সিরাজুর রহমান
আগেও বহুবার বলেছি এসব কথা—একাধিক বইতে এবং বহু প্রবন্ধ ও কলামে। নতুন পাঠকদের অবগতির জন্য পুনরাবৃত্তি পুরনো শ্রোতাদের বিরক্তি ঘটাবে না আশা করি।
বিবিসি থেকে ১৯৬৯ সালে ‘পাকিস্তানের রাজনীতি’ শীর্ষক একপ্রস্থ সাক্ষাত্কার প্রচার করেছিলাম। তত্কালীন পাকিস্তানের উভয় দিকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম সেজন্য। সেপ্টেম্বরের এক সকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিতে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যাই। মুজিব ভাই ভোরে ভোরে যেতে বলেছিলেন। ভাবী আমাদের নাশতা খাওয়ালেন। সাক্ষাত্কার ছাড়াও পুরনো পরিচয়ের জের ধরে অনেক কথা হয়েছিল।
তখন জোর জল্পনা-কল্পনা চলছিল যে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। সে বছরের জুন মাসে মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। বস্তুত গণআন্দোলনের তোড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার জুন মাসে তাঁকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তাঁর নজিরবিহীন জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করি। তিনি বললেন, দেশে লোকে আমাকে চেনে, জানি; কিন্তু বিদেশে তো কেউ আমাকে চেনে না। আমি বললাম, আপনি লন্ডনে আসুন, বিশ্বমিডিয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো।
সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন এবং আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলাম। ব্রিটিশ ও বিদেশি মিলে ৪১ সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি। বিবিসিতে বাংলায় আমি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাত্কার প্রচার করি। ভাষ্যকার এভান চার্লটনের সঙ্গে তাঁর ইংরেজি সাক্ষাত্কার বিবিসির আরও কয়টি বিদেশি অনুষ্ঠান বিভাগ অনুবাদ করে প্রচার করেছিল।
ভারতে প্রায় ছয় বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন। কিছুদিন পরেই তিনি লন্ডনে আসেন। আমি ঠিক করেছিলাম তাঁকেও মিডিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। বিবিসি বুশ হাউসের বার্তা বিভাগে তাঁর জন্য আমি একটা চা-চক্রের আয়োজন করি। আশা ছিল বিবিসির সব বিভাগের কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে একান্তে তাঁর আলোচনার সুযোগ হবে। কিন্তু হাসিনা এলেন এক পাল চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে। একান্ত আলাপের সুযোগ রইল না। অগত্যা সহকর্মী জন রেনার আর আমি তাঁকে স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলাম বাংলা ও ইংরেজিতে সাক্ষাত্কারের জন্য।
ইংরেজি সাক্ষাত্কারে জন গোড়াতেই হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে তাঁর ভালো লাগছে কিনা। তিনি বললেন, মোটেই না, রাজনীতি তাঁর ভালো লাগে না, রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন। জন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন আপনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হতে গেলেন। আরও বিস্ময় অবশিষ্ট ছিল আমাদের জন্য। হাসিনা বললেন, ওরা তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে, মাকে হত্যা করেছে, ভাইদের হত্যা করেছে, তাঁদের জন্য বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি, প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন।
ইশারায় জনের অনুমতি নিয়ে আমি স্টুডিয়ো ম্যানেজারকে বললাম, রেকর্ডিং থামিতে দিতে। নেত্রীকে বুঝিয়ে বললাম, তাঁর এসব কথা বিবিসি থেকে প্রচারিত হলে রাজনীতিতে তাঁর ক্ষতি হবে। আমার কথা যেন তাঁর বিশ্বাস হলো না। তখন আমি বললাম, বাংলাদেশের সব মানুষেরই তো বাবা-মা খুন হয়নি, তারা কেন প্রতিশোধ নিতে ভোট দিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করবে। যা হোক, সে অংশটা বাদ দিয়ে আবার শেখ হাসিনার সাক্ষাত্কারের রেকর্ডিং শুরু হলো।
হাসিনার প্রতিশোধ
তার পর থেকে বহুবার আমার মনে হয়েছে, হাসিনার সে উক্তিগুলো কথার কথা ছিল না, সত্য সত্যই তাঁর রাজনীতিতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ-বাসনা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের ওপর, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপরই প্রতিশোধ নিতে চান এবং সে স্পৃহা তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন আছেন। তার আগেও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। উভয় মেয়াদেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ। প্রতিশোধের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের অনুপস্থিতিতে ডানে-বাঁয়ে যাকে পাচ্ছেন সবার বিরুদ্ধেই তিনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন বলে মনে হয়। ছায়াছবিতে হয়তো দেখেছেন, গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ চলতে নায়ক রামদা দিয়ে ডানে-বাঁয়ে কুপিয়ে পথ করে নিচ্ছেন।
ছিয়ান্নব্বইতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা একটা সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন। তারা বহু হত্যা-নির্যাতন করেছে। বহু চোরচোট্টা, দাগাবাজ আর খুনি এই ক্যাডারে ঢুকে পড়েছিল। ঢাকার মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. এইচবি ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডাররা বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। লক্ষ্মীপুরে গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে ছিনতাই করে। তাঁর বস্তাভর্তি টুকরো টুকরো লাশ পরে নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। শামিম ওসমানের অত্যাচারে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শামিমের আফিসে মজুত বোমা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁরা কি শাড়ি পরেন নাকি, কেন তাঁরা একটার বদলে দশটা লাশ ফেলতে পারেন না।
চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা ক্যাডারদের মতো আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর গুণ্ডাদেরও লেলিয়ে দিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন করার কাজে। কয়েক হাজার লোককে তারা খুন করেছে। সেইসঙ্গে দলীয়কৃত পুলিশ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। র্যাব কয়েকশ’ কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। এখন আবার চলছে ‘গুম’ করার পালা। সর্বশেষ গুম হয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এবং এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তাঁর ড্রাইভার। তার কয়েক দিন আগে গুম হন সুরঞ্জিতের সহকারী একান্ত সচিবের ড্রাইভার, যিনি সে দুর্নীতি বিজিবির কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া ড্রাইভারদের গুম করার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না।
বহু হাজার মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে এবং হচ্ছে সরকারের প্রতিভূদের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা ৭৮৬টি মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। হালে ঘোষণা করা হয়েছে, আরও ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। ১৯ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বহু দুষ্কৃতকারীকে কারামুক্ত করা হয়েছে। এদের এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর আগাগোড়া ব্যর্থতা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মর্মান্তিক ইতিহাস। তার ওপরও পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি জাতির রক্ত চুষে খেয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি ব্যবসায়িক ‘গ্রুপ’ এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। তেত্রিশ লাখ স্বল্পবিত্ত মানুষ নিজেদের যত্সামান্য সঞ্চয় শেয়ারবাজারে নিয়োগ করেছিলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল সেটাও লুট করেছে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশের ভেতর টাকার স্বল্পতার এই হচ্ছে কারণ।
সরকারের নিয়ন্ত্রিত তদন্ত কমিটি লুটেরাদের তালিকাসহ যে রিপোর্ট দিয়েছে সরকার সেটাও গুম করে ফেলেছে। এই লুটপাটের যারা হোতা তাদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংক দু-দুটি প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজদের নামও বলে দিয়েছে। সেসব নাম প্রকাশ করার সাহস হচ্ছে না সরকারের। জনসাধারণ সঙ্গতভাবেই ধরে নিয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন।
বিপন্ন স্বাধীনতা, বিপন্ন সার্বভৌমত্ব
বাংলাদেশে এখন আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, বিচার নেই, সুশাসন নেই। সময়ে হয়তো সেসবেরও সংস্কার করা সম্ভব হতো, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ‘কমপ্রোমাইস’ করে সে সম্ভাবনার দ্বারও রুদ্ধ করে দিয়েছেন। ভারতকে বিনা মাশুলে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী এবং বন্দরগুলো, অর্থাত্ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মূল উপাদানগুলো উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একথা সর্বত্রই বলাবলি হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের ক্ষতি করে ভারতের কল্যাণ-চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন।
শুনেছি, বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগগুলোতে ভারতীয়রা উপদেষ্টা হয়েছেন। দুর্নীতি ধরা পড়ায় রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সীমান্তের ওপারের নির্দেশে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তাঁকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ প্রকৃতই বিপন্ন। এসব কি প্রমাণ করে না, শেখ হাসিনার প্রতিশোধ নেয়ার পালা আজও শেষ হয়নি? তাঁর নিহত বাবা-মা ও ভাইদের জন্য কেউ কাঁদেনি বলে আজও তিনি বাংলাদেশের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন?
বাংলাদেশের স্বল্পকালের রক্তঝরা ইতিহাসে বহু হিংস্রতা ও রক্তপাত ঘটেছে। পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগের চার নেতা কারাগারেই নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের কারও কারও ছেলেকে হাসিনা তাঁর সরকারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সর্বসাধারণ মনে করেছিল, বংশধরদের মন্ত্রীপদ দিয়ে হাসিনা নিহত নেতাদের স্মৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একটু খতিয়ে দেখলে মনে হবে, শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর প্রতিশোধের অভিযানে সহযোদ্ধাই খুঁজতে চেয়েছেন। বিকল্প ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরে হাসিনার প্রতিশোধ-স্পৃহা তাঁদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।
হাসিনার প্রথম সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। জেলে নিহত নেতাদের একজন ছিলেন তাঁর বাবা। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত প্রায়ই সাধারণ বুদ্ধিকে আহত করেছে। একসময়ে উচ্চ আদালতের বহু সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম বিচারকদের ভয় দেখাতে ‘গজারি কাঠের’ লাঠিধারী ব্যক্তিদের মিছিল নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ভবন প্রদক্ষিণ করেছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্যি তেমন কিছু করার প্রয়োজন হয়নি। সরকার গঠনের শুরু থেকেই ‘কমিটেড’ আওয়ামী লীগপন্থীদের বিচারক নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে সরকার-সমর্থকদের গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা পূরণের রায়গুলো সম্ভব হচ্ছে সে কারণে।
পার্ট-টাইম মন্ত্রীর পার্ট-টাইম মস্তিষ্ক
কারাগারে নিহত নেতাদের অন্য একজনের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অনেকেই বলে থাকেন, উভয় পদেই তিনি ‘পার্ট-টাইম’ দখলদার। ভাং কিংবা আফিমখোর ব্যক্তি যেমন মাঝে মাঝে সজাগ হয়ে চিত্কার করে ওঠে, সৈয়দ আশরাফও তেমনি কিছুদিন নীরব থেকে হঠাত্ করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন। তখন মনে হয়, অতীতের রাজা-বাদশাহদের মতো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করে ছাড়তেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, সৈয়দ আশরাফের মস্তিষ্কও তাঁর মতোই পার্ট-টাইম কাজ করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এর আগে দু’বারের সফর বাতিল করার পর ৫ মে ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বলে গেছেন, মার্কিন সরকার চায়, সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। সব দলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সংলাপের পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন তিনি। তাঁরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় দেশের মানুষ। মোটামুটি একই সময় লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও বলেছেন একই কথা।
হিলারি ক্লিনটন আরও একটা হুশিয়ারি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, এমন কাউকে সত্বর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান নিযুক্ত করতে হবে, যাতে এই বিশ্ববিদিত প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে না যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর বর্তমান সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকের এবং গ্রামীণ ফোনের ওপর যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলের লোলুপ দৃষ্টি আছে সেসব কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন হিলারি। তাঁর হুশিয়ারি ছিল সেজন্য।
‘গোমর ফাঁক’ হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় পার্ট-টাইম মন্ত্রী, পার্ট-টাইম মহাসচিব এবং ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফ গাত্রদাহ সামলাতে পারেননি। অমার্জিত এবং গণ্ডমূর্খের মতো আবোল-তাবোল সমালোচনা করেছেন তিনি ড. ইউনূস এবং কিছু পরিমাণে হিলারি ক্লিনটনের। সেইসঙ্গে নোবেল পুরস্কার কমিটি এবং যাঁরা কমিটির কাছে ড. ইউনুসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, পরোক্ষভাবে তাঁদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেছেন অন্তঃসারশূন্য সৈয়দ আশরাফ। আশরাফ বলেছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে হলে নাকি কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থামাতে হয়। কোন কেতাবে তিনি পড়েছেন সে কথা? ড. ইউনূসের বিশ্ব-সম্মানিত ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার জন্য কেন তাঁর আকুতি?
কোথায় রানী রাসমণি আর কোথায় রইস্যার নানী?
বিশ্বনেতারা কি এতই হাভাতে যে ‘হোয়াইট ওয়াইন’ খেয়ে তাঁরা কাউকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সুপারিশ করবেন? অথবা নোবেল কমিটির সদস্যরা হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে কাউকে পুরস্কার দেবেন? তাই যদি হবে তাহলে শেখ হাসিনা কেন কূটনীতিকদের দেশে দেশে তদবির করতে পাঠিয়েও নোবেল পুরস্কার পেলেন না? আগের বারে তো আমলাদের বহু দেশে পাঠিয়ে ডক্টরেট খরিদ করানো হয়েছিল। তাও একটা-দুটো নয়, পুরো এক ডজন। বিশ্বনেতাদের কিংবা নোবেল কমিটিকে হোয়াইট ওয়াইন খাওয়ানোর সামর্থ্য কি হাসিনার আমলাদের আর কূটনীতিকদের ছিল না?
বুদ্ধিহীনতার প্রতিযোগিতায় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে টেক্কা দিয়েছেন হাসিনার শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। তিনিও সিদ্ধান্ত করেছেন, ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। তাহলে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি কি এই দুই মূর্খ মন্ত্রীর নেত্রী? দিলীপ বড়ুয়ার বিদ্যার আরেকটা মাপকাঠি—তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধে কথা বলতে হলে রাজনীতিতে নামতে হবে ড. ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। অরাজনীতিকদের কি ভোট দেয়ার অধিকার নেই? কেন তাঁরা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না?
শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের এই হচ্ছে নমুনা। মন্ত্রীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লোকের মুখে মুখে। আরও কয়েকজন ষোলো আনা অথর্ব। অর্থমন্ত্রী কখন কী বলেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে এখন দেশের মানুষের মতো বিদেশিরাও হাসাহাসি করে।
ব্যতিক্রম মনে হয় সোহেল তাজকে। তাঁর বাবা তাজউদ্দিন আহমদ একাত্তরে নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পঁচাত্তরে জেলে নিহত নেতাদের তিনি অন্যতম। হাসিনা সোহেলকে স্বরাষ্ট্র দফতরে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। কিছুকাল পরেই তিনি আমেরিকায় পরিবারের কাছে ফিরে যান। প্রথমে তিনি ছুটির আবেদন করেন, পরে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান। তাঁর পদত্যাগ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেন, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আড়াই বছরের বেতন-ভাতা ইত্যাদি ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়েছে। সোহেল তাজ তার প্রতিবাদ করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও পদত্যাগপত্র পাঠান স্পিকারের কাছে। হয়তো গণভবনের নির্দেশেই স্পিকার সোহেলের পদত্যাগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে যাচ্ছেন। সোহেল তাজ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, বলেছেন, অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ গৃহীত এবং ব্যাংক থেকে তাঁর প্রাপ্য নয়, এমন টাকা ফেরত নেয়া না হলে তিনি অনেক গোমর ফাঁক করে দেবেন।
ধারণা করা হয় মন্ত্রীপদে কিছুকাল থেকেই সোহেল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুর্নীতি আর অপকর্মের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন। গা-বাঁচানোর জন্যই তিনি আমেরিকায় ফেরত গিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে, সরকার কেন চায় না যে তিনি মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিন? একটা কারণ অবশ্যই এই যে, তাঁর আসন শূন্য হলে সেখানে উপনির্বাচন দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের গণসমর্থন-হীনতা প্রমাণ হয়ে যাবে। অন্য একটা কারণ অবশ্যই নিহিত আছে সোহেল তাজের হুমকির মধ্যে। কী গোপন তথ্য তিনি ফাঁস করতে চান এবং সে ভয়ে সরকারই বা কেন এমন আতঙ্কিত?
প্রাচ্যের মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতেও বিশ্বাস করা হয় যে, বিধাতা কাউকে ধ্বংস করার আগে তাকে উন্মাদ করে দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের আর সে দলের নেতাদের কাণ্ডকারখানা কি সে অবস্থারই ইঙ্গিত দেয় না? (লন্ডন, ১৩.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com
বিবিসি থেকে ১৯৬৯ সালে ‘পাকিস্তানের রাজনীতি’ শীর্ষক একপ্রস্থ সাক্ষাত্কার প্রচার করেছিলাম। তত্কালীন পাকিস্তানের উভয় দিকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম সেজন্য। সেপ্টেম্বরের এক সকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিতে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যাই। মুজিব ভাই ভোরে ভোরে যেতে বলেছিলেন। ভাবী আমাদের নাশতা খাওয়ালেন। সাক্ষাত্কার ছাড়াও পুরনো পরিচয়ের জের ধরে অনেক কথা হয়েছিল।
তখন জোর জল্পনা-কল্পনা চলছিল যে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। সে বছরের জুন মাসে মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। বস্তুত গণআন্দোলনের তোড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার জুন মাসে তাঁকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তাঁর নজিরবিহীন জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করি। তিনি বললেন, দেশে লোকে আমাকে চেনে, জানি; কিন্তু বিদেশে তো কেউ আমাকে চেনে না। আমি বললাম, আপনি লন্ডনে আসুন, বিশ্বমিডিয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো।
সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন এবং আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলাম। ব্রিটিশ ও বিদেশি মিলে ৪১ সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি। বিবিসিতে বাংলায় আমি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাত্কার প্রচার করি। ভাষ্যকার এভান চার্লটনের সঙ্গে তাঁর ইংরেজি সাক্ষাত্কার বিবিসির আরও কয়টি বিদেশি অনুষ্ঠান বিভাগ অনুবাদ করে প্রচার করেছিল।
ভারতে প্রায় ছয় বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন। কিছুদিন পরেই তিনি লন্ডনে আসেন। আমি ঠিক করেছিলাম তাঁকেও মিডিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। বিবিসি বুশ হাউসের বার্তা বিভাগে তাঁর জন্য আমি একটা চা-চক্রের আয়োজন করি। আশা ছিল বিবিসির সব বিভাগের কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে একান্তে তাঁর আলোচনার সুযোগ হবে। কিন্তু হাসিনা এলেন এক পাল চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে। একান্ত আলাপের সুযোগ রইল না। অগত্যা সহকর্মী জন রেনার আর আমি তাঁকে স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলাম বাংলা ও ইংরেজিতে সাক্ষাত্কারের জন্য।
ইংরেজি সাক্ষাত্কারে জন গোড়াতেই হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে তাঁর ভালো লাগছে কিনা। তিনি বললেন, মোটেই না, রাজনীতি তাঁর ভালো লাগে না, রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন। জন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন আপনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হতে গেলেন। আরও বিস্ময় অবশিষ্ট ছিল আমাদের জন্য। হাসিনা বললেন, ওরা তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে, মাকে হত্যা করেছে, ভাইদের হত্যা করেছে, তাঁদের জন্য বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি, প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন।
ইশারায় জনের অনুমতি নিয়ে আমি স্টুডিয়ো ম্যানেজারকে বললাম, রেকর্ডিং থামিতে দিতে। নেত্রীকে বুঝিয়ে বললাম, তাঁর এসব কথা বিবিসি থেকে প্রচারিত হলে রাজনীতিতে তাঁর ক্ষতি হবে। আমার কথা যেন তাঁর বিশ্বাস হলো না। তখন আমি বললাম, বাংলাদেশের সব মানুষেরই তো বাবা-মা খুন হয়নি, তারা কেন প্রতিশোধ নিতে ভোট দিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করবে। যা হোক, সে অংশটা বাদ দিয়ে আবার শেখ হাসিনার সাক্ষাত্কারের রেকর্ডিং শুরু হলো।
হাসিনার প্রতিশোধ
তার পর থেকে বহুবার আমার মনে হয়েছে, হাসিনার সে উক্তিগুলো কথার কথা ছিল না, সত্য সত্যই তাঁর রাজনীতিতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ-বাসনা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের ওপর, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপরই প্রতিশোধ নিতে চান এবং সে স্পৃহা তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন আছেন। তার আগেও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। উভয় মেয়াদেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ। প্রতিশোধের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের অনুপস্থিতিতে ডানে-বাঁয়ে যাকে পাচ্ছেন সবার বিরুদ্ধেই তিনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন বলে মনে হয়। ছায়াছবিতে হয়তো দেখেছেন, গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ চলতে নায়ক রামদা দিয়ে ডানে-বাঁয়ে কুপিয়ে পথ করে নিচ্ছেন।
ছিয়ান্নব্বইতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা একটা সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন। তারা বহু হত্যা-নির্যাতন করেছে। বহু চোরচোট্টা, দাগাবাজ আর খুনি এই ক্যাডারে ঢুকে পড়েছিল। ঢাকার মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. এইচবি ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডাররা বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। লক্ষ্মীপুরে গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে ছিনতাই করে। তাঁর বস্তাভর্তি টুকরো টুকরো লাশ পরে নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। শামিম ওসমানের অত্যাচারে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শামিমের আফিসে মজুত বোমা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁরা কি শাড়ি পরেন নাকি, কেন তাঁরা একটার বদলে দশটা লাশ ফেলতে পারেন না।
চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা ক্যাডারদের মতো আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর গুণ্ডাদেরও লেলিয়ে দিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন করার কাজে। কয়েক হাজার লোককে তারা খুন করেছে। সেইসঙ্গে দলীয়কৃত পুলিশ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। র্যাব কয়েকশ’ কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। এখন আবার চলছে ‘গুম’ করার পালা। সর্বশেষ গুম হয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এবং এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তাঁর ড্রাইভার। তার কয়েক দিন আগে গুম হন সুরঞ্জিতের সহকারী একান্ত সচিবের ড্রাইভার, যিনি সে দুর্নীতি বিজিবির কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া ড্রাইভারদের গুম করার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না।
বহু হাজার মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে এবং হচ্ছে সরকারের প্রতিভূদের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা ৭৮৬টি মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। হালে ঘোষণা করা হয়েছে, আরও ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। ১৯ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বহু দুষ্কৃতকারীকে কারামুক্ত করা হয়েছে। এদের এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর আগাগোড়া ব্যর্থতা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মর্মান্তিক ইতিহাস। তার ওপরও পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি জাতির রক্ত চুষে খেয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি ব্যবসায়িক ‘গ্রুপ’ এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। তেত্রিশ লাখ স্বল্পবিত্ত মানুষ নিজেদের যত্সামান্য সঞ্চয় শেয়ারবাজারে নিয়োগ করেছিলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল সেটাও লুট করেছে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশের ভেতর টাকার স্বল্পতার এই হচ্ছে কারণ।
সরকারের নিয়ন্ত্রিত তদন্ত কমিটি লুটেরাদের তালিকাসহ যে রিপোর্ট দিয়েছে সরকার সেটাও গুম করে ফেলেছে। এই লুটপাটের যারা হোতা তাদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংক দু-দুটি প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজদের নামও বলে দিয়েছে। সেসব নাম প্রকাশ করার সাহস হচ্ছে না সরকারের। জনসাধারণ সঙ্গতভাবেই ধরে নিয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন।
বিপন্ন স্বাধীনতা, বিপন্ন সার্বভৌমত্ব
বাংলাদেশে এখন আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, বিচার নেই, সুশাসন নেই। সময়ে হয়তো সেসবেরও সংস্কার করা সম্ভব হতো, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ‘কমপ্রোমাইস’ করে সে সম্ভাবনার দ্বারও রুদ্ধ করে দিয়েছেন। ভারতকে বিনা মাশুলে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী এবং বন্দরগুলো, অর্থাত্ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মূল উপাদানগুলো উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একথা সর্বত্রই বলাবলি হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের ক্ষতি করে ভারতের কল্যাণ-চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন।
শুনেছি, বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগগুলোতে ভারতীয়রা উপদেষ্টা হয়েছেন। দুর্নীতি ধরা পড়ায় রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সীমান্তের ওপারের নির্দেশে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তাঁকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ প্রকৃতই বিপন্ন। এসব কি প্রমাণ করে না, শেখ হাসিনার প্রতিশোধ নেয়ার পালা আজও শেষ হয়নি? তাঁর নিহত বাবা-মা ও ভাইদের জন্য কেউ কাঁদেনি বলে আজও তিনি বাংলাদেশের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন?
বাংলাদেশের স্বল্পকালের রক্তঝরা ইতিহাসে বহু হিংস্রতা ও রক্তপাত ঘটেছে। পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগের চার নেতা কারাগারেই নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের কারও কারও ছেলেকে হাসিনা তাঁর সরকারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সর্বসাধারণ মনে করেছিল, বংশধরদের মন্ত্রীপদ দিয়ে হাসিনা নিহত নেতাদের স্মৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একটু খতিয়ে দেখলে মনে হবে, শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর প্রতিশোধের অভিযানে সহযোদ্ধাই খুঁজতে চেয়েছেন। বিকল্প ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরে হাসিনার প্রতিশোধ-স্পৃহা তাঁদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।
হাসিনার প্রথম সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। জেলে নিহত নেতাদের একজন ছিলেন তাঁর বাবা। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত প্রায়ই সাধারণ বুদ্ধিকে আহত করেছে। একসময়ে উচ্চ আদালতের বহু সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম বিচারকদের ভয় দেখাতে ‘গজারি কাঠের’ লাঠিধারী ব্যক্তিদের মিছিল নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ভবন প্রদক্ষিণ করেছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্যি তেমন কিছু করার প্রয়োজন হয়নি। সরকার গঠনের শুরু থেকেই ‘কমিটেড’ আওয়ামী লীগপন্থীদের বিচারক নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে সরকার-সমর্থকদের গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা পূরণের রায়গুলো সম্ভব হচ্ছে সে কারণে।
পার্ট-টাইম মন্ত্রীর পার্ট-টাইম মস্তিষ্ক
কারাগারে নিহত নেতাদের অন্য একজনের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অনেকেই বলে থাকেন, উভয় পদেই তিনি ‘পার্ট-টাইম’ দখলদার। ভাং কিংবা আফিমখোর ব্যক্তি যেমন মাঝে মাঝে সজাগ হয়ে চিত্কার করে ওঠে, সৈয়দ আশরাফও তেমনি কিছুদিন নীরব থেকে হঠাত্ করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন। তখন মনে হয়, অতীতের রাজা-বাদশাহদের মতো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করে ছাড়তেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, সৈয়দ আশরাফের মস্তিষ্কও তাঁর মতোই পার্ট-টাইম কাজ করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এর আগে দু’বারের সফর বাতিল করার পর ৫ মে ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বলে গেছেন, মার্কিন সরকার চায়, সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। সব দলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সংলাপের পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন তিনি। তাঁরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় দেশের মানুষ। মোটামুটি একই সময় লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও বলেছেন একই কথা।
হিলারি ক্লিনটন আরও একটা হুশিয়ারি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, এমন কাউকে সত্বর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান নিযুক্ত করতে হবে, যাতে এই বিশ্ববিদিত প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে না যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর বর্তমান সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকের এবং গ্রামীণ ফোনের ওপর যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলের লোলুপ দৃষ্টি আছে সেসব কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন হিলারি। তাঁর হুশিয়ারি ছিল সেজন্য।
‘গোমর ফাঁক’ হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় পার্ট-টাইম মন্ত্রী, পার্ট-টাইম মহাসচিব এবং ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফ গাত্রদাহ সামলাতে পারেননি। অমার্জিত এবং গণ্ডমূর্খের মতো আবোল-তাবোল সমালোচনা করেছেন তিনি ড. ইউনূস এবং কিছু পরিমাণে হিলারি ক্লিনটনের। সেইসঙ্গে নোবেল পুরস্কার কমিটি এবং যাঁরা কমিটির কাছে ড. ইউনুসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, পরোক্ষভাবে তাঁদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেছেন অন্তঃসারশূন্য সৈয়দ আশরাফ। আশরাফ বলেছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে হলে নাকি কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থামাতে হয়। কোন কেতাবে তিনি পড়েছেন সে কথা? ড. ইউনূসের বিশ্ব-সম্মানিত ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার জন্য কেন তাঁর আকুতি?
কোথায় রানী রাসমণি আর কোথায় রইস্যার নানী?
বিশ্বনেতারা কি এতই হাভাতে যে ‘হোয়াইট ওয়াইন’ খেয়ে তাঁরা কাউকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সুপারিশ করবেন? অথবা নোবেল কমিটির সদস্যরা হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে কাউকে পুরস্কার দেবেন? তাই যদি হবে তাহলে শেখ হাসিনা কেন কূটনীতিকদের দেশে দেশে তদবির করতে পাঠিয়েও নোবেল পুরস্কার পেলেন না? আগের বারে তো আমলাদের বহু দেশে পাঠিয়ে ডক্টরেট খরিদ করানো হয়েছিল। তাও একটা-দুটো নয়, পুরো এক ডজন। বিশ্বনেতাদের কিংবা নোবেল কমিটিকে হোয়াইট ওয়াইন খাওয়ানোর সামর্থ্য কি হাসিনার আমলাদের আর কূটনীতিকদের ছিল না?
বুদ্ধিহীনতার প্রতিযোগিতায় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে টেক্কা দিয়েছেন হাসিনার শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। তিনিও সিদ্ধান্ত করেছেন, ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। তাহলে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি কি এই দুই মূর্খ মন্ত্রীর নেত্রী? দিলীপ বড়ুয়ার বিদ্যার আরেকটা মাপকাঠি—তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধে কথা বলতে হলে রাজনীতিতে নামতে হবে ড. ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। অরাজনীতিকদের কি ভোট দেয়ার অধিকার নেই? কেন তাঁরা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না?
শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের এই হচ্ছে নমুনা। মন্ত্রীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লোকের মুখে মুখে। আরও কয়েকজন ষোলো আনা অথর্ব। অর্থমন্ত্রী কখন কী বলেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে এখন দেশের মানুষের মতো বিদেশিরাও হাসাহাসি করে।
ব্যতিক্রম মনে হয় সোহেল তাজকে। তাঁর বাবা তাজউদ্দিন আহমদ একাত্তরে নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পঁচাত্তরে জেলে নিহত নেতাদের তিনি অন্যতম। হাসিনা সোহেলকে স্বরাষ্ট্র দফতরে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। কিছুকাল পরেই তিনি আমেরিকায় পরিবারের কাছে ফিরে যান। প্রথমে তিনি ছুটির আবেদন করেন, পরে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান। তাঁর পদত্যাগ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেন, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আড়াই বছরের বেতন-ভাতা ইত্যাদি ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়েছে। সোহেল তাজ তার প্রতিবাদ করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও পদত্যাগপত্র পাঠান স্পিকারের কাছে। হয়তো গণভবনের নির্দেশেই স্পিকার সোহেলের পদত্যাগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে যাচ্ছেন। সোহেল তাজ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, বলেছেন, অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ গৃহীত এবং ব্যাংক থেকে তাঁর প্রাপ্য নয়, এমন টাকা ফেরত নেয়া না হলে তিনি অনেক গোমর ফাঁক করে দেবেন।
ধারণা করা হয় মন্ত্রীপদে কিছুকাল থেকেই সোহেল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুর্নীতি আর অপকর্মের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন। গা-বাঁচানোর জন্যই তিনি আমেরিকায় ফেরত গিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে, সরকার কেন চায় না যে তিনি মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিন? একটা কারণ অবশ্যই এই যে, তাঁর আসন শূন্য হলে সেখানে উপনির্বাচন দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের গণসমর্থন-হীনতা প্রমাণ হয়ে যাবে। অন্য একটা কারণ অবশ্যই নিহিত আছে সোহেল তাজের হুমকির মধ্যে। কী গোপন তথ্য তিনি ফাঁস করতে চান এবং সে ভয়ে সরকারই বা কেন এমন আতঙ্কিত?
প্রাচ্যের মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতেও বিশ্বাস করা হয় যে, বিধাতা কাউকে ধ্বংস করার আগে তাকে উন্মাদ করে দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের আর সে দলের নেতাদের কাণ্ডকারখানা কি সে অবস্থারই ইঙ্গিত দেয় না? (লন্ডন, ১৩.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন