বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

ভিআইপিদের সফর বাংলাদেশকে কোথায় রেখে গেছে

ভিআইপিদের সফর বাংলাদেশকে কোথায় রেখে গেছে


॥ সিরাজুর রহমান ॥

যে ব্যক্তি এবং যে জাতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি তারা সব সময়ই আশা করে বসে থাকে ‘আত্মীয়বাড়ির লোকেরা’ তাদের জন্য মণ্ডা-মিঠাই আনবে, তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। কোথাকার কোন বিদেশী তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা বাংলাদেশে আসবেন সে নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়ার মাতামাতিতেও আমাদের পরমুখাপেক্ষিতার প্রমাণ বহন করে।
হিলারি কিনটন কিংবা প্রণব মুখার্জি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। স্বল্প সফরে হলেও তারা এসেছিলেন এবং তারা চলেও গেছেন। মামাবাড়ির অতিথিরা চলে যাওয়ার পর শিশুরা ভাবতে বসে, মিষ্টি কি তারা যথেষ্ট খেয়েছে, আরো কিছু খেতে পারলে মজা বেশি হতো। হিলারি আর প্রণবের সফরের পরে মিডিয়ারও যেন হয়েছে সে অবস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি। বহু দেশে বহু ব্যাপারে সে এখনো কলকাঠি ঘোরায়। বাংলাদেশে অত্যন্ত দৃশ্যমান ভাবে ঘুরিয়েছিল ২০০৬-২০০৮ সালে। ভারতের রাষ্ট্রদূত আর কিছু পরিমাণে হলেও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে সাথে নিয়ে তারা একটা বর্ণচোরা সেনাশাসন চালু করেছিল। এখন আর বুঝতে বাকি নেই, একটা ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা অনুযায়ী বিএনপিকে ধ্বংস করা এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা ভারত-মার্কিন আজ্ঞাবহ সরকার স্থাপন করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই তিনটি দেশের পরিকল্পনা আর ইকোনমিস্ট সাপ্তাহিকীর ভাষায় ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শে’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর হিসাবে কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিল। অন্য বড় পৃষ্ঠপোষককে উপেক্ষা করে তিনি নিকটতম পৃষ্ঠপোষক ভারতের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ড. ইউনূসকে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বরখাস্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বহু দেশে ইউনূসের বহু গুণগ্রাহী ও বন্ধুকে আহত করেছেন। হিলারি কিনটন তখন দীর্ঘ টেলিফোন বার্তায় চাঁচাছোলা ভাষায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে মার্কিন কলকাঠি নাড়ানোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেছনের দরজা দিয়ে সে কথোপকথনের আক্ষরিক বিবরণ বিশ্ব মিডিয়ায় ফাঁসও করে দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভুল করেছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, আমেরিকা তার নতুন পাওয়া বন্ধু ভারতকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। সুতরাং ওয়াশিংটনকে হেনস্তা করে আসলে তিনি দিল্লিকে বিশেষ সন্তুষ্ট করেননি। দিল্লি তাকে চিরকাল গদিতে আসীন রাখবে এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি দিল্লির সব চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মার্কিন সরকারের অসন্তুষ্টির প্রমাণ হিসেবে হিলারি কিনটন বাংলাদেশে দু’টি প্রস্তাবিত ও নির্ধারিত সফর বাতিল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও দিল্লির প্রভাবে ওয়াশিংটন ঢাকার প্রতি তার বিরক্তির বাড়াবাড়ি হতে দেয়নি। গত সপ্তাহে (৫ মে) একই দিনে হিলারি কিনটন আর ভারতের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত সফরে হলেও ঢাকা আগমন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। 

হিলারির ক্রোধের কি উপশম হয়েছে?
হিলারি ঢাকা এসেছিলেন চীন থেকে। তার বেইজিং সফরের সময় অন্ধ মানবাধিকার আইনজীবী চেনের ব্যাপার নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে লক্ষণীয় উত্তেজনা দেখা দেয়। হিলারির আসল উদ্দেশ্য তাতে কতখানি প্রভাবিত হয়েছে বলা কঠিন। বাহ্যতই তিনি অর্থনৈতিক বিষয়াদি (মূলত চীনের কাছে আমেরিকার বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি ও ঋণ) এবং সাধারণভাবেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার কার্যকাল শেষ হয়ে যেতে পারে। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু ও পরিচিতদের তিনি বিদায় সম্ভাষণ জানাতে চাইবেন।
কিন্তু আরেকটা ব্যাপার এখন ওয়াশিংটনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি করে চলেছে। ভারত মহাসাগরে বেশ ক’টি নৌঘাঁটি তৈরি করেছে সে। এতদঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব অত্যধিক বেড়ে যাক সেটা ওয়াশিংটনের কাম্য নয়। আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়া নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে একটা স্বাভাবিক বৈরিতা ভারতেরও আছে। তবে চীনের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক বিরোধ হচ্ছে সীমান্ত নিয়ে। বিশেষ করে অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার মালিকানা নিয়ে ১৯৬২ সালের নভেম্বরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে, কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে একটা বলয় ও বেষ্টনী তৈরি করা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অভিন্ন স্বার্থ।
সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও আমেরিকা অনুরূপ একটা বেষ্টনী তৈরি করেছিল। তখন ভারত ছিল সোভিয়েটের প্রধান মিত্র। মার্কিন বেষ্টনী সে জন্য তৈরি হয়েছিল অবিভক্ত পাকিস্তানকে নিয়ে। কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা সেন্টো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিয়াটোতে পাকিস্তান সদস্য হয়েছিল। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় ১৯৭০-৭১ সালে বেইজিংয়ের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে অনেক উন্নতি হয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর ওয়াশিংটনের মনোযোগ পড়ে চীনের দিকে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে মত ও পথের ভিন্নতার কারণে পাক-মার্কিন সম্পর্ক এখন বড়জোর একটা ‘ক্ষুব্ধ পারস্পরিক সহনশীলতার’ স্তরে নেমে এসেছে। তা ছাড়া পাকিস্তান এখন চীনের সাথে বন্ধুত্বকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে। 
আরো একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। চীনের বিরুদ্ধে তারা মিত্র হলেও ভারত মহাসাগরে প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে পারস্পরিক একটা রেষারেষিও আছে তাদের মধ্যে। বিগত কয়েক বছরে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে দেখেছে দিল্লির চোখ দিয়ে। দিল্লির প্রতি নতজানু ভাব দেখে মার্কিনিরা ধরেই নিয়েছিল যে, বাংলাদেশ মার্কিনিদের নতুন মিত্র ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে না। কিন্তু অতি সম্প্রতি এতদঞ্চলে ওয়াশিংটনের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। 

উপদেশের পরিস্থিতিতে তৃতীয় মাত্রা
মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা খুবই সীমিত আকারে কিছু রাজনৈতিক সংস্কার করেছেন। তাদের এক ইঞ্চি সংস্কারের বিনিময়ে ওয়াশিংটন ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ইতোমধ্যে কয়েক গজ পুরস্কার দিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারকে। ওয়াশিংটন আশা করছে, বিনিময়ে চীনের প্রভাব কাটিয়ে মিয়ানমার পশ্চিমের দিকে ঝুঁকবে। তেমন অবস্থায় চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন বলয়টি বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রসারিত হবে। তা ছাড়া মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে বিপুল গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় মার্কিন তেল কম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগে নেমেছে। এই বিনিয়োগ রক্ষার নামে বঙ্গোপসাগরে একটা ‘ফুটপ্রিন্ট’ স্থাপন ওয়াশিংটনের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। অর্থাৎ ভারতের চোখ দিয়ে দেখার পরিবর্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ওয়াশিংটন এখন সরাসরি নিজের চোখ দিয়েই দেখবে। হিলারি কিনটন ও প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত সফরকে এ আলোকেই দেখতে হবে। 
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানেই যার সাথে কথা বলেছেন, সবাইকে তিনি বলে দিয়েছেন, আগামী বছর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় ওয়াশিংটন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে এবং অন্যত্রও তিনি বলেছেন, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য বড় দুই দলকে সংলাপে বসতে হবে। ১৮ দলের জোটের প্রতিনিধি খালেদা জিয়া এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রমুখ যাদের সাথে তার দেখা হয়েছে, তারা সবাই হিলারিকে পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ছাড়া গত্যন্তর নেই।
হিলারি নিজেও কিছু স্পষ্ট কথা বলে গেছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে। তিনি বলে গেছেন, ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশ হওয়া এবং বস্ত্র শ্রমিকদের নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যা সম্বন্ধে তদন্ত হতে হবে। (প্রায় একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বলেছে, গুম আর খুনের ঘটনাগুলো বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপন করছে।) বাংলাদেশে মানবাধিকারের শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধেও হিলারি সরকারকে তম্ভি করে গেছেন। সরকারকে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন, গ্রামীণ ব্যাংককে অনুপযুক্ত কারো হাতে ন্যস্ত করা ওয়াশিংটনের গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, আমিনুল ইসলামের হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন না হলে মার্কিন আমদানিকারকেরা বাংলাদেশকে সুনজরে দেখবে না অর্থাৎ বাংলাদেশের রফতানি (বিশেষ করে বিনা শুল্কে রফতানি) বৃদ্ধি পাবে না। 

প্রণব মুখার্জির নতুন বোধোদয়?
সবচেয়ে বড় কথা, হিলারি কিনটন বাংলাদেশ সরকারের আয়োজিত নৈশভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে তিনি জানিয়ে দিয়ে গেলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর ওয়াশিংটন মোটেই প্রীত নয়।
প্রণব মুখার্জি বাহ্যত এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের যবনিকাপাত করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে, সেটা অছিলামাত্র ছিল। কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথাও তিনি ঘোষণা করেছেন। যেমন গত বছর বাংলাদেশকে ১.৭৫ শতাংশ সুদে দেয়া ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের ২০ কোটি মওকুফ ঘোষণা করেছেন তিনি এবং বলেছেন, সুদের হারও কমিয়ে ১ শতাংশ করা হবে। মনে হচ্ছেÑ এখানে কিছু ছাড় দিয়ে ভারত করিডোর, ট্র্যানজিট এবং বাংলাদেশী বন্দরগুলোর ব্যবহারও অনুদান হিসেবেই পেতে চায় বর্তমান সরকারের কাছ থেকে। প্রণব মুখার্জি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সাথে পুরনো চুক্তিগুলো কার্যকর করার লক্ষ্যে সর্বভারতীয় জনমত সৃষ্টি করতে চায়। 
দুই দেশের সম্পর্কে সব কিছুই যে সঠিক পথে যাবে না এ উক্তি থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ৬৫ বছর ধরে ভারত বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশী জমি ও ছিটমহল ইত্যাদি দখল করে আছে। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্তগুলোও ভারত পালন করেনি। দিল্লির দিক থেকে বক্তব্য : সব অঙ্গরাজ্যের সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না বলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যাচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর উপলক্ষে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। শেষ মুহূর্তে সই করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে সামান্যতম পানি দেয়ার ব্যাপারেও বেঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছেÑ দিল্লি এ রাজ্য-সে রাজ্যের অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করছে না এবং লোকসান হচ্ছে বাংলাদেশের। এমন অনির্ভরযোগ্য চুক্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রণব মুখার্জির সফরের পরে দিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশকে কোনো আশার বাণী শোনানো হয়নি।

সুস্থ পরিবর্তন?
প্রণব বাবু এর আগে কোনো কোনো সফরে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ না করে কূটনৈতিক অসৌজন্য দেখিয়েছিলেন। আলোচ্য সফরে তিনি বেগম জিয়ার সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করেছেন। আর একটা আশার কথা তিনি শুনিয়ে গেছেন এ সফরে। তিনি বলেছেন, ভারত বন্ধুত্ব করতে চায় বাংলাদেশের সাথে, বিশেষ কোনো দলের সাথে নয়। এত দিন পর্যন্ত ভারতীয় মন্ত্রীদের মধ্যে প্রণব বাবুই বেশি সোচ্চারভাবে বলতেন, ভারত শেখ হাসিনাকে গদিতে বহাল রাখবে। বাংলাদেশে কোন দল নির্বাচনে জয়ী হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন ইত্যাদি সব ব্যাপারে ভারত যদি প্রকৃতই হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে সেটা প্রকৃত সুসম্পর্কের জন্য সহায়ক হতে পারে।
হিলারি ও প্রণবের সফরের পর থেকে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া কৌতুককর। সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের রণহুঙ্কার কিছুটা কমেছে। শাসক দলের মহাসচিব সংলাপের প্রয়োজন স্বীকার করে নিয়েছেন বলেই মনে হয়। ওদিকে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে এক সপ্তাহের জন্য হলেও আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। মার্কিন ও ভারতীয় মন্ত্রীদের সফরকে সম্মান দেখিয়ে এগুলো বিএনপি নেতাদের ফাঁদে ফেলার জন্য আওয়ামী লীগের চালও হতে পারে। অন্য দিকে বিএনপির যে মহলটি আন্দোলনের বিপক্ষে তাদের ভাবখানা এমন যে, তারা লঙ্কা বিজয় করে ফেলেছেন। সেটা খুবই ভুল হচ্ছে বলে ধারণা। 
খুব সম্ভবত এ কৌশল আওয়ামী লীগ নিচ্ছে বিএনপির আন্দোলনকে শুধু ঝিমিয়ে দেয়া নয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। আন্দোলন করে তারা যে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাতে পারে, সেটা প্রমাণ করা বিএনপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চোখ রাঙিয়েছে, আন্দোলনের ভয় দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের সে দেমাগ অক্ষত থাকতে দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। বিদেশের চাপে পরবর্তী নির্বাচনে যদি বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট জয়ীও হয়, তাহলেও কথা থেকে যাবে কত দিন তারা খালেদা জিয়াকে শান্তিতে শাসন করতে, গদিতে টিকে থাকতে দেবে। গণ-আন্দোলনের জোয়ার পুরোপুরি থিতিয়ে পড়ার আগে ১৮ দলের জোটের নেতাদের উচিত হবে এ সরকারকে শেষ ধাক্কা দেয়া, এটা প্রমাণ করা যে, ভবিষ্যতে আর আন্দোলন-হরতালের হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে পারবে না।
সরকার এখনো তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনেনি। ইলিয়াস আলীকে তারা এখনো মুক্তি দেয়নি। শীর্ষ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলাগুলো এখনো তুলে নেয়া হয়নি। বরং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রমুখ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আন্দোলনে ঢিল দিলে বিএনপি নেতারা দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হবেন। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কেউ আর কখনো আন্দোলনে যাবে না। 
(লন্ডন, ০৯.০৫.১২) 
serajurrahman34@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন