মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ রাজনীতি এখন আর সম্ভব নয়



সিরাজুর রহমান
গভীর সঙ্কটে এখন বাংলাদেশ। সঙ্কট সবারই। সরকারের সামনে মহাচ্যালেঞ্জ। তারা গদি চিরস্থায়ী করতে চায়। সেজন্য তাদের প্রয়োজন ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ এবং নিজেদের আত্মাকেও বিকিয়ে দেয়া। দেশের মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ : তারা সীমাতীত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা হাতছাড়া হতে দেবে না। সরকারবিরোধী বিএনপি এবং গণতন্ত্রকামী ১৮ দলের জোটের জন্য চ্যালেঞ্জ : যে কোনো মূল্যে তারা এই ফ্যাসিস্ট সরকারের অসদুদ্দেশ্য প্রতিহত করবেই।
সরকার এখন মরিয়া। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে জনসাধারণ যেমন সংগঠিত ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে ছলে-বলে-কৌশলে সেটাকে দলন করা না গেলে গদি আর টেঁকে না। শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর ভারতে নির্বাসিত ছিলেন। তখন তার ও তার বোনের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের ওপর। অনেকে বলেন, সে সময় র‘ তার মগজ ধোলাই করে দিয়েছিল। ভারতের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু তাঁর মাথায় ঢোকে না। গদি পাওয়ার দিনটি থেকে তিনি সব বিরুদ্ধ রাজনৈতিক সত্তাকে বিলুপ্ত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন।
বিরোধী দলকে সভা-সমিতি কিংবা মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো অপকৌশলই বাদ দেয়া হয়নি। সরকারের বিরোধী ও সমালোচক হাজার হাজার নেতাকর্মীকে খুন করা কিংবা কয়েদ করে রাখা হয়েছে। ভারত ও আমেরিকার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় ইসলামী সন্ত্রাসী অপবাদ দিয়ে টুপি-দাড়ি-পরিহিত অজস্র বিশ্বাসীকে বন্দী করা হয়েছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকারবিরোধী ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের জেলে ও রিম্যান্ডে নির্যাতন করা হচ্ছে।
প্রধান বিরোধী বিএনপি দলে আন্দোলনের মত ও পথ নিয়ে মতদ্বৈধের কারণে অথর্ব ও স্বাধীনতার দুশমন সরকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব করে সুযোগ ও ইনিশিয়েটিভ হাতছাড়া করা হয়েছে। ছোটখাটো গণতান্ত্রিক দলগুলো স্বতন্ত্র অস্তিত্বের দম্ভের কারণে ঐক্যবদ্ধ হতে অযথা বিলম্ব করেছে। সুযোগকে প্রথম সুযোগেই গ্রহণ করতে হবে—এ মর্মে প্রবাদ বহু দেশে বহু ভাষাতেই আছে। কিন্তু সেগুলো এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের কানে পৌঁছায়নি বলেই মনে হয়। সরকার সে সুযোগে গণতন্ত্রের সব পথে পদে পদে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছে। যতই দিন যাচ্ছে বিরোধী দলগুলোর কাজ ততই দুরূহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জনসাধারণ গোড়া থেকেই এ সরকারকে চিনে ফেলেছে। দশ টাকা কেজির চাল, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্, বিনামূল্যে ফার্টিলাইজার ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি যে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রাতারাতি ধনকুবের বানানোর অজুহাত ছিল সেটা বুঝে উঠতে কারও কষ্ট হয়নি। এটাও তারা বুঝে গেছে যে, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের প্রতিশ্রুতি শুধুই জনসাধারণকে প্রতারণা করার ছল ছিল। কিন্তু যখন থেকে তারা বুঝতে পেরেছে যে তাদের স্বাধীনতা বিপন্ন, ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি‘ লেখা নামাবলী গায়ে দিয়ে এ সরকার তাদের দেশকে ভারতের হাতে তুলে দিতে উদ্যত হয়েছে, তখন থেকে সাধারণ মানুষও আন্দোলনমুখী হয়ে উঠেছে, এ সরকারের অসদুদ্দেশ্যগুলো প্রতিহত করতে তারা রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত হয়েছে। খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের আন্দোলনে ষোলআনা সমর্থনের এই হচ্ছে কারণ।

নির্যাতনের মানচিত্র
গদি হারানোর ভয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছে সরকার। অত্যাচার নির্যাতন হিটলারের ফ্যাসিস্ট নািসদেরও হার মানাতে চলেছে। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি নানা নামে বিনাবিচারে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী বিচার-বহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ২০০৯ সালে ছিল ১৫৪, ২০১০ সালে ১২৭ এবং ২০১১ সালে ৮৪ জন। গত মাসে (এপ্রিল) বিচার-বহির্ভূতভাবে খুন হয়েছে ১১ জন। আন্তর্জাতিক সমালোচনার তোড়ে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করা হলেও গুম করে খুনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে গুম হয়েছিল ২ জন। ২০১০ সালে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৮ আর ২০১১ সালে ৩০ জন। এ যাবত্ গুম হওয়াদের সংখ্যা ১২২-এ দাঁড়িয়েছে বলে বিভিন্ন হিসাবে জানা যাচ্ছে।
সর্বশেষ গুম হয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। তিনি বরাক নদীর ওপর ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির বিরুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন; তিতাস নদী আর ১৪টি শাখা নদী ও খালে বাঁধ বেঁধে উত্তর-পূর্ব ভারতে যন্ত্রপাতি কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর জন্য বিশাল বিশাল ট্রেইলার পাঠানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অনেকের মতে, তাঁকে গুম করার পেছনে আরও একটা বড় কারণ আছে। এ ঘটনার আগে আগেই রেল মন্ত্রণালয়কে ঘিরে বিরাট একটা দুর্নীতি ধরা পড়ে যায়। মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিবের গাড়ি থেকে গভীর রাতে ৭০ লাখ (কোনো কোনো খবর অনুযায়ী চার কোটি ৭০ লাখ) টাকা পাওয়া যায়। সে গাড়িতে আরও ছিলেন বাংলাদেশ রেলের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক এবং নিরাপত্তা প্রধান। সে রাতে এবং পরদিন তারা সবাই বলেছিলেন যে, সে গভীর রাতে তারা যাচ্ছিলেন রেলমন্ত্রীর বাসায়।
সুরঞ্জিত ও সরকার গোড়ায় দুর্নীতির এই রাঘব বোয়ালকে চাপা দিতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টার মতোই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। শোনা যায় বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে হাসিনা আগে থাকতেই সুরঞ্জিতের পদত্যাগ চেয়েছিলেন। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে সীমান্তের ওপার থেকে। পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গভীর রাতে আবার তাকে মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দেয়া হলো। শোনা যায় তার আগে আগেই ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন।
সুরঞ্জিতের দুর্নীতি এবং ইলিয়াসকে গুম
সভ্য দেশে হলে এ কেলেঙ্কারির কারণে শুধু সুরঞ্জিতই নন, গোটা সরকারকেই পদত্যাগ করতে হতো। বর্তমান বাংলাদেশকে সুসভ্য দেশ বলতে হলে এ দেশের বর্তমান সরকারকে অসভ্য বলতেই হবে। অন্যায় স্বীকার করে পদত্যাগ করার মতো মাহাত্ম্য এ সরকারে কারও আছে বলে বিশ্বাস করা যায় না। অনেকেই বিশ্বাস করেন, সুরঞ্জিতকে নিয়ে কেলেঙ্কারি থেকে জনমতকে ভিন্নমুখী করা ইলিয়াস আলীকে গুম করার আরও একটা কারণ ছিল।
বাংলাদেশের মন্ত্রীরা হয় এদেশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, নতুবা তারা মিথ্যা কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আরও একবার সেটা প্রমাণ করলেন। তিনি বলেছেন, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া উদ্বেগের ব্যাপার হলেও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগের বিষয় নয়। মানুষকে ছিনতাই করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, কারও কারও লাশ পাওয়া গেলেও অধিকাংশেরই আর কোনো সন্ধান মিলছে না—এসব যদি উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতি না হয় তাহলে দীপু মনির আবার স্কুলজীবন থেকে শুরু করে কিছু লেখাপড়া শিখে আসা উচিত। দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে অজ্ঞতা ও হৃদয়হীনতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। বিশ্বসমাজ অনেক আগেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ওকাদা গত শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতিতে কিছু সমস্যা আছে।’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় দীপু মনির উপস্থিতিতেই বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যা আর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য অনুরোধ করেছেন। ড. ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে বৈঠকে হিলারি বলেছেন, আমিনুল ইসলামের হত্যা সম্বন্ধে তদন্তে সরকারের ব্যর্থতা মার্কিন ক্রেতাদের কাছে ভুল সঙ্কেত পাঠাবে। নির্লজ্জ এবং হৃদয়হীন না হলে দীপু মনি বলতে পারতেন না, ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগের বিষয় নয়।’
ইলিয়াস আলীকে নিয়ে মন্ত্রীদের উল্টোপাল্টা এবং পরস্পরবিরোধী উক্তি বস্তার ভেতর ছুঁচোদের উন্মাদ ছুটোছুটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোড়ায় বলেছিলেন, ইলিয়াস আলী খালেদা জিয়ার নির্দেশে আত্মগোপন করে আছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় ইলিয়াস আলীর স্ত্রী লুনা গণভবনে স্বামীর মুক্তির প্রার্থনা নিয়ে শেখ হাসিনার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। সে হৃদয়বিদারি পরিস্থিতিতে হাসিনা লুনাকে বলেছিলেন যে তার স্বামীর সন্ধান করা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার কর্তব্য।
কিন্তু তার আগেই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী মন্নুজান ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে বিধবা বলে উল্লেখ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন যে ইলিয়াসকে জীবিত উদ্ধারে সরকার আশাবাদী। আর দলের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন, ‘নিজের সৃষ্ট সন্ত্রাসের দ্বারাই ইলিয়াস আলী খুন হয়েছেন।’ এ কয়টি উক্তি থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে এ সরকার, এ মন্ত্রিসভাকে কিছুতেই সুগঠিত কিংবা সুশৃঙ্খল বলা যাবে না। বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ হয়তো ঠিকই বলেছেন যে ইলিয়াস আলীর খবর জানেন একমাত্র শেখ হাসিনা। কেননা, কোনো কোনো তথাকথিত নিরাপত্তা সংস্থার কাজকর্ম সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরাও কিছু জানেন বলে মনে হয় না।

গণতন্ত্রের আন্দোলন
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি এ সরকারের বিরুদ্ধে বর্তমান পর্যায়ের আন্দোলন ও হরতাল শুরু করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবিতে। দেশের অন্যতম শীর্ষ আইনবেত্তা ড. কামাল হোসেন গত সপ্তাহে আবারও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যে রায়ে আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন সে একই রায়ে আদালত আরও বলেছিলেন যে দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আগামী আরও কয়টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে হতে পারে। কিন্তু রায়ের এ অংশের পরোয়া না করেই সরকার সে পদ্ধতি বাতিল করে দেয়।
স্মরণীয় এই যে, ১৯৯৬ সালে এ পদ্ধতির দাবিতে শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে হরতাল ও আন্দোলন করেছিলেন এবং সে আন্দোলনে প্রচুর রক্ত ঝরেছিল। সে পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার যে আদাজল খেয়ে লেগেছেন তার কারণ বুঝতে কারও বাকি নেই। দলীয়কৃত প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পরিচালনায় সাজানো-পাতানো নির্বাচন ছাড়া হাসিনা ও তার সরকারের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই। বিএনপির আন্দোলনে দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। সব আকারের গণতন্ত্রমনা দলগুলোর জোট গঠনের ফলে আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। খালেদা জিয়া সরকারকে ‘আলটিমেটাম’ দিয়েছিলেন ১০ জুনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা না হলে তারা সরকারের পতনের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করবেন।
তারপর থেকে পরিস্থিতির নাটকীয় ও শোচনীয় অবনতি ঘটেছে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি ইলিয়াস আলীকে গুম করা মাত্র একটা ব্যাপার। ইলিয়াসকে গুম করার বিরুদ্ধে ১৮ দলের জোটের প্রতিবাদ মিছিলের ভেতরে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ঢুকে একটা নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন স্বয়ং স্বীকার করেছেন, প্রতিপক্ষের হরতাল ঠেকাতে তিনি এই ক্যাডারদের নামিয়েছেন। তারা বিশ্বনাথে তিনজন, লক্ষ্মীপুরে একজনসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। বিশেষ করে বিশ্বনাথে প্রমাণ হয়েছে, যে বুলেটে বিরোধী জোটের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ কিংবা র্যাবের অস্ত্রশস্ত্রে সেসব বুলেট ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
শাসক দলের চররা মিছিলের ভিড় থেকে সচিবালয়ে ককটেল বোমা ছুড়েছে, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের কাছে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছে এবং এ জাতীয় আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পুলিশ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদসহ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে এবং দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে তাদের বাসভবনে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে। অধিকাংশ নেতাই সরকারের মতলব বুঝতে পেরেছেন, অন্য কোথাও সরে থেকেছেন।
সরকারের উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল নেতাদের (ব্রিটিশ আমলের মতো) জেলে পুরে রাখলে নেতৃত্ব ও নির্দেশনার অভাবে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়বে। বাস্তবেও অনেকেরই এখন সে আশঙ্কা। মে দিবস এবং হিলারি ক্লিনটন ও প্রণব মুখার্জির সফর উপলক্ষে ১৮ দলের হরতাল স্থগিত রাখা হয়েছে। সবাই স্বীকার করবেন, গণআন্দোলনের প্রকৃতি এই যে অগ্রগতি স্থগিত করা হলে সে আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পায়।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আন্দোলন স্থগিত রাখা কিংবা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া না হলে জনগণ নিজেরা উদ্যোগী হয়েই আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম। গান্ধী-নেহরু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশরা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বকে জেলে পুরে রাখলেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। একাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় সহযোগিতা করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সবাই পালিয়ে গিয়ে দিল্লি সরকারের অতিথি হয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ থেমে যায়নি, মেজর জিয়াউর রহমান প্রমুখ বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তা ও কিছু বুদ্ধিজীবীর অনুপ্রেরণায় সাধারণ মানুষও দেশ স্বাধীন করতে এগিয়ে এসেছিল, স্বাধীনতার জন্য তারা প্রাণ দিয়েছিল।

রিমান্ডের নির্যাতন
অতীতে যেমন দেখা গেছে, এবারও কোনো কোনো মহল সরকারের হয়ে নির্লজ্জ দালালি শুরু করে দিয়েছে। এ সরকারের আমলে লাভবান হয়েছেন এফবিসিসিআইর সদস্যরা। শান্তিতে মুনাফার অঙ্ক বৃদ্ধি করে যাওয়ার লক্ষ্যে এ সংস্থা হরতাল নিষিদ্ধ করে আইন করার দাবি জানিয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় হরতাল কেউই চায় বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু যে যে কারণে হরতাল হচ্ছে সে কারণগুলো দূর করার জন্য কী করেছেন এফবিসিসিআইয়ের সদস্যরা? হিলারি ক্লিনটন যে কূটনৈতিক ভাষায় বলে গেলেন, আমিনুল ইসলামের হত্যার তদন্ত না হলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পাবে না, সে ব্যাপারে কী করছে এফবিসিসিআই? দলীয়কৃত পুলিশ-র্যাব আর আওয়ামী লীগের ক্যাডারগুলো যে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হত্যা করছে সে ব্যাপারে কী করছে তারা? অথবা পাইকারি ধরপাকড় ও ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে?
বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারা বলছেন গ্রেফতারের ভয়ে নয়, রিমান্ডের ভয়েই তারা ধরা দিচ্ছেন না। সেটা অবশ্যই সত্যি কথা। বর্তমান সরকারের আমলে গ্রেফতার ও বিচারের মধ্যবর্তী পর্যায়ে রিম্যান্ড নামক নতুন একটা নির্যাতনযন্ত্র সংযুক্ত হয়েছে। বিচারের আগেই বন্দিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়, তাতে নিশ্চয়ই সরকারের শীর্ষ নেতাদের কারও কারও গায়ের জ্বালা মেটে। দেশের মানুষ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে রিমান্ডে নির্যাতন চালিয়ে তারেক রহমানের কোমর ভেঙে দেয়া হয়েছিল। সে অবস্থার জন্য এখনও তার চিকিত্সা চলছে।
নেতাদের ভয়ভীতি ও আশঙ্কার প্রতি জনসাধারণের ষোলআনা সহানুভূতি আছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে ১০ জুন পর্যন্ত ঝিমিয়ে পড়ে থাকলে আন্দোলন অবশ্যই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। তারপরে আবার আন্দোলনে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। আমার মনে হয়, এ অবস্থায় নেতাদের উচিত জনসাধারণকে আগেভাগেই সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয়া। সে নির্দেশগুলো হবে : তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা, ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফিরিয়ে দেয়া, আটক নেতাদের মুক্তি ও তাদের প্রতি ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করা এবং জামিন প্রভৃতি বিচার পদ্ধতিতে বাধা দেয়ার জন্য র্যাব ও পুলিশ দিয়ে উচ্চ আদালতের বেষ্টনী তুলে নেয়া পর্যন্ত লাগাতার হরতাল ও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
তারপর নেতারা সর্বসাধারণের সামনে এবং সম্ভব হলে সভা-সমাবেশ ডেকে সদলবলে গ্রেফতারবরণ করতে পারেন। তাতে বিশ্বব্যাপী জোরালো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। তেমন অবস্থায় এ সরকারও খুব সম্ভবত তাদের ওপর নির্যাতন চালাতে সাহস পাবে না। তাছাড়া সাময়িকভাবে গ্রেফতার এড়াতে পারলেও তাদের কেউ কেউ যে ‘গুম’ হবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? মনে রাখতে হবে ‘গুম’ হওয়ার চাইতে গ্রেফতার হওয়া অনেক ভালো। তাছাড়া সাধারণ মানুষ যেখানে অহরহ নির্যাতিত হচ্ছে সেখানে নেতারা নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপন করে থাকলে জনমনে ভালো ধারণা সৃষ্টি হয় না। (লন্ডন, ০৬.০৫.১২)
serajurrahman@btinternet.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন