বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

গোয়েবলসের পদাঙ্ক অনুসরণ

গোয়েবলসের পদাঙ্ক অনুসরণ


॥ সিরাজুর রহমান ॥

অ্যাডলফ হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাভারিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করপোরাল পর্যন্ত হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে তাকে নবগঠিত জঙ্গি রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠানো হয়। কিন্তু হিটলার নিজেই সে দলে যোগ দেন। হারম্যান গোয়েরিং, রুডলফ হেস, জোসেফ গোয়েবলস প্রমুখের ছোট একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি প্রথমে জার্মানির ক্ষমতা এবং ক্রমে ক্রমে বাকি ইউরোপ দখলের পরিকল্পনা করতে থাকেন। 
ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি সংসদীয় রাজনীতিতে ঢুকে হিটলার কিছুকালের মধ্যেই সে দলের নেতৃত্ব দখল করেন। সে দল রাইখস্টাগে (সংসদ) কিছু আসনও পেয়েছিল কিন্তু হিটলারের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। কিশোর-যুবক ও ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলে তিনি জার্মান আধিপত্য, বিশুদ্ধ আর্য জার্মান রক্ত ইত্যাদি মন্ত্র তাদের মাথায় ঢোকাতে থাকেন। হিটলার তাদের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন যে ইহুদি, কমিউনিস্ট, ট্রেড ইউনিয়নপন্থীরা জার্মান জাতিকে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, আর একশ্রেণীর লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাদের হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে। যুব-কিশোর সংগঠনগুলোকে তিনি এসব শ্রেণীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। 
হিটলারের ভীতিকর উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতালিপ্সাকে বাগ মানাতে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ ১৯৩২ সালে তাকে চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) নিয়োগ করেন। কিন্তু হিটলার হিন্ডেনবার্গের মতলব বুঝে ফেলেছিলেন। তার সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো ১৯৩৩ সালে রাইখস্টাগ পুড়িয়ে দেয়। হিটলার অগ্নিকাণ্ডের সব দোষ চাপিয়ে দেন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। কমিউনিস্ট, ইহুদি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ওপর হামলা শুরু হয়। হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের লিখিত বই, সাময়িকী ইত্যাদি পোড়ানোর কাজ শুরু হয়। জার্মানিতে নাৎসিবাদ এসেছিল এভাবে। 
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন নাৎসিদের প্রচারবিদ। তিনি মনে করতেন বারবার একই কথা প্রচার করা হলে সে কথা শ্রোতার মস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে যায়, মিথ্যাকেও সাধারণ মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করতে শেখে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাকে এবং তার ছোট বোন রেহানাকে রেখেছিল বিশেষ তত্ত্বাবধানে। ভারতীয় নাগরিকদের সাথে তাদের সামাজিক দেখা-সাক্ষাতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ধারণা করা যেতে পারে, সর্বক্ষণ তাদের ভারতের স্বার্থের দিকগুলোই বোঝানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের যেসব রাজনীতিককে ভারত তার স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করে না তাদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের দুই কন্যার মন বিষিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় ছয় বছর ধরে। কিন্তু আর কী করতেন শেখ হাসিনা? এমনও কি হতে পারে যে, নাৎসিদের ক্ষমতাপ্রাপ্তি ও ক্ষমতা স্থায়ী করার কলাকৌশল সম্বন্ধেই পড়ছিলেন অথবা সে বিষয়ে কারো পরামর্শ শুনছিলেন তিনি।
গত প্রায় ২৯ মাসে শেখ হাসিনার উক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার দেখা যাবে, তিনি প্রকৃতই গোয়েবলসের প্রচার-দর্শনে বিশ্বাস করেন। দু-একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে থাকেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়, তার রাজনৈতিক বিরোধীরা ক্ষমতা পেলে তারা চুরি করে। প্রথমেই দেখা যাক দেশের মানুষকে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাসিনা ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নেমেছিলেন এবং গত ২৯ মাসে দেশের মানুষ কী পেয়েছে।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া, দ্রব্যমূল্য সামলে রাখা, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়া, দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলা, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব মিডিয়ায় প্রকাশ করা ইত্যাদি। এই প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে কোনটি রক্ষা করা হয়েছে বলে আপনি এবং আপনারা বিশ্বাস করেন?

বিদ্যুতের সয়লাব দেখছেন প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে এ বছর অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে বলে পত্রিকায় পড়েছি। এত বেশি উষ্ণতা আমি জীবনে মাত্র একবার দেখেছি মিসরে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা আর আরিজোনার মরুভূমিতে তাপমাত্রা এ রকম কিংবা তার চেয়েও কিছু উঁচুতে ওঠে বলে শুনেছি। নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের মানুষ এমন অস্বাভাবিক গরমে অভ্যস্ত নয়, সে জন্য প্রস্তুতও নয় তারা। এই তীব্র গরমে পাখা চালাতে পারলে জীবন একটু সহনীয় হয়ে উঠতে পারত, রাতে তারা একটু ঘুমোতে পারত। বিদ্যুৎ নেই, বাতি জ্বলে না, পাখা চলে না। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আর মশার কামড়ে এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটে যায়। সবাই স্বীকার করবেন দিবারাত্রির মধ্যে কিছুটা সময় গভীর নিদ্রায় বিশ্রাম নিতে না পারলে শারীরিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না, এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে মানুষের আয়ু হ্রাস হয়।
ত্রিপুরা রাজ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যন্ত্রপাতি নেয়া হয়েছে। সে জন্য তিতাস নদীতে এবং তার শাখা-প্রশাখা ও খালে বাঁধ দিয়ে পানির স্রোত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে তাতে। আরো শুনেছিলাম যে, সে বিদ্যুৎ কারখানার জন্য বাংলাদেশের গ্যাস ভারতকে দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। অনেক বড় বড় কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা। বিনা টেন্ডারে ভাড়া করা যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ডার দেয়া হয়েছিল বহু হাজার কোটি টাকার।
তার কোনো সুফল বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পায়নি। বিদ্যুতের অভাব আর রেকর্ড মাত্রার গরমে দেশের মানুষের প্রাণ হাঁসফাঁস করছে, তারা ঘুমাতে পারছে না। তারা স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে বিক্ষোভ করছে, সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে তাদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ থাকবে বলে আশা করা যায় না। কিন্তু ওই যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনা টেন্ডারে ব্যয় করা হয়েছে তার কী হলো? শোনা যাচ্ছে, এ বাবদ ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটা ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ গ্রুপগুলোর মালিক আওয়ামী লীগের নেতারা, কোনো কোনোটির মালিক আবার প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় বলে শোনা গেছে। প্রধানমন্ত্রী গোয়েবলসীয় প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। তার ধারণা বিদ্যুৎ দিয়ে তিনি দেশকে সয়লাব করে দিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা অল্পবিস্তর সবাই জানেন। এই সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির দু’টি ঘটনার বিবরণ বিশ্বব্যাংক সরকারকে দিয়েছিল। ব্যাংক বলেছে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রমুখ দাতা দেশ ও সংস্থা বিশ্বব্যাংকের মতোই বলেছে যে, দুর্নীতির সাজা না হলে তারাও অর্থ জোগান দেবে না। বিশ্বব্যাংক গত সপ্তাহে আরো সাতটি দুর্নীতি সম্বন্ধে সরকারকে তদন্ত করতে বলেছে।

তারা বাড়িতে এসে চোর বলে যাচ্ছেন
এসব অভিযোগই হয়েছে পূর্ববর্তী যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের আমলের ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে। তার বিরুদ্ধে দেশেও অজস্র অভিযোগ ছিল। এমনকি দেশের বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনও করেছিলেন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তাকে এমন একটি দফতরে বদলি করা হয়েছে যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ আরো বেশি বলে শুনেছি। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞ মহলগুলো সন্দেহ করেন সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু নিজের জন্য নয়, আরো ওপরের কারো কারো এজেন্ট হিসেবে দুর্নীতি করছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে সরকারের অনিচ্ছাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং স্বাভাবিক সাহায্যদাতারা পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থসাহায্য দেবে না। দেশে ও বিদেশে সরকারের অপরিসীম দুর্নাম ছড়াচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রীসহ বিদেশীরা বাংলাদেশে এসেও দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তম্বি করছেন। 
এ সরকারের বহু ত্রুটির মতো আরেকটা বদগুণ হচ্ছে তাদের ফাঁকা দম্ভ। তারা বলছে বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই পদ্মা সেতু তৈরি করবে। এখানে-সেখানে তারা সেতুর জন্য ঋণপ্রাপ্তির তদবির চালাচ্ছে। শোনা গেছে, একমাত্র মালয়েশিয়া থেকে একটা প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু তারা সুদ চাইছে বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হারে। সে সুদ শোধ করতে হবে দেশের মানুষকে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই বলে দিয়েছেন চড়া হারে সুদ নেয়ার কোনো চুক্তি হলে বিএনপি সে চুক্তি অনুমোদন করবে না। অর্থাৎ ক্ষমতায় এলে (যেটা এখন অপরিহার্য মনে হচ্ছে) বিএনপি সরকার সে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে না। এমতাবস্থায় কোনো দেশ বা ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেবে বলে মনে হয় না।
আকাশচুম্বী দুর্নীতির অভিযোগ চাপা দেয়ার মতলবে শেখ হাসিনা আবার গোয়েবলসের শরণাপন্ন হয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তিনি জাগিয়ে তুলেছেন, বলেছেন যে বিরোধী দলের নেতার দুর্নীতির বিচার না হলে আর কোনো (দুর্নীতির) বিচার হবে না। হবে কী করে? গদি পেয়েই হাসিনার সরকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮৬টি দুর্নীতি-দুষ্কৃতির মামলা তুলে নিয়েছে। 
এগুলোর মধ্যে ১৫টি মামলা ছিল স্বয়ং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে। একটা মামলা ছিল ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান ক্রয়সংক্রান্ত। সেই মিগ-২৯ বিমানগুলোর কী হয়েছিল কেউ কি জানেন? আরেকটা মামলা ছিল অস্বাভাবিক চড়া দামে কোরিয়া থেকে বিনা টেন্ডারে কোনো রকম অস্ত্রশস্ত্রবিহীন ফ্রিগেট যুদ্ধজাহাজ ক্রয়সংক্রান্ত। আগেই বলেছি, হাসিনার বর্তমান সরকার প্রথম সুযোগেই সেসব মামলা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দোষ এবং সাফসুতরো ঘোষণা করে দিয়েছে। 

খুনি নিজেই তার বিচার করবে 
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরো ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। নিজেদের দুর্নীতির অপরাধ নিজেরা ধুয়েমুছে ফেলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তুলনা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আরেকটা দৃষ্টান্তই দেখুন। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হাতেনাতে ধরা পড়ল। অন্তত সাধারণ বুদ্ধির মানুষ সেটাই মনে করে। সেই গুরুতর অভিযোগ তদন্তের জন্য সুরঞ্জিত নিজে মন্ত্রীর গদিতে বসে তার অনুগত ও অধীনস্থ দু’জন রেল কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। এমন তদন্ত পৃথিবীর কোনো দেশে কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করবে বলে আমার মনে হয় না। 
তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল বলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ২০ ঘণ্টার মধ্যেই (শোনা যায় ভারতের নির্দেশে) শেখ হাসিনা আবার তাকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনেন। তারই নিয়োজিত এবং তার অনুগত ব্যক্তিদের তদন্ত কমিটি এখন বলেছে যে গভীর রাতে সুরঞ্জিতের সহকারী একান্তসচিব ও অন্য দু’জন রেল কর্মকর্তা যে ৭০ লাখ (অথবা চার কোটি ৭০ লাখ) টাকা নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন তার সাথে সুরঞ্জিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ সরকার আর বেশিদিন গদিতে থাকলে খুনি নিজের অপরাধ নিয়ে তদন্ত করবে এবং নিজেকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করবে। দুর্নীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং সুরঞ্জিত দোষী কি না প্রমাণ দিতে পারতেন গাড়ির চালক আজম খান। কিন্তু সে ঘটনার পর থেকেই তাকে গুম করে ফেলা হয়েছে। গোয়েবলসের অনুকরণেই ভিন্নমতাবলম্বী চিন্তাধারার টুঁটি টিপে মারা হচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল বইটি প্রকাশের আগেই সেন্সরশিপের কবলে পড়েছে। সরকারের অনুগত না হলে টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দেশের বহু জেলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে শাসকদলের গুণ্ডারা। দুর্নীতির অভিযোগ ফাঁস করার চেষ্টা করতে গিয়ে টেলিসাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর সাগর সরোয়ার খুন হয়েছেন।
হাসিনা নতুন স্লোগান ধরেছেন গোয়েবলসের অনুকরণেই। তিনি দাবি করছেন ‘বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে অনুকরণীয়’। তার সরকার এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যে বাংলাদেশ আছে সেটা অবশ্যই অনুকরণীয়। বহু বহু সৌকর্য ও সদগুণ আছে বাংলাদেশের মানুষের। কিন্তু যেহেতু মাথা দিয়ে মানুষ চেনা যায় সেহেতু শাসকদের পরিচয় দিয়ে কোনো দেশের বিচার হয় বিশ্বসমাজে। বিশ্বের নেতারা আমাদের দেশে এসেও এ দেশের সরকারকে চোর আর দুর্নীতিবাজ বলে যাচ্ছেন, সেটাকে কেউ অনুকরণযোগ্য মনে করবে না। 
অসংলগ্ন, পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্যই যোগ্য দাবিদার হতেন। তিনি বলে চলেছেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি হয়নি এবং শিগগিরই সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তদন্ত করার জন্য তিনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যাংক ব্যবসায়ীর অধীনে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন, বলেছিলেন যে তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তদন্তের প্রতিবেদনে নাম ধরে অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়েছিল। আবুল মাল আবদুল মুহিত লুটেরাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেননি, কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়নি। 

পুকুরচুরি আর সমুদ্রচুরি
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আবার মুখ খুলেছেন। নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্রণা সয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সুশাসনের অভাবের জন্য দুর্নীতি আর আইনের শাসনের অপব্যবহার দায়ী।’ মুহিত সেখানেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো বলেছেন, ‘পুলিশ ও বিচার বিভাগ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত।’ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ বাহিনী যে আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসেবে কাজ করছে সেটা সবাই জানে, তারা আরো জানে যে এ দেশে এখন ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচার আশা করা যায় না। এখন সেসব সমর্থন করলেন অর্থমন্ত্রী, সব উন্নত দেশেই যে পদটিকে প্রধানমন্ত্রীর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
শেখ হাসিনা এখন কী করবেন? তিনি কি মুহিতকে বরখাস্ত করবেন? আমার মনে হয় না। হাসিনা কি সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন? সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কি মন্ত্রিসভায় ফেরত নিতে বাধ্য হননি? হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয় প্রধানমন্ত্রীদেরও করতে হয়।
হলফ করে এ কথা বলব না যে, খালেদা জিয়ার পূর্ববর্তী তিনটি সরকারের আমলে দুর্নীতি হয়নি। আমার মনে হয় খালেদা জিয়া নিজেও সে দাবি করবেন না। আধুনিক কালে কোনো দেশই জোর গলায় নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত বলে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু দুর্নীতিরও সীমা এবং প্রকারভেদ থাকে। কেউ গাছটার যতœ নেয়, ফল পাকলে পেড়ে খায়; অন্যদের অত ধৈর্য সয় না। ফল পাকলে গাছটাকে কেটে তারা ফল নিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগকে অবশ্যই শেষোক্ত দলে ফেলতে হবে। খালেদা জিয়ার আমলে দুর্নীতিকে যদি পুকুরচুরি বলা যায় শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতিকে অবশ্যই বঙ্গোপসাগর-চুরি বলতেই হবে। তাদের ধৈর্য ও সংযম বলে কিছু নেই। তারা সব কিছুই যথাসত্বর লুটেপুটে খেতে চায়। ১৯৭২-৭৫ সালে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কথা একটু আগেই বলেছিলাম। আর বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি আবারো যে দেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে সে কথা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই স্বীকার করলেন।
খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে হাসিনা যে অনবরত দুর্নীতির অভিযোগ করে যাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং গোয়েবলসীয় দর্শন দ্বারা পরিচালিত। সচিবালয়ে বোমা ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ে একখানি গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির মহাসচিবসহ ৩৩ জনকে কাশিমপুর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলে কয়েদ রাখা যে আশায় করা হয়েছে খালেদা ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগও একই আশায় করা হচ্ছে। সেটা এই যে অভিযোগ প্রমাণ হোক না হোক তার কাদা কিছু পরিমাণে এই নেতাদের গায়ে লেগে থাকবে এবং হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তার থেকে কিছু ফায়দা উঠাতে পারবে। 
লন্ডন, ২২.০৫.১২
serajurrahman34@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন