বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

অন্যায়ের দেশ- আজকের বাংলাদেশ

অন্যায়ের দেশÑ আজকের বাংলাদেশ


॥ সিরাজুর রহমান ॥

কলকাতায় আমার স্কুলজীবনের শেষ দু-তিন বছর অনেক দেখেছি। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে দু-একটা করে আন্দোলন হতো নানা অসিলায়। আসল লক্ষ্য অবশ্যই ছিল ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে। প্রায়ই দেখা যেত মিছিলের ভিড় থেকে কেউ একজন পুলিশের দিকে একটা ঢিল ছুড়ল। আর যায় কোথায়! দ্রুম-দ্রাম গুলিবর্ষণ শুরু করল পুলিশ, কিছু লোক লুটিয়ে পড়ল, পিচ ঢাকা কালো রাস্তা লাল হয়ে গেল তাজা রক্তে।
কথাটার উৎপত্তি ফরাসি ভাষা থেকেÑ অ্যাজাং প্রভকেৎররাÑ পুলিশের গোয়েন্দা কিংবা ভাড়া করা লোক, যারা উসকানি দিয়ে জনতাকে দুষ্কৃত করতে এবং পুলিশকে গুলি চালানো এবং অন্যান্য নির্যাতনে প্ররোচনা দেয়। বর্তমান বাংলাদেশে ব্যাপারটা অহরহ ঘটছে। এখানে ঢাকঢাক গুড়গুড়ের প্রয়োজন নেই। পুলিশে আর শাসক দলের গুণ্ডাতে কোনো তফাত নেই। উভয়েরই লক্ষ্য হলো দেশে যারা গণতন্ত্র চায় এবং যারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরতন্ত্রী শাসনের অবসান চায়, যেকোনো প্রকারেই হোক তাদের নিরস্ত করতে হবে, এমনকি খুন করে হলেও। শাসক দলের গুণ্ডারা বেকায়দায় পড়লে আজকের বাংলাদেশে পুলিশ তাদের সংরক্ষণ দেয়। এই হচ্ছে তফাত।
সে কালের মানুষ ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে তারা ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। বহু খুন করে, বহু রক্ত ঝরিয়েও ব্রিটিশরা তাদের নিরস্ত করতে পারেনি। আজকের বাংলাদেশের মানুষ একটা ব্যর্থ, অপদার্থ, নির্যাতক আর একটি বিদেশী রাষ্ট্রের অঙ্গুলি তাড়নে পরিচালিত সরকারকে বিতাড়িত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। দলীয়কৃত পুলিশ, ঘাতক দল এবং সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দাদের অত্যাচার-নির্যাতনে তারা নিরস্ত হবে না।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ক্ষমতাসীন সরকারের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বেলায়? দেশের মানুষ মনে করে বিগত সাড়ে তিন বছরে হাজার হাজার প্রাণহানি হয়েছে সরকারের নির্দেশে। এ সরকার গদি চিরস্থায়ী করতে চায়। অন্য কোনো বিবেচনা তাদের মাথায় আসে না। দায়িত্ববোধের তো প্রশ্নই ওঠে না। এই যে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন হলো এই সাড়ে তিন বছরে, তার কোনো একটির সুরাহা হয়েছে কি? 
স্বামী-স্ত্রী দু’জন সাংবাদিক খুন হলেন। মেহেরুন রুনি আর সাগরের পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি করলেন, ঢাকঢোল পিটিয়ে মিডিয়াকে বললেন, তিনি তার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু শিশুটিকে যারা পিতৃ-মাতৃ হারা করল তাদের কী শাস্তি হলো? খুনিরা কি ধরা পড়ল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিনি খুনিদের পাকড়াও করবেন। বহু ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারো ঢাকঢোল পিটিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, রুনি আর সাগরের ঘাতকদের গ্রেফতারের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কী লাভ হলো তাতে? হাইকোর্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ডেকে তম্ভি করলেন, তারা বললেন, খুনিদের গ্রেফতারে তারা অপারগ, তারপর দায়িত্ব দেয়া হলো র‌্যাবকে। র‌্যাবই বা কী ভোজবাজি দেখিয়েছে? আমরা গোড়ার দিন থেকে বলে এসেছি, সাংবাদিক দম্পতির খুনের কোনো সুরাহা হবে না, খুনিরা ধরা পড়বে না, কেননা তারা সরকারের হুকুমের লোক, সরকারের ভেতরের কারো না কারো নির্দেশে সরকারের ভেতরের দুর্নীতির খবর ফাঁস করা বন্ধ করার মতলবে তাদের খুন করা হয়েছে। প্রমাণ হয়ে গেল দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি আসলে ছিল সত্য ধামাচাপা দেয়ার কারসাজি।
ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন দুই সপ্তাহ হতে চলল। তার ওপর সরকারের ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের আক্রোশ অবশ্যই ছিল। ইলিয়াস প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন, তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন, বৃহত্তর সিলেটে আওয়ামী লীগের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষক দেশ ভারত অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে সেসব নদীর পানি মধ্য ভারতে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশ মরুভূমি হয়ে যাক তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না। তারা টিপাইমুখে বরাক নদীর ওপর বাঁধ তৈরি করছে। 
হাসিনার সরকারের মুখ থেকে প্রতিবাদের টুঁ শব্দটিও উচ্চারিত হচ্ছে না। ইলিয়াস আলী বৃহত্তর সিলেটে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করলেন, লাখ লাখ লোক সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাল। উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী যন্ত্রপাতি এবং হয়তো ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাতে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতরে এসে তিতাস নদী ও ১৪টি খালে বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিলো। তার বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ কণ্ঠ উচ্চারিত হলো ইলিয়াস আলী তাতেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। দেশে ও বিদেশে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, প্রায় সবাই বলছে, তার গুম হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকার এবং র‌্যাবের হাত আছে। 
কেন? র‌্যাব এর আগেও শতাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুম করেছে এবং সরকারের নীরবতা দেখে প্রমাণ হচ্ছে, সরকার ও শাসক দলের নির্দেশে এই গুম ও খুন করার ঘটনাগুলো ঘটছে। অন্তত এটা তো প্রমাণ হয়েছে যে, খুনিদের খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা সরকারের দিক থেকে হয়নি। ইউরোপ-আমেরিকায় সংসদগুলো এবং সংসদ সদস্যরা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো অবিলম্বে ইলিয়াস আলীর মুক্তি দাবি করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা উল্টোপাল্টা এবং পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছেন। ঠিক যে রকমটা করা হয়েছিল রুনি আর সাগরের হত্যার ব্যাপারে। অর্থাৎ সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার সব রকমের চেষ্টা চলছে।
ইলিয়াস আলীর শোকাতুর স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা তার মুক্তির জন্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। তাতে কোনো ফল হয়নি। পাষাণের হৃদয় এতটুকু কম্পিত হয়নি। তার স্ত্রী উপায়ান্তরবিহীন হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারাও ইলিয়াস আলীকে মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সরকারের ইচ্ছা থাকলে কাজটা মোটেই কঠিন নয়। 

এ আন্দোলন যে কারণে অপরিহার্য 
ইলিয়াস আলীকে র‌্যাব কিংবা অন্য কোনো তথাকথিত নিরাপত্তা এজেন্সি গুম করে থাকলে সরকার হুকুম দিলেই তাকে ছেড়ে দেয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর হৃদয়হীন পরিহাস অনুযায়ী খালেদা জিয়ার নির্দেশে যদি ইলিয়াস আলী আত্মগোপন করে থাকেন তাহলেও এত দিনে তাকে খুঁজে বের করা পুলিশ, র‌্যাব কিংবা সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের উচিত ছিল। তারা দেশের সব মানুষের হাঁড়ির খবর রাখছে, দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার, গুম কিংবা খুন করছে, আর এই বিখ্যাত নেতার খোঁজ পাওয়ার সাধ্যি তাদের হলো না? উন্মাদ না হলে সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। 
সোজা আঙুলে ঘি বের করা না গেলে আঙুল একটা বাঁকা করতে হয় বৈকি! ১৮ দলের জোটকে সেজন্যই আন্দোলনের পথ ধরতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকেরা সবাই স্বীকার করেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিশেষ করে বিএনপি যত আন্দোলন করেছে প্রত্যেকটি ছিল শান্তিপূর্ণ। ১২ মার্চ ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে রক্তারক্তি করার লক্ষ্যে একই দিন আওয়ামী লীগও ঢাকায় কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে খালেদা জিয়া তার কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে দেন। কিন্তু যেখানেই আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর গুণ্ডারা ময়দানে নেমে পড়েছে, কিছু কিছু অশান্তি মাত্র সেখানেই হয়েছে।
বিদেশী মিডিয়ায় এবং ইন্টারনেটে খবর ছড়াচ্ছে যে, আওয়ামী লীগের এক শ’ নেতা-কর্মীকে দেরাদুনে ভারতীয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এদের নাম দেয়া হয়েছে ক্রুসেডার। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ইউরোপের খ্রিষ্টান রাজারা ফিলিস্তিনের মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন সেটাকে বলা হতো ক্রুসেড। সে নাম ধার নিয়ে আওয়ামী লীগ কি ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে? স্পষ্টতই ভারতের এ আচরণ বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করার প্ররোচনা। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার খবরে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এতে তিনজন নিহত হয়েছেন। দেখা গেছে, যে গুলিতে তারা মারা গেছে, সে গুলি ব্যবহারের উপযোগী কোনো অস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশের নেই। তাহলে গুলি চালাল কারা? ভারতের দেয়া উন্নত অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগের ক্রুসেডাররা? 
অ্যাজাং প্রভকেৎরের (উসকানিদাতা) প্রশ্ন সে জন্যই উঠছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, হরতালে শান্তি রক্ষা করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়; হরতাল প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগ কর্মীরাও মাঠে নামবে। গত রবি ও সোমবারের হরতালে তারা মাঠে নেমেছে এবং ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপের অনেকগুলো ঘটনা ঘটিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উক্তি আর এসব অঘটনের মধ্যে যোগাযোগ খুঁজে বের করতে দেশের মানুষের এতটুকু অসুবিধা হবে না। 

এত অন্যায় আগে কেউ দেখেছে? 
ব্রিটিশ রাজের শেষের দিনগুলোতে তাদের যেন মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। জেল-জুলুম তখন মানবতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গদি হারানোর ভয়ে আওয়ামী লীগ সরকারেরও হয়েছে সে অবস্থা। সন্ত্রাস চালিয়ে তাদের কোনো লাভ হয়নি। তারা এখন গ্রেফতার, পাইকারি মামলা, বাড়ি-বাড়ি তল্লাশি ইত্যাদি দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। সচিবালয়ে কারা ককটেল ফাটিয়েছে? গাড়ি-বাস কারা ভাঙচুর করেছে? ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির অজুহাত হিসেবে অ্যাজাং প্রভকেৎররা যে সেসব ঘটনা ঘটায়নি তার প্রমাণ কোথায়? অপদার্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লেজুড় টুকু বলেছেন, এসব ঘটনার জন্য বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘হুকুমের আসামি। একই কারণে আওয়ামী লীগ গুণ্ডাদের, দলীয়কৃত পুলিশ ও র‌্যাবের খুন-খারাবির জন্য সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা কি হুকুমের আসামি নন?
এই সরকার গদি পেয়ে প্রথমেই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮৬টা মামলা তুলে নিয়েছিল। যাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা ছিল তারা ‘হুকুমের আসামি’ ছিলেন না, তাদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। ১৫টি জাজ্বল্যমান দুর্নীতির মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। খুনের আসামিও ছিল অনেকে। একজন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচ বি এম ইকবাল। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ১৯৯৬ সালে খিলগাঁওয়ে বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। সে ঘটনার আলোকচিত্র প্রায় সব পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন খুনিকে এ সরকার এ যাবৎ মুক্তি দিয়েছে। এখন আবার আরো ২৯৭ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর দুষ্কৃতির মামলা তুলে নেয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অবশ্যই এরা সবাই আওয়ামী লীগের দুষ্কৃতকারী। অন্যায় আর অবিচারের এর চেয়ে জঘন্য দৃষ্টান্ত আর কোথায় পাওয়া যাবে?
ধরপাকড় আর তল্লাশি ব্রিটিশরা চালিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের নাভিশ্বাস ওঠার পরে। পাকিস্তানিরা চালিয়েছিল একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পরে? কী লাভ হয়েছে তাতে? ব্রিটিশ রাজ কিংবা পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ কি টিকে থেকেছে? নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার কত দিন টিকে ছিল? এ সরকারেরও দিন শেষ হয়ে আসছে বলেই মনে হয়। গত রোববার রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছে। তার ফলাফল কী হয়েছে সরকার কি দেখতে পায়নি? সাধারণ মানুষ দেখেছে, সোমবারের হরতাল আরো বেশি সফল হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে, তারা একটা ক্রান্তিলগ্নে এসে ঠেকেছে : হয় আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকারকে হঠাতে হবে, নয়তো এ দেশে শান্তিতে বাস অসম্ভব হয়ে যাবে, খুব সম্ভবত আবার তারা ভারতের উপনিবেশে পরিণত হবে। আওয়ামী লীগ যেমন মরণ কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে, দেশের মানুষও এখন বেপরোয়া। তারা একটা গণ-বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
খরার মাঠে মৃতকল্প গরু যখন ঠ্যাং ছোড়াছুড়ি করে, আকাশে তখন শকুনের ঘুরপাক খাওয়া শুরু হয়। ২০০৬ সালের শেষের দিকে এই আলামত আমরা দেখেছি। ভারত আর আমেরিকা থেকে ছোট-বড় কর্মকর্তাদের পদধূলি দানের বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। দিল্লির দূত বীণা সিক্রি সুধা সদনকে তার দ্বিতীয় আফিসে পরিণত করেছিলেন। মার্কিন দূত কালা জাহাঙ্গীর বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন সচিবালয় আর সুধা সদনের মধ্যে ছোটাছুটি করে। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারতে রাজনৈতিক সফর করেছেন, অর্ধ ডজন ঘোড়া উপহার নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এসবের ফলাফল ছিল একটা ষড়যন্ত্র এবং একটা মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচন। আর হ্যাঁ, ভারতের বস্তাবস্তা টাকা আর পরামর্শ। বিগত কিছুকাল থেকে মার্কিন ও অন্য বিদেশী কর্মকর্তাদের আনাগোনা আর ঢাকায় কূটনীতিকদের ছোটাছুটি সেসব কথাই মনে করিয়ে দেয়।

ভিআইপি সফর
গরিবের দুয়ারে হাতির পা। তাও আবার একটা নয়, দুই-দুই জোড়া। একই দিন ঢাকায় আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন, আর ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। কিন্তু গর্বে কোনো বাংলাদেশীর বুক ফুলে উঠছে কি? ভাবছি!
হিলারি কিনটন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক নম্বর প্রিয় ব্যক্তি নন। বাংলাদেশে হিলারি ও তার স্বামীর, বস্তুত আরো অনেক দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রিয়ভাজন হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূস তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের দৌলতে বিশ্বব্যাপী মর্যাদা পেয়েছেন। অপকৌশলে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব থেকে শেখ হাসিনা তাকে সরিয়ে দিয়েছেন। অনেকগুলো কারণের কথা লোকে বলাবলি করে। আগেরবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ডজনখানেক ডক্টরেট তিনি ক্রয় করেছিলেন। এবারে তার সখ হয়েছিল একটা নোবেল পুরস্কারের। নোবেল পুরস্কার কমিটি তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি, বিশ্বসমাজও কমিটির সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে। ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
লোকে আরো বলে, আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের বয়লারে যারা কয়লা জোগায় তাদের কেউ কেউ গ্রামীণ ব্যাংক নামক বস্তুটিকে হাতে পেতে চায়। অন্যরা বলে, গ্রামীণফোনের ওপর কারো কারো লোলুপ দৃষ্টি আছে। এ আবদার উপেক্ষা করা কি কঠিন কাজ নয়? সমস্যা হচ্ছে মুহাম্মদ ইউনূস হাল ধরে থাকতে এই দ্বিমুখী আবদার রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। অতএব ইউনূসকে যেতেই হয়েছে। বিশ্ব নেতারা যথেষ্ট সহানুভূতি দিয়ে হাসিনার সমস্যাগুলো বিবেচনা করেননি। হিলারি কিনটন তো জোর প্রতিবাদই করেছিলেন। এমনকি গোসা করে বাংলাদেশে গোটা দুয়েক সফরও তিনি বাতিল করেছিলেন। সেসব হজম করে হিলারি আসছেন। মনে হচ্ছে গরজ বড় বালাই! 
প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় বিদেশী অতিথি। ভারতীয় নেতাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে সোচ্চারভাবে শেখ হাসিনাকে গদিতে বহাল রাখার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। হাসিনা এখন মহাসমস্যায় আছেন। তার সরকারের জনপ্রিয়তা এখন মাইনাসে নেমে গেছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘ইলিমিনেট’ করার ‘স্ট্র্যাটেজি’ তিনি গদি পাওয়ার প্রথম দিন থেকেই নিয়ে রেখেছিলেন। বিরোধী দলগুলোর কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে তার ক্যাডারগুলো এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্য বলে বর্ণিত গুণ্ডারা। 
তাদের মদদ দিয়েছে র‌্যাব নামে বর্ণিত বর্ণচোরা রক্ষীবাহিনী। তারা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘ক্রসফায়ারের’ নামে কয়েক শ’ রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গুলি করে মেরেছে। বিশ্বব্যাপী তাদের অপকর্মের সমালোচনা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ‘ক্রসফায়ারের’ সংখ্যা হ্রাস করার জন্য তাদের ওপর তাগিদ এসেছে। কিন্তু তারা ‘কোটা‘ পূরণ করছে ঠিকই। গত বছর দুয়েকে তারা বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী ১০০ থেকে ১২২ জন সরকারের বিরোধী ও সমালোচক নেতাকর্মীকে গুম করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেলেও অন্যরা এখনো নিখোঁজ আছে। এ রকমের গুম আর খুন করেছিল একাত্তরের রাজাকার আর আলবদররা। তাদের বিচারের নামে হাসিনা রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। আজকের রাজাকার আর আলবদরদের বিচারও হতে হবে। 

আফগানিস্তানে বাংলাদেশী সৈন্য? 
গরজ বড় বালাই। গরজে পড়েই হিলারি ও প্রণব মুখার্জিকে একই সময়ে হাসিনার দরবারে আসতে হচ্ছে। চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশকে ভারত ছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রধান মিত্র। সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকা পাকিস্তানের সাথে জোট বেঁধেছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন আর নেই। আমেরিকার বড় ভাবনা এখন চীনকে নিয়ে। চীন এখন এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি। চীনের কাছে ঋণে আমেরিকার মাথা পর্যন্ত বন্ধক আছে। সে চীন এখন এক নম্বর সামরিক পরাশক্তি হতে চলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তারে আমেরিকা আর ভারত সমানে উদ্বিগ্ন। চীনের প্রভাব ঠেকাতে আমেরিকা আর ভারত এখন হাতে হাত মিলিয়েছে। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে বলয় সৃষ্টিতে তারা বাংলাদেশকেও জোটে ভেড়াতে চায়। এতে যে বাংলাদেশের সর্বনাশ হবে, তাতে তাদের কিছু আসে-যায় না।
আমেরিকার আরো গরজ আছে। নিত্য তালেবানের পিটানি খেয়ে আমেরিকা এখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। সে শূন্যস্থান পূরণের জন্য তার ভাড়াটে সৈন্য প্রয়োজন। অনেক ঠেকে পাকিস্তান এখন আর আফগানিস্তানে আমেরিকাকে মদদ দিতে রাজি নয়। অন্য দিকে শেখ হাসিনা এখন স্বাধীন প্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিবর্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভাড়াটে বাহিনী হিসেবেই ব্যবহার করতে চান। তাতে কিছু বিদেশী মুদ্রা আসে। ভারতেরও সেটাই মতলব। আসলে ভারত চায় না, বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকুক। কূটনৈতিকপাড়ায় নাকি বলা-কওয়া হচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে হিলারি হাসিনা ওয়াজেদের কাছে আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব দিতে পারেন।
গণতন্ত্রী ১৮ দলের আন্দোলনে হিলারি কিনটন কোনো রকম সমর্থন দেবেন বলে আশা করা যায় না। তবু সৌজন্যের খাতিরে ভিআইপিদের সফর উপলক্ষে ১৮ দলের নেতারা তাদের হরতাল মুলতবি রেখেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া এবং ১৮ দলের নেতাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে তারা যেন কোনো ভিআইপির ফাঁদে পা না দেন। মিষ্টি কথায় ভুলে তারা যদি আন্দোলন বন্ধ করতে রাজি হন, তাহলে হাসিনা হালে পানি পাবেন এবং ১৮ দলের আন্দোলনের কবর তৈরি হবে। দেশবাসী এখন হাসিনা সরকারের পতনের জন্য সম্পূর্ণ সংগঠিত। নেতারা হাসিনাকে দম নিতে দিলে জনতা সেটাকে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলেই বিবেচনা করবে, নতুন করে তাদের সংগঠিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। 

(লন্ডন, ০১.০৫.১২) 
serajurrahman@btinternet.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন