ প্রকৃতই লাল ঘোড়া, অর্থাত্ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থককে তখন আওয়ামী লীগের ঘাতক রক্ষীবাহিনী গুম ও হত্যা করেছিল। নিহতদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদার। রক্ষীবাহিনী সে তিন-সাড়ে তিন বছরে মোট ৪০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। জাসদের বর্তমান নেতা হাসানুল হক ইনুকে এককালে আমি চিনতাম ও শ্রদ্ধা করতাম। তিনি কী করে হত্যার রাজনীতির হোতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেন ভেবে আমি সত্যি অবাক হই।
সুদূর বিদেশ থেকে অনলাইন লেখা পড়ে যতদূর বুঝতে পারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি সরকারবিরোধী নয়। এ পত্রিকায় একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের বয়ান ছাপা হয়েছে। তিনি ছিনতাইয়ের ঘটনাকালে ছিনতাইকারীদের একজনের শার্টের কলার চেপে ধরেছিলেন। সে লোকটি তার আইডি কার্ড দেখিয়ে দাবি করে যে সে একটি নিরাপত্তা বাহিনীর (র্যাবের কি?) লোক এবং তারা একটা অপারেশন চালাচ্ছে। একজন ডাব-বিক্রেতাও ঘটনাটি দেখেছিলেন। এখন তাঁরা কোথায়? ইলিয়াস আলী আওয়ামী লীগের চিহ্নিত শত্রু। বৃহত্তর সিলেটে তিনি বিএনপির সংগঠনের কাজ এতদূর এগিয়ে নিয়েছিলেন যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেখানে আওয়ামী লীগের ভোট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারতেরও তিনি চক্ষুশূল। টিপাইমুখে বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে সবচাইতে সোচ্চার প্রতিবাদ তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া তাঁর ড্রাইভারকেও গুম করার অন্য কী কারণ থাকতে পারে?
অথবা দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক সমকাল। যতদূর বুঝতে পারি এ দুটি পত্রিকা সরকার ও আওয়ামী লীগের সমর্থক। উভয় পত্রিকাই খবর ছেপেছিল যে ইলিয়াস আলীকে জীবন্ত মুক্তিদানের জন্য দশটি শর্ত দেয়া হয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল যে মুক্তি পেলে ইলিয়াস আলীকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করতে হবে যে বিএনপি নেত্রীর নির্দেশে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অন্তর্ধানের যে কারণটি নির্দেশ করেছিলেন) এবং ইলিয়াস আলীকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা কী কারণে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দিয়েছে সে সম্বন্ধে এখনও কি কারও সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে?
সাহারা ঘাতক বাহিনীকে লেলিয়ে দিচ্ছেন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গত শনিবার ১৮ দলের জোটের দ্বিতীয় দফা হরতাল ঘোষণার পর বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা একা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়; হরতাল প্রতিহত করতে তিনি আওয়ামী লীগ কর্মীদেরও মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন। গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশ বাহিনীর কলেবর বিরাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের বহু সদস্যকেও এ বাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতির একটা বড় যোগ্যতা। গত বছরের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের চত্বরে বিএনপির প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে অমানুষিক পেটানোর জন্য দায়ী মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনারকে গত কয়দিনে পদোন্নতি দিয়ে একটি জেলার পুলিশ সুপার করা হয়েছে।
তাছাড়া সরকারের র্যাব বাহিনী তো আছেই। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পক্ষে কেন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব নয়? অনেক কারণ আছে তার। একটা কারণ এই যে, এই বাহিনীগুলোকে এখন গণবিরোধী ভূমিকায় নামানো হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকার দলন এং গণতন্ত্র হত্যা কখনোই পুলিশের ভূমিকা হওয়া উচিত নয়। ব্রিটিশরা এবং পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্রও বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রস্পৃহাকে হত্যা করতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও গত সাড়ে তিন বছরে তাদের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি দিয়ে দেশের মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। পুলিশকে অনৈতিক কাজ করতে বলা হলে তারা কখনোই সে কাজে সফল হতে পারবে না।
আরেকটা কারণ এই যে র্যাব ও পুলিশকে সরকারের প্রতিপক্ষের গণতন্ত্রের আন্দোলন নির্মূল করার কাজে এতই ব্যস্ত রাখা হচ্ছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সময় তারা পায় না। দেশের সব মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খুন ও গুম করার জন্য মূলত র্যাব দায়ী। এ সরকারের সূচনা থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং শেখ হাসিনার সশস্ত্র ক্যাডাররা বিরোধী দলের আন্দোলন-হরতালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিবর্তে এই হানাদারদের সংরক্ষণ দিতেই বেশি ব্যস্ত। ইলিয়াস আলীকে গুম করার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বনাথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে গুলিবর্ষণে তিনজন মারা গেছে। জানা গেছে, ময়না তদন্তে দেখা গেছে যে, যে ধরনের গুলিতে তারা নিহত হয়েছে সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশের কাছে নেই।
গৃহযুদ্ধের উস্কানি?
এ ব্যাপারটা কোনো কোনো ভারতীয় পত্রপত্রিকার খবর উল্লেখ করে শ্রীলঙ্কার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের বিশ্বাসযোগ্যতাই তুলে ধরে। সে খবরে বলা হয়েছে যে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্রুসেডার নামে পরিচিত ১০০ জন আওয়ামী লীগ ঘাতককে ভারতের দেরাদুন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ খবরটি দুটি কারণে বিশেষ উদ্বেগের কারণ। প্রথমত, বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ও অস্ত্র সরবরাহ করে ভারত আমাদের দেশে একটা গৃহযুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ক্রুসেডের বিশেষ একটা সংশ্লেষ আছে। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ইউরোপীয় রোমান ক্যাথলিক রাজারা জেরুসালেম দখল এবং মুসলিম আধিপত্য বিনষ্ট করার জন্য এই ক্রুসেড চালিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের যেসব কর্মীকে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ তারা কি তাহলে বাংলাদেশে ইসলামকে ধ্বংস করার প্রশিক্ষণ পেয়ে এসেছে? এখন এ সন্দেহ করার বিশেষ কারণ ঘটেছে, বিশ্বনাথে তিন ব্যক্তিকে যে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে অস্ত্র নব্য ক্রুসেডাররা ভারতের কাছ থেকেই পেয়েছে। সাহারা খাতুন কি হরতাল ঠেকানোর নামে বিরোধী ১৮ দলের নেতাকর্মীদের রক্তপাতের নির্দেশই দিয়েছেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্রুসেডারদের?
আমরা আগেও বহুবার বলেছি যে হরতাল জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু হরতাল কথাটা রাজনীতির অভিধানে ঐতিহাসিক কাল থেকেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা গোড়া থেকেই স্বীকার করেছেন, হরতাল রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রথম নয়, সর্বশেষ হাতিয়ার হওয়া উচিত। অর্থাত্ অন্য সব পন্থায় গণতন্ত্র রক্ষা করা না গেলে শেষ চেষ্টা হিসেবে হরতালকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এখন সে অবস্থাই এসে গেছে। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার একটা সম্প্রসারণকামী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় গণতন্ত্র ধ্বংস করে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিটির পদাবনত একটা ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে চায়। আগেই বলেছি গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষের মজ্জাগত। গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের আত্মদানের ইতিহাস নতুন নয়। শেখ হাসিনার সরকার গত সাড়ে তিন বছরে বহু হাজার হত্যা ঘটিয়েছে। গুম করার ‘ঐতিহ্য‘ তারা স্থাপন করেছিল রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর কর্মীদের দিয়ে।
বিরোধী দলগুলো গোড়ায় সেটা নীরবে সহ্য করে গেছে। আস্কারা পেয়ে ঘাতকরা এখন অনেক ওপরে হাত বাড়াতে শুরু করেছে। ইলিয়াস আলী তার প্রমাণ। বিরোধী নেতারাও এখন শঙ্কিত। সমানেই শঙ্কিত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন বলেছেন তিনি নিজেও গুম হওয়ার ভয়ে শঙ্কিত। তারপরেও শাসক দলের জোটে অন্তর্ভুক্ত থাকতে কেন তাঁর গা-ঘিন ঘিন করে না ভাবছি।
দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ
দেশে এখন একটা ত্রাসের রাজত্ব চলছে। এ অবস্থায় কারোরই নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সেজন্যই ১৮ দলের জোটের নেতারা অবশেষে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। হরতাল সেজন্যই। তাঁরা বুঝে গেছেন এখন প্রতিরোধ করা না হলে চিরস্থায়ী ক্ষমতা তাদের হাতে চলে যাবে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেয়ার কাজ শুরু করেছে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই। অর্থাত্ ইলিয়াস আলীর মুক্তির দাবিতে যে হরতাল ও আন্দোলন হচ্ছে সে আন্দোলন আর সে হরতাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনও বটে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগের হিসাব করেনি। তারা স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বর্তমানেও তাদের মনে করতে হবে যে তারা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেমেছে, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাব করার সময় এখন নয়।
বিএনপি দ্বিতীয় দফায় রবি ও সোমবার হরতাল ডেকেছে। বিরোধী ১৮ দলের জোট বলেছে, সোমবারের মধ্যে ইলিয়াস আলীকে মুক্তি দেয়া না হলে মঙ্গলবার মে দিবস বাদ দিয়ে আবারও হরতাল ডাকবে তারা। আগামী সপ্তাহের শনিবার ৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন। ১৮ দল বলেছে যে তাঁদের সফরের দিন তারা হরতাল করবে না। বিদেশি ভিআইপিদের প্রতি সৌজন্য স্বরূপ তাঁদের উপস্থিতিতে হরতাল না করা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। কূটনৈতিক মহলে বলাবলি হচ্ছে আগামী বছরে সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে চলতি বছরের মধ্যেই মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় এই দেশদুটি খুবই আগ্রহী।
খুবই ভালো কথা। কিন্তু ১৮ দলের জোটের নেতাদের কিছু কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০০৭ -২০০৮ সালে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটেছে সে ব্যাপারে এ দুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বীণা সিক্রি ও কালা জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টম্যাস মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনেও হোতা ছিলেন মনে করা হয়। অন্যথায় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হতেন না, বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা নিয়েও এখন প্রশ্ন দেখা দিত না। প্রণব মুখার্জি আর হিলারি ক্লিনটনের চাপে ১৮ দলের জোট যদি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবি ত্যাগ করে তাহলে মারাত্মক ভুল করা হবে। একইসঙ্গে দুই বিদেশি মন্ত্রীর চাপে পড়ে ইলিয়াস আলীর মুক্তি ছাড়া হরতালের অস্ত্র ছেড়ে দিতে রাজি হলেও নেতারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন। খুব সম্ভবত সে ক্ষেত্রে জনতা তাঁদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হবে না।
(লন্ডন, ৩০.০৪.১২)