বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১২

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব

যেভাবে এখন পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব


॥ সিরাজুর রহমান ॥

১.
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি। তিনি বলেছেন, সরকার যদি পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের চিঠির বিবরণ প্রকাশ করতে চায় তাহলে বিশ্বব্যাংক আপত্তি করবে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাদের ঐতিহ্য অনুসরণ 
করে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সে চিঠির বয়ান প্রকাশ করবে না।
ইদানীং সরকার যেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। এমন দিন যায় না যেদিন শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতারাও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন না। বহু বিবৃতির মধ্যে একটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক (তার সরকারকে) প্রতারণা করেছে। অন্য এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য এই ব্যাংক সম্বন্ধে অডিট করতে হবে। তার খাদ্যমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসী বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্বন্ধে তদন্ত করবে।
প্রধানমন্ত্রী আর মতিয়া চৌধুরী আত্মপ্রতারণা করছেন। তারা কি এতই শক্তিধর যে তাদের কথায় বাকি পৃথিবী বিশ্বব্যাংক সম্বন্ধে তদন্ত করবে? বিশেষ করে যখন বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ইমেজ ‘নেগেটিভ’। প্রকৃত ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বাংলাদেশের দিক থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে। তাতে কোনো কাজ হয়নি। ব্যাংক তারপর এ ব্যাপারে সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির বিবরণ সরকার গোপন রেখেছে, কিন্তু এক প্রতিবেদনে নাম ধরে এক মন্ত্রী, এক সচিব ও এক ডিরেক্টরের এবং নামোল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। ব্যাংক বলেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না।
অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেন, অভিযোগ সম্বন্ধে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক হতাশ। অর্থাৎ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ব্যাংক মঙ্গলবার আরো একটি বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো প্রতিবিধান করেনি বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন সম্বন্ধে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সম্ভব নয়। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার একটা কারণ অবশ্য এই হতে পারে যে, অভিযুক্তরা এতই উচ্চাসনে উপবিষ্ট ও এতই শক্তিধর যে তাদের শাস্তিদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরং সে জন্য সরকার পদ্মা সেতুটি বিসর্জন দিতেও রাজি আছে। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্যই সরকার ও অন্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছেন।
‘নিজেদের সম্পদ থেকে’ পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের বহু আয়োজনও একই উদ্দেশ্যে আবিষ্কার করা হয়েছে। মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, দেশে নাকি ‘উদ্দীপনার‘ ঢল শুরু হয়েছে। কোন বালক নাকি তার টিফিনের পয়সা সেতু তৈরির জন্য দিতে চেয়েছে। নোয়াখালীর কোন স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের এক দিনের বেতন দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। বিলম্ব না করে দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে। এগুলোর একটি আবার প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকার আশা করছে যে প্রবাসীরা এ অ্যাকাউন্টে বিদেশী মুদ্রা জমা দেবেন।
২.
উদ্দীপনা কিংবা এক বালকের টিফিনের পয়সায় পদ্মার মতো জটিল নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা যায় না। লন্ডন আর নিউ ইয়র্কে যেটুকু লক্ষ করেছি, আগাগোড়া দুর্নীতির চাদরে আবৃত বর্তমান সরকারের হাতে নিজেদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রা তুলে দিতে প্রবাসীরা রাজি হবেন না। তারা জানেন সরকারকে দেয়া অর্থের বেশির ভাগই দুর্নীতির খোরাক জোগাতে লাপাত্তা হয়ে যাবে। সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ যে আওয়ামী লীগ আর অঙ্গসংগঠনগুলোর পকেটে যাবে, তার নমুনা দেখা গেছে গত রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকার এখন পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করেছে। তাতে বর্তমানে দেশজোড়া যে চাঁদাবাজি চলছে সেটাকেই বৈধতা দেয়া হবে। সে চাঁদাবাজির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র মারা গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তাব দিয়েছে, শেয়ার বিক্রি করে সেতুর অর্থায়ন সম্ভব হবে। শত দুঃখের মধ্যেও এ প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের হাস্যোদ্রেক করবে। পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ তাদের যথাসর্বস্ব শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। বহু হাজার কোটি টাকার সে লগ্নি সরকারের পৃষ্ঠপোষকেরা লুটেপুটে খেয়েছে। বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বাবদ জ্বালানি খাত থেকে আরো বহু হাজার কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। তেমনি লুটপাট করেছে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারের আওয়ামী লীগপন্থী সিন্ডিকেটগুলো। যদ্দুর জানা যায়, এই টাকার পাহাড় বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেসব টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সেতুর অর্থায়নের একটা অংশ সংগৃহীত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে সেতু নির্মাণের জন্য অথবা অন্য কোনো কারণে শেয়ারবাজারে লগ্নি করবে।
বলা হচ্ছে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। কোনো কোনো মন্ত্রী বলেছেন, অন্য মন্ত্রী দফতরগুলো থেকেও একই রকমভাবে টাকা নিয়ে সেতু নির্মাণ তহবিলে দেয়া হবে। এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো উন্নয়ন ও মেরামতের কাজ হচ্ছে না। সরকারের তহবিলে টাকা নেই। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্যও সরকারকে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে হয়। শুনেছি, সরকারের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমানতকারীরা নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে সে টাকা ফেরত দেয়ার মতো তারল্য নাকি কোনো কোনো ব্যাংকের নেই। প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলে আমাদের প্রতিরক্ষা, আমাদের সমুদ্রসীমা ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করার কাজ অবশ্যই বিঘিœত হবে। 
৩.
মাত্র দু-তিন দিন আগে পত্রিকায় পড়েছি, দুই শ’রও বেশি ভারতীয় ট্রলার বাংলাদেশ এলাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কোস্ট গার্ডকে দেখা যায়নি। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোও সমানেই সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু মেরামত হয় না। মেঘনা সেতু ধসে পড়েছে বলে দক্ষিণ বাংলাদেশ ও চাঁদপুরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা বিরাট আঘাত। বরাদ্দ অর্থের একটা বড় অংশ পদ্মা সেতু নির্মাণের নামে ছিনিয়ে নেয়া হলে সড়ক আর সেতুগুলো চলাচলের উপযোগী থাকবে না। 
সবচেয়ে বড় কথা দেশী টাকা বড়জোর মাটি কাটা ও জমির ক্ষতিপূরণ দানের কাজেই লাগতে পারে। মোট ব্যয়ের গরিষ্ঠ অংশই ব্যবহৃত হবে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানি বাবদ। সেই বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়া না হলে তারা টাকা দেবে না। তারা না দিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্যান্য উন্নত দেশও টাকা দিতে রাজি হবে না। ফলে দেখা যাবে যত টাকাই সরকার তুলুক না তাতে সেতু তৈরি হবে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই সন্দেহ করেছেন, সংগৃহীত অর্থ আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার এবং ভোট কেনার কাজেই ব্যয়িত হবে।
পদ্মার ওপরে সেতু নির্মাণের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তারা বলেছে, সেতুর আনুমানিক ব্যয় দুই হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ৭০ শতাংশ দেবে চীন এবং তারা তিন বছরের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে। চীন সাম্প্রতিক অতীতে উপহার হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর একাধিক মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে, তাতে নদীর ওপারেও রাজধানীকে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়েছে। চীনারা রাজধানীতে বিশাল চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রটিও তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সর্বগ্রাসী দৃষ্টি পড়েছিল এই সম্মেলন কেন্দ্রের ওপর। তার কপালেও পাল্টানো নাম লিখে দিয়েছেন।
৪.
যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক চীনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। একটা কারণ, নির্মাণব্যয়ের ১০ শতাংশ দক্ষিণা দিতে বিশ্বব্যাংক রাজি হয়নি, চীনারা তো মোটেই দেবে না। আরো বড় কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকেরা সে অনুমতি বর্তমান সরকারকে দেবে না। অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ পুরনো। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে বড় আকারের একটা যুদ্ধও হয়েছিল। ভারতের ‘স্ট্র্যাটেজিস্টরা’ (রণকৌশলবিশারদ) প্রায়ই হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে অরুণাচলে চীনের সাথে বড় যুদ্ধ আসন্ন।
পলাশীর মতো ষড়যন্ত্র করে ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্র্যানজিট, করিডোর ইত্যাদি আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের রেল, সড়ক, নদীপথ ও সমুদ্রবন্দর দু’টি ব্যবহারের অধিকারও বর্তমান সরকার ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ভারত এখন বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতের দৃষ্টি মূলত চীনের সাথে বিরোধ। দুই দেশে যুদ্ধ যদি সত্যি সত্যিই শুরু হয়, একমাত্র বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই ভারত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ রণাঙ্গনে পাঠাতে পারবে।
শুধু তাই নয়। ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন যুদ্ধ শুরু হলে চীন প্রথম চোটেই জলপাইগুড়ির বাগদোগরা বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করবে এবং উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের অন্যান্য অংশের সরু সংযোগ পথটি বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তেমন অবস্থায় ভারত তার জঙ্গিবিমানগুলোর জন্য বাংলাদেশে ঘাঁটি চাইতে বাধ্য হবে। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান সরকার যে আরো একটি ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দর নির্মাণ করতে উৎসাহী, তার কারণও ভারতের এ চাহিদা মেটানো।
চীন এখন অর্থনৈতিক দিক থেকে এক নম্বর পরাশক্তি। অদূর ভবিষ্যতে সে সমরশক্তিতেও এক নম্বরে উঠবে। ভারত আর তার নতুন পাওয়া মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কারণেই চীনকে ঘিরে একটা ব্যূহ রচনা করার চেষ্টা করছে। বঙ্গোপসাগরে একটা নৌঘাঁটি লাভের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের এই হচ্ছে কারণ। চীন যদি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত পদ্মা সেতুিট তৈরি করে দেয় তাহলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা অঞ্চলে চীনের প্রতি শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। সেটা ওয়াশিংটন কিংবা নয়াদিল্লির মুখরোচক হবে না। 
(লন্ডন, ১৭.০৭.১২) 
serajurrahman34@gmail.com

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

বাংলাদেশী মহাসম্মেলন দেখে এলাম নিউ ইয়র্কে

বাংলাদেশী মহাসম্মেলন দেখে এলাম নিউ ইয়র্কে


॥ সিরাজুর রহমান ॥

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বছর যাওয়া হয়নি। একটা কারণ অবশ্যই ছিলÑ জর্জ ডব্লিউ বুশের আট বছরের শাসন। একঝুড়ি মিথ্যা কারণ দেখিয়ে তিনি ও তার আজ্ঞাবহ বন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। বারো-তেরো লাখ মানুষ নিহত হয়েছে ইরাকে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত আর স্থিতিশীল দেশটিতে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আর জীবনযাত্রার সঙ্কট এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি স্থির করেছিলাম, বুশ যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন আমি সে দেশে যাবো না। তারপর অবশ্য আরো বহু কারণ অন্তরায় ঘটিয়েছে।
নিউ ইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানা নিয়মিত আমার কলাম ছাপে। বিদেশে আজকাল বহু বাংলা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। সেটা বাংলাভাষীদের জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তির একটা বড় অবদান। ঠিকানা তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। এ পত্রিকার বয়স ২৩ বছর পেরোল এবং নিয়মিত পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২০।
সাপ্তাহিক ঠিকানার কর্তৃপক্ষ (তারা বলেন ঠিকানা পরিবার) এবার নিয়ে পরপর তিনবার উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশীদের মহাসম্মেলন উদ্যাপন করলেন। তাদের আমন্ত্রণে স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইয়র্ক ঘুরে এলাম। কর্তৃপক্ষ মহাসম্মেলনের নাম দিয়েছে এবিসি (আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা) কনভেনশন। সঠিক কত লাখ কিংবা কোটি হবে বলতে পারব না, তবে উত্তর আমেরিকায় এখন বহু বাঙালির অধিবাস। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বাংলাদেশী অভিবাসীর সাথে তাদের অনেক তফাৎ। বাংলাদেশীরা ইউরোপে প্রথম এসেছিলেন অর্থনৈতিক ভাগ্য ফেরানোর আশায়। অন্য দিকে সাধারণত উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাজীবীরাই উত্তর আমেরিকায় এসেছেন। 
অনেকে এসেছিলেন প্রযুক্তি-প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং মানবিকবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাসমাপন করে অনেকেই দেখলেন, তাদের শিক্ষা ও যোগ্যতার যথাযথ সদ্ব্যবহার করার আয়োজন দেশের নেতারা এখনো করে উঠতে পারেননি। একই সাথে উত্তর আমেরিকায় খুবই সহজে এবং উঁচু বেতনে চাকরি পেতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। এই মহাদেশের দেশগুলো উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে। উন্নতিকে উচ্চতর শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের আরো বহু দক্ষ ও যোগ্য লোকের প্রয়োজন। বহিরাগত ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা পেয়ে সে চাহিদা পূরণ করেন। 
প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দশ-বারো হাজার মাইল দূরে থাকেন বলেই বোধ করি স্বদেশকে তারা এমন গভীরভাবে ভালোবাসেন। দেশের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে, দেশবাসীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে এবং দেশের উন্নতি-প্রগতির পন্থা নিয়ে ভাব-বিনিময়ে তাদের আগ্রহের সীমা-পরিসীমা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশাল-বিস্তীর্ণ দু’টি দেশ। কেউ কেউ দুই কিংবা তিন হাজার মাইল দূর থেকেও স্বদেশীদের সভা-সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন। সৌভাগ্যবশত আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে তারা ভোগেন না। এবিসি কনভেনশনের মতো মহাসম্মেলনগুলো সে কারণেই খুবই জনপ্রিয় এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তর আমেরিকায় ফোবানা (ফেডারেশন অব বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা) নামে আরো একটা সংস্থা আগে এ জাতীয় সভা-সম্মেলন করত। বেশ কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে তাদের একটা মহাসম্মেলনে যোগদানের সুযোগ আমারও হয়েছিল। কিন্তু ফোবানা এখন বহু খণ্ডে বিভক্ত হয়ে নিষ্ক্রিয় এবং নির্জীব হয়ে পড়েছে। শুনেছি বাঙালিদের স্বভাবজাত পরশ্রীকাতরতা এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে অর্থহীন দলাদলি এর কারণ। এবিসি মহাসম্মেলনে উপস্থিত দু-একজন বলছিলেন, এ সম্মেলন ফোবানার শূন্যতা অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছে।
এবিসি সম্মেলন সম্বন্ধে প্রথমেই বলতে হয় তারা অসাধ্য সাধন করেছেন। এই সুদূর থেকে প্রকাশিত একখানি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা সম্পূর্ণ নিজেদের আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য দিয়ে এত বড় একটা আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলন করলেন সেটাই এক বিস্ময়। তাও শুধু একবার নয়। কেউ কেউ বলছিলেন যে, আগের দুটো বার্ষিক সম্মেলনও সমানেই সফল হয়েছিল।
বিদেশে ভালো আয়-উপার্জন এবং উন্নত জীবন সত্ত্বেও পেছনে ফেলে আসা মাতৃভূমির সমস্যাগুলোর সমাধান করে বাংলাদেশটাকে সুদিনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে তাদের চিন্তাভাবনার কতখানি জুড়ে আছে, সম্মেলনের সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচনে সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সেমিনার ও টক-শোগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু’, ‘আউট সোর্সিং : বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের উন্নয়ন পরিকল্পনা’, ‘পানি আগ্রাসন : ভাটি অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ে কতটা হুমকি’; ‘করপোরেট আমেরিকায় ভাগ্য গড়–ন : মেধার আর অপচয় নয়’; ‘দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা : স্বাধীন না পরাধীন’; ‘বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোথায়?’ এবং ‘বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন বাংলা ভাষার জন্য কতটুকু হুমকি?’; ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তৃতীয় শক্তির উত্থান জরুরি কি না’; ‘বাংলাদেশে কোন তন্ত্র বিদ্যমানÑ গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র না পরিবারতন্ত্র?’ ইত্যাদি।
সেমিনার এবং টক-শোগুলোর বিষয় নির্বাচন থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যা-সঙ্কটগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের চিন্তাভাবনার অনেকখানি জুড়ে আছে। এসব আলোচনায় অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখেছেন প্রবাসী ও আমন্ত্রিত চিন্তাবিদরা। প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান খান, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. খলিলুর রহমান. ড. আলী রিয়াজ প্রমুখ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান অধ্যাপকরা। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কলামিস্ট ফরহাদ মজহার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর চৌধুরী, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রধান সহকারী সম্পাদক সঞ্জীব চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক। লন্ডন থেকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান, বিবিসি বাংলা বিভাগের বর্তমান প্রধান সাবির মোস্তাফা ও আমি (সিরাজুর রহমান)।
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আসবেন বলে বিশেষ প্রচার চালানো হয়েছিল। অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হবে মনে করে আমিও প্রীত ছিলাম। তিনি আসবেন বলে সম্মতি দিলেও মাত্র দুই দিন আগে কোনো অজ্ঞাত কারণে আসবেন না বলে জানিয়ে দেন। মহাসম্মেলনে কানাঘুষা শুনলাম, আমাদের কারো কারো উপস্থিতির প্রতিবাদে উত্তর আমেরিকার আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা এ সম্মেলন বর্জন করেছিলেন। বুড়ি-ছুঁই গোছের মতো করে নিউ ইয়র্ক আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন এবং একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। আলোচনা ইত্যাদিতে আওয়ামী লীগপন্থী আর যাদের অংশগ্রহণের কথা ছিল, তারা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। অবশ্য তাই বলে সম্মেলনের অঙ্গহানি হয়নি। দুই দিনে দীর্ঘ অধিবেশনের প্রায় সময়ই বিশাল সম্মেলনকেন্দ্রে প্রচুর জনসমাগম দেখেছি। 

শূদ্রদের দেববাক্য শোনা নিষিদ্ধ
আপনারা কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানি না, আওয়ামী লীগের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সমর্থকদের ভিন্ন মতবাদ শোনা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার ধর্মগ্রন্থগুলো সীমিত রেখেছিল। সেসব গ্রন্থের বক্তব্য, এমনকি সংস্কৃত ভাষা শোনাও অব্রাহ্মণ্যদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বিধান দিয়েছিলেন, কোনো অব্রাহ্মণ দেব-ভাষা সংস্কৃত শুনে ফেললে তার কানে গলিত সীসা ঢেলে দিতে হবে। বোধ করি ব্রাহ্মণরা ভেবেছিলেন, অব্রাহ্মণরা সংস্কৃত শিখে ফেললে তাদের বহু জারিজুরি ধরা পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নেতারাও নিশ্চয়ই মনে করেন, ভিন্ন মতামতের ছোঁয়াচ লাগলে তাদের সমর্থকরা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগ সমর্থক মিডিয়া ভিন্ন মতবাদের কাউকে তাদের ধারে-কাছেও ভিড়তে দেয় না। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ রীতি নিন্দনীয় হবে।
এতক্ষণ যা বলছিলাম তার থেকে মনে হতে পারে যে, নিরস-নিকষ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নিউ ইয়র্কের এবিসি মহাসম্মেলন। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। উভয় দিনের অনুষ্ঠানই শেষ হয়েছে নৃত্য ও সঙ্গীতের দীর্ঘ আসর দিয়ে। তা ছাড়া কয়েকটা আলোচনা অনুষ্ঠানের পরপরই আরো ছোট আকারে গান-বাজনা ও সঙ্গীত দিয়ে দর্শকদের বিনোদন করা হয়। বাংলাদেশের শিল্পী শবনম মুশতারী ও বেবী নাজনীনরা উত্তর আমেরিকা নিবাসী শিল্পীদের সাথে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন। উদ্যোক্তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুষ্ঠানগুলোকে সবিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলেন। ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি শহীদ কাদরী, কলকাতা থেকে আগত আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা মনোজ্ঞ আবৃত্তি দিয়ে সকলকে সম্মোহিত করেন। প্রবাসীদের লিখিত গ্রন্থের একটা প্রদর্শনীও ছিল মহাসম্মেলনে।
বিভিন্ন সামাজিক বিষয় এবং ক্রীড়া সম্বন্ধেও একাধিক আলোচনা বৈঠক হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক বদহজমের ভয়ে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। উদ্যোক্তাদের একটা মহতী আয়োজন ছিল উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন পেশায় অসাধারণ প্রতিভা ও কৃতিত্বের অধিকারী বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান। কয়েকজনকে ক্রেস্ট দিতে পেরে আমি সম্মানীত বোধ করেছি।
মহাসম্মেলনের অলিখিত এবং অনুচ্চারিত বিরাট লাভজনক দিক ছিল পুরনো ও নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতা ও মতামত বিনিময়। আমি নিজেও ইকবাল বাহার চৌধুরী, কাফি খান, দিলারা হাসেম, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, সরকার কবীরুদ্দিন প্রমুখ সহবেতারকর্মী বন্ধুদের সাথে দীর্ঘকাল পরে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে প্রীত হয়েছিলাম। রাষ্ট্রদূত রফিক আহমেদ খান ও তার স্ত্রীর সাথেও দেখা হলো বহু বছর পরে। সত্তরের দশকের বিবিসি শ্রোতাসঙ্ঘের কর্মকর্তা আকবর হায়দার কিরণের সাক্ষাৎ পেলাম মহাসম্মেলনে। নিউ ইয়র্কের ‘ব্রিক লেন’ জ্যাকসন হাইটস দেখালেন তিনি, বাঁশপাতারি ইলিশ ও বেলে মাছ সহযোগে ডাল-ভাত খাওয়ালেন।
সবশেষে ঠিকানা পরিবারের সদস্যদের কথা বলতেই হয়। এর পরিবারের প্রধান সাইদুর রবের নেতৃত্বে ফজলুর রহমান, দেওয়ান শামসুল আরেফিন, মঞ্জুর হোসেন, মিজানুর রহমান প্রমুখরা যেমন কঠোর পরিশ্রম ও গঠনমূলক কল্পনাশক্তি দিয়ে এমন মনোজ্ঞ মহাসম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন, সেটা শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কোনো সন্দেহ নেই, তাদের ভবিষ্যৎ আয়োজনগুলোও সমানেই সার্থক হবে। 
লন্ডন, ০৩.০৭.১২
serajurrahman34@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

কত আসন নেবেন প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে ফেলেছেন

কত আসন নেবেন প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে ফেলেছেন


॥ সিরাজুর রহমান ॥

অমৃতে এত তাড়াতাড়ি কেন অরুচি হলো, কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভাবছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির জন্য হাসিনা এত হরতাল করলেন, রক্ত ঝরালেন, সে পদ্ধতি ঠেকানোর জন্য কেন তিনি দেশের সর্বনাশ করছেন? জবাবটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে জড়িত।
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নব্বই সালের ডিসেম্বরে লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান হন কর্মরত প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তাকে এ পদ দেয়ার ব্যাপারে বড় দুটো দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সম্মতি ছিল। যেভাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার দায়িত্ব (সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ) পালন করেছিলেন দেশে-বিদেশে তার প্রচুর সুখ্যাতি হয়েছিল।
সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পুরো সময়জুড়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য অকান্ত আন্দোলন করেছেন। অন্য প্রধান দলের নেত্রী হাসিনা ওয়াজেদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণে তিনি অখুশি নন। তখন আওয়ামী লীগের সরকারি মুখপত্র ছিল বাংলার বাণী পত্রিকা। সে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাফল্য কামনা করে মুনাজাত করা হয়েছিল। 
সে ৯ বছরের বেশির ভাগ সময়জুড়ে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ এরশাদের পক্ষেই ছিলেন। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ সংসদ নির্বাচন ডাকেন। সে নির্বাচন যে কেমন হবে সে সম্বন্ধে কারো সংশয় ছিল না। ১৯ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও অন্য ছোট দলগুলো এক যৌথ বৈঠকে ৬ মে তারিখের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু যৌথ বৈঠকের সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে দিয়ে ২১ তারিখে হাসিনা ঘোষণা করেন যে ৬ মে তারিখের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে। 
ভোটারবিহীন সে নির্বাচনে এরশাদ হাসিনাকে হাইকোর্ট দেখিয়েছিলেন। তার শেকড়বিহীন জাতীয় পার্টিকে সংসদে ২৪০ আসন দিয়ে আওয়ামী লীগকে দিয়েছিলেন মাত্র ৬০টি আসন। স্বভাবতই হাসিনা খুশি হতে পারেননি। তিনি ঘোষণা করেন যে আওয়ামী লীগ সংসদে যাবে না। এরশাদ বেকায়দায় পড়েছিলেন। একদলীয় সংসদকে দেশে কিংবা বিদেশে কেউ স্বীকৃতি দেবে না। সামরিক স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করলেন তিনি। হাসিনাকে নিয়ে তিন ঘণ্টার মোটর ভ্রমণে গেলেন তিনি। তারপরই হাসিনা সংসদের বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
৯ বছরের সংগ্রামে খালেদা জিয়াকে যে কত নির্যাতন আর ভীতিপ্রদর্শন সহ্য করতে হয়েছে সেটা রীতিমতো এক ইতিহাস হবে। শেষ অবধি ছাত্র-জনতা খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করে গণতন্ত্রের আন্দোলনে শরিক হতে হাসিনাকে বাধ্য করে। সারা এশিয়াব্যাপী বিবিসির লাইভ কনসার্টের বাংলাদেশ অংশ পরিচালনার জন্য আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আন্দোলন গতি পেতে তখন আর দেরি হয়নি। সামরিক আইন ও কার্ফ্যু জারি করে এবং সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামিয়ে এরশাদ শেষ রক্ষার চেষ্টা করেন। জনসাধারণকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে তিনি টেলিভাষণে ঘোষণা দেন যে তিনি শিগগিরই নির্বাচন দেবেন এবং নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পদত্যাগ করবেন। 
অনেকেই তখন ভয় করছিলেন যে হাসিনা এরশাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবেন। হাসিনা দাবি করেছিলেন যে এরশাদের সরকার তার টেলিফোন কেটে দিয়েছে (পরে শুনেছিলাম যে সেটা সত্যি ছিল না)। আমি লন্ডনে টেলিফোন করে বিবিসিকে বলেছিলাম যে এরশাদের ভাষণ সম্বন্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য আমার সহকর্মীরা যেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোন করেন। তারা উভয়েই সরাসরি এরশাদের প্রস্তাব বাতিল করে দেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সামরিক আইন ও কার্ফ্যু ভঙ্গ করে জনতা সড়কে বেরিয়ে পড়ে, ‘মানি না, মানি না’ বলে তারা স্লোগান দিচ্ছিল। এর পরে এরশাদের পতন মাত্র কিছু ঘণ্টার ব্যাপার ছিল। 
অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৯১) সাধারণ নির্বাচন ডাকেন। সে নির্বাচনের মতো জনতার ঢল বাংলাদেশের আর কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। নির্বাচনের খবর দিতে আমি আবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকা ও মফঃস্বলের সাতটি নির্বাচন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম আমি। সর্বত্রই দীর্ঘ সারিবদ্ধ ভোটদাতারা আমাকে বলেছিলেন যে তারা খালেদা জিয়াকে ভোট দিতে এসেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনের নির্যাতনের সময় তারা খালেদা জিয়াকেই দেখেছে, তার আগুনঝরা কণ্ঠের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শুনেছে। তিনি কোন দলের সে প্রশ্ন তখন ওঠেনি। তার বিরাট বিজয় সুনিশ্চিত ছিল।
জনতার সন্দেহাতীত রায় সত্ত্বেও হাসিনা ওয়াজেদ পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ১০ বছর আগে ভারত থেকে তিনি এই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন যে বাংলাদেশ তার পৈতৃক সম্পত্তি; যত অন্যায়ই তিনি করেন না কেন তার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ জনতা তাকেই ভোট দেবেন। বাংলাদেশের মানুষের ‘অকৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে’ হাসিনা ক্ষমা করতে পারেননি। তিনি রাজনীতিকে সংসদ থেকে পথে টেনে নামিয়েছিলেন, দফায় দফায় ও লাগাতার মিলে মোট ১৭৩ দিন হরতাল ডেকেছিলেন। বস্তুত লাগাতার হরতাল কথাটা চালুই করেছিলেন হাসিনা। আন্দোলন করে তিনি খালেদা জিয়ার সরকারকে উপড়ে ফেলতে পারেননি। অগত্যা অন্য পথ ধরলেন তিনি।

তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ও দুষ্ট ইতিহাস
জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করার আন্দোলন শুরু করলেন শেখ হাসিনা। সে আন্দোলনে বহু হরতাল হয়েছে, সহিংসতাও ঘটেছে অনেক। বেশ কয়েকটি মৃত্যুও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে। ২০ মে তারিখে জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটা সামরিক অভ্যুত্থানেরও ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার সরকার রাজনীতিতে শান্ত পরিবেশ সৃষ্টির আশায় সংসদের সংক্ষিপ্ত অধিবেশন ডেকে সংসদের ১৩ নম্বর সংশোধনী পাস করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু হয়।
আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ী হলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। শেষে জাতীয় পার্টির সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ব্যাপকভাবে জানা আছে যে জুন মাসের সে নির্বাচনের আগে আগে হাসিনা ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য জামায়াতের তৎকালীন নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্যি সরকার গঠনের পর মনোনীত মহিলা সদস্যদের নিয়ে আওয়ামী লীগ গরিষ্ঠতা অর্জন করে। তখন থেকে তারা আবার পুরনো স্বভাব অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে গালিগালাজ শুরু করে। 
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হয় ২০০১ সালে। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে জয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়েছিল। নির্বাচনী এলাকায় যারা ভোট পরিচালনা, গণনা করবেন এবং প্রিসাইডিং অফিসার হবেন সেসব পদে আওয়ামী লীগের সমর্থক আমলাদের নিযুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে যারা পরিচিত ছিলেন না তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয়। হাসিনার কোনো সন্দেহ ছিল না যে সাজানো নির্বাচনে তিনি বিপুল জয়লাভ করবেন।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসারে সদ্য-সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত সচিব পদমর্যাদার মাত্র ১২ জন আমলাকে বদলি করেন। তাতেই আওয়ামী লীগ মহলে ‘গেল, গেল’ রব শুরু হয়। নির্বাচনে বিএনপি বিপুল গরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে। তখন থেকে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ওপর হাসিনার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। এখন তিনি সাহাবুদ্দিন ও লতিফুর রহমান উভয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং আরো নানান গালিগালাজ শুরু করেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রমাণ পেলেন যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি তার বিজয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

যেভাবে তারা ক্ষমতা পেতে চায়
মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। সেদিন বিকেল থেকেই হাসিনা ওয়াজেদের ‘লগি-লাঠি-বৈঠার’ লাগাতার হরতাল শুরু হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর রাজপথে লগি-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এক ডজনেরও বেশি লোককে হত্যা করা হয়। সড়ক, নৌপথ ও বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করা হয়, রেলওয়ের লোহার রেলগুলো সরিয়ে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে গৃহবন্দী করে বঙ্গভবনের পাসি, টেলিফোন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়া হয়। 
এভাবে আওয়ামী লীগ ফখরুদ্দীন আহমদকে শিখণ্ডি করে জেনারেল মইন ইউ আহমদের অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় আসার পথ করে দেয়। পরের বছরের ১৫ এপ্রিল বিশ্বভ্রমণে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে তিনি সে কথা স্বীকার করেছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন যে সে সরকার তার ‘আন্দোলনের ফসল’ এবং ক্ষমতা পেলে সে সরকারের সব কার্যকলাপ তিনি বৈধ করে দেবেন। অবৈধভাবে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে সে সরকার ‘ভারতের বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শ’ এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় একটা মাস্টারপ্ল্যান করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে হাসিনাকে বিরাট বিজয় দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সম্বন্ধে হাসিনা ওয়াজেদের অরুচির এই হচ্ছে ইতিহাস।
ক্ষমতা পেয়ে হাসিনা আমলাতন্ত্র ও পুলিশে আমূল পরিবর্তন আনেন। দূরবীণ দিয়ে দেখলেও আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া অন্য কাউকে যাতে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো দায়িত্বের জন্য পাওয়া না যায় এভাবে তিনি সেটা নিশ্চিত করলেন। তারপরে সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক বিধিতেই হাত দিলেন তিনি। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার জন্য উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীটি বাতিল ঘোষণা করেন; কিন্তু বলেন যে দেশ ও জাতির স্বার্থে আরো কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে করা প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতির রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশের আগেই বিরোধী দল বর্জিত সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে। সরকার ঘোষণা করে যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। 
সেটা যে আরেকটি সাজানো নির্বাচনে হাসিনা ওয়াজেদের ‘বিরাট জয়ের’ প্রস্তুতি ছিল সেটা কাউকে বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মাত্র গত সোমবার বলেছেন যে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৭৫টির নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত। অর্থাৎ তিনি আগামী নির্বাচনে নিজ দলকে ১৭৫টি আসন দেয়ার জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করতে চাইছেন। প্রধানমন্ত্রীর নীলনকশা অনুযায়ী বাকি আসনগুলো কি বিএনপি, ১৮ দলীয় জোট এবং সে জোটের সমর্থক বিকল্প ধারাকে দেয়া হবে বলে ভাবছেন কেউ? অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল এরশাদের সাথে ১৯৮২ সাল থেকে হাসিনার একটা রাজনৈতিক নাড়ির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, পরস্পরের ওপর তাদের প্রভাব রহস্যময়। এরশাদকে পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দলের নেতা করা হবে বলে হাসিনা নিজেই বলেছেন। সুতরাং বিএনপি এবং অন্য বিরোধী দলগুলোকে দু-চারটির বেশি আসন দেয়া হাসিনার নীল নকশার অন্তর্ভুক্ত নয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন অপরিহার্য
এবং ঠিক সে কারণেই বিএনপি ও অন্য সব গণতন্ত্রকামী দল তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নেমেছে। হানিফসহ আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এবং তাদের কোনো কোনো কলম সন্ত্রাসী অন্ধকারে শিষ দিয়ে সাহস সঞ্চারের চেষ্টার মতো করে বলছেন যে খালেদা জিয়া আন্দোলন করতে জানেন না, তিনি আন্দোলনের ‘গ্রামার’ (ব্যাকরণ) শেখেননি।
প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। খালেদা যে আন্দোলনের গ্রামার শেখেননি সে কথা দেশের মানুষকে কেউ বলে দেয়নি। তিনি যেখানেই গেছেন হাজারে হাজারে এবং লাখো লাখো মানুষ তার কথা শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন। তিনি সভা-সমাবেশ কিংবা হরতাল ডাকলে আওয়ামী লীগের হৃৎকম্পন শুরু হয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ দিয়ে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা কোনো কাজেই লাগছে না তাদের। তারা বিএনপি ও সম্মিলিত জোটের মিছিলের ওপর ক্যাডার ও গুণ্ডাদের লেলিয়ে দিচ্ছে। তারা সহিংসতা ও নাশকতা চালাচ্ছে এবং সরকার সেসব অভিযোগে গ্রেফতার করছে তাদের নয়, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের। হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করলেও নানা টালবাহানায় সরকার তাদের মুক্তি দিচ্ছে না। ওই দিকে দেশের প্রত্যন্ত থেকে প্রত্যন্ত পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূলপর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নানা সাজানো অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলে পুরে রাখা হচ্ছে।
খালেদা জিয়াকে সভা-সমাবেশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা তারা শুরু করেছে সাড়ে তিন বছর আগে থেকেই। পল্টন ময়দান ও মুক্তাঙ্গন প্রভৃতি ঐতিহ্যিক সভা-সমাবেশের স্থানগুলো বিএনপির জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছে সরকার। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাড়া রাজধানীর আর কোথাও বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাতেও নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। প্রায়ই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাঁটাতারের বেড়া ও পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। সমাবেশে বিএনপি কয়টা মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে পারবে এবং সমাবেশ কোন সীমানার মধ্যে সীমিত রাখতে হবে সেটাও স্থির করে দিচ্ছে সরকার। 
এখন আরো একটা নতুন কৌশল নিয়েছে সরকার। দেশের জেলাগুলো থেকে মানুষ রাজধানীতে আসে মোটরলঞ্চ, দূরপাল্লার বাস ও ব্যক্তিগত মোটরগাড়িতে। এসবই সরকার বন্ধ করে দিচ্ছে। রেলের যাত্রীদের তল্লাশি করে দেখা হচ্ছে কেউ খালেদা জিয়ার সমাবেশে যেতে চায় কি না। রাজধানীতেও বাস ও গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকছে। অর্থাৎ বিএনপি সভা ডাকছে আর সরকার অঘোষিত হরতাল করে দেশ অচল করে দিচ্ছে। তাতে কি সরকারের কৌশল কোনো কাজে লাগছে? মোটেই না। খালেদা জিয়ার ১৩ মে আর ১১ জুনের সমাবেশ সে প্রমাণই দিয়েছে। বহু লাখ মানুষ এসেছিল এ দু’টি সমাবেশে। মফঃস্বল থেকে মানুষ আসতে না পারলেও রাজধানীর অধিবাসীরা সমাবেশে এসেছে লাখে লাখে। সভা-সমাবেশে যাওয়া যাদের ধাতে নেই সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে তারাও এসেছেন। 

দেশবাসী কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না 
সরকারের অসদুদ্দেশ্য বুঝে নিতে কারোর অসুবিধা হচ্ছে না। তারা চায় বিরোধী দলকে সরকারের সমালোচনা করতে দেয়া হবে না, বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের এবং হাজারে হাজারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের আটক রেখে তারা নিজেদের নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন করবে এবং ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। সে ষড়যন্ত্র সফল হবে কি? আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের মানুষকে বহু, বহু প্রকারে প্রতারিত করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের এবং হাসিনা ওয়াজেদের কোনো প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি। বিদ্যুতের ও খাবার পানির অভাব বহু গুণে বেড়ে গেছে। 
এবারে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। তাপমাত্রা প্রায় সর্বত্র রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই প্রচণ্ড গরমে পাখা চালানোর কিংবা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বাতি জ্বালানোর বিদ্যুৎ নেই। রান্না করার জন্য নেই গ্যাস। তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বিশুদ্ধ পানি নেই। আওয়ামী লীগের লোকেদের রাতারাতি বড় লোক করার জন্য মজুদদারীকে উৎসাহ করা হয়েছে। তাতে চাল-ডাল থেকে শুরু করে সব অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। মধ্যবিত্তের জীবন এখন দুঃসহ। সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়ে ৩৩ লাখ লোক শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিলেন। তাদের সে টাকা আওয়ামী লীগের কুমিরেরা খেয়েছে। এখন সে টাকা হালাল করার জন্য বাজেটে বিধান করা হয়েছে। 
বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি সম্ভবত সারা বিশ্বের রেকর্ডই ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান সরকারকে চোর বলে রায় দিয়েছে। টেন্ডারবাণিজ্য নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গদলগুলোর মধ্যেই সহিংসতা চলছে। মাত্র গত মঙ্গলবার সড়ক ভবনে শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাতে পাঁচজন আহত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার পরিস্থিতি যে জঘন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বহুবার তার নিন্দা করেছে। র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যার নিন্দা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। র‌্যাব এখন মানুষ গুম করতে শুরু করেছে। দুই বছর আগে ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। তারপর থেকে শ’ দুয়েক মানুষ গুম হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই নদীতে কিংবা জলাভূমিতে লাশ কিংবা কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। দেশের মানুষ যে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে জয়ী করবে না এসব হচ্ছে তার কিছু কারণ।
সে জন্যই খালেদা জিয়ার সভা-সমাবেশে রেকর্ডসংখ্যক লোকের সমাগম হয়। বিএনপি নেত্রী তার আন্দোলনে সংযম দেখাতে গিয়ে অনেক সমালোচনা সয়েছেন। আওয়ামী লীগ রক্তারক্তি করার প্রস্তুতি নিয়েছিল ১২ মে তারিখের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে। খালেদা জিয়া সে কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে দিয়ে তার শান্তি-কামনার প্রমাণ দিয়েছেন। গত রোববারের মহাসমাবেশেও তিনি উগ্র কোনো কর্মসূচি এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন ঈদুল ফিতর পর্যন্ত তিনি কোনো কঠোর কর্মসূচি দেবেন না। 
তার এই সংযত আচরণকেই আওয়ামী লীগ ও তাদের কলম সন্ত্রাসীরা দুর্বলতা এবং ব্যাকরণজ্ঞানের অভাব বলে বিদ্রƒপ করছে। তাতে তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থান কিংবা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের ভয়ে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের শেষ রফা হবে না। তিউনিসিয়ার বেন আলী, মিসরের হোসনি মোবারক ও ইয়েমেনের সালেহ প্রমাণ পেয়ে গেছেন একবিংশ শতকে মানুষ স্বৈরতন্ত্রকে বরদাশত করতে রাজি নয়। গণতন্ত্রের ঢলের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছেন। এর থেকে তারও পরিত্রাণের আশা নেই। হাসিনা ওয়াজেদ এবং আওয়ামী লীগ বাকশালী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। হানিফসহ কোনো কোনো নেতা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন সে কথা। বাংলাদেশের মাটি নরম কিন্তু অতি নিষ্ঠুর। এ দেশের মানুষও দেখতে নরম হলেও তাদের রক্তে আগুন আছে। হাসিনার পিতার স্বৈরতন্ত্র তারা সহ্য করেনি। তার স্বৈরতন্ত্রের চক্রান্তও তারা সহ্য করবে না। 
লন্ডন, ১৩ জুন ২০১২
serajurrahman34@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

আবেগের সমঝোতা চুক্তি দেশের জন্য মারাত্মক

আবেগের সমঝোতা চুক্তি দেশের জন্য মারাত্মক


॥ সিরাজুর রহমান ॥

এখন বিশ্বায়নের যুগ চলছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিনিয়োগ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রহীতা দেশগুলো বিদেশী বিনিয়োগ চায় বিভিন্ন কারণে। বহু ক্ষেত্রে বিশেষ প্রযুক্তি, দক্ষতা কিংবা আর্থিক সামর্থ্য এদের থাকে না। তা ছাড়া এরা আশা করে বিদেশী বিনিয়োগ পেলে তাদের দেশে কর্মসংস্থানে সহায়তা হবে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
বিনিয়োগ সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যাপার। এখানে আবেগের প্রশ্নই আসে না। ভারতের বড় ব্যবসায়ী কোম্পানি সাহারা গ্রুপের মালিক সুব্রত রায় সাহারা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি পাঁচটি উপশহর নির্মাণের লক্ষ্যে সরকারের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে গেছেন। সুব্রত রায় বলেছেন, তার কয়েক প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল বিক্রমপুরে। সে সুবাদেই বাংলাদেশে এই উপশহরগুলো নির্মাণে তার এত আগ্রহ।
ব্যবসায় কিংবা শ্রমশিল্পের সাথে আবেগ সংযুক্ত হলে তার মধ্যে বহু বিপদ প্রচ্ছন্ন থাকতে বাধ্য। উপশহরগুলোর পরিকল্পনা আগে বাংলাদেশে প্রকাশ করা হয়নি, নির্মাতাদের কোনো তালিকাভুক্তি কিংবা টেন্ডার ডাকা হয়নি। সে অবস্থাতেই সুব্রত রায় এলেন এবং তার কোম্পানিকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেয়া হবে বলে আশ্বাস নিয়ে ফিরে গেলেন। অর্থাৎ আবেগের কথাটা আগেভাগে প্রচার করে সুব্রত রায় বহু লোকের, বিশেষ করে সরকারের ভেতরের বহু লোকের সমর্থন-সহানুভূতি সৃষ্টি করে তার অপসুযোগ নিয়েছেন।
বাংলাদেশে বহু শিল্প এখনো গড়ে ওঠেনি অথবা বিকশিত হয়নি। নির্মাণ শিল্প সেগুলোর মধ্যে পড়ে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। রাজধানীতে বহু সুরম্য অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, রাজধানী বহু গুণে সম্প্রসারিত হয়েছে, উপশহরও কতগুলো তৈরি হয়েছে। তেমনি বহু অট্টালিকা তৈরি হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ আরো বহু শহর-নগরে। এসব কাজই সম্পন্ন করেছেন বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো, বাংলাদেশী প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ-উপকরণ নির্মাণ কিংবা সরবরাহ করেছেন বাংলাদেশীরা। তাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে। 
ভারতের বিবর্তনমুখী অর্থনৈতিক দর্শনের একটা মূল কথা গঠন কিংবা নির্মাণের কাজ যেখানেই হোক যথাসম্ভব ভারতীয় যন্ত্রপাতি, প্রকৌশলী ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে হবে। একটা দৃষ্টান্ত দেখা গেছে গত বছর। অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকায় এসে সরকারের সাথে বহুমুখী চুক্তি করে গিয়েছিলেন। চুক্তিতে কথা ছিল ভারতকে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী ও চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহারের অধিকার দেয়া হচ্ছে। সেসব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চড়া সুদে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে ভারত, তবে উন্নয়নের সব কাজই করবেন ভারতীয় ঠিকাদারেরা ভারতের প্রকৌশলী, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ শ্রমশক্তি ব্যবহার করে।
সে চুক্তির বহু সমালোচনা হয়েছে বাংলাদেশের সব মহল থেকে। প্রধান কারণ, ভারতকে করিডোর ও ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে যেমন শুধু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়াই সার হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ হয়নি, তেমনি অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ থেকেও বাংলাদেশ সামান্যই উপকৃত হবে। আমাদের ভৌগোলিক সম্পদ ব্যবহার করে ভারত লাভবান হবে অথচ আমরা উপকৃত হবো নাÑ এমন আত্মঘাতী চিন্তা একমাত্র বর্তমান সরকারের মাথায় আসতে পারে। 
জানা গেছে, সুব্রত রায়ের কোম্পানি সাহারাও ভারত থেকে যন্ত্রপাতি, উপকরণ, প্রকৌশলী ও দক্ষ শ্রমিক আমদানি করে উপশহরগুলো তৈরি করবে। খুব কমসংখ্যক বাংলাদেশী অদক্ষ শ্রমিকই তারা ব্যবহার করবে। এই শত শত, হয়তো হাজার হাজার ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু বাংলাদেশে তারা আয়করও দেবে না। শুধু তা-ই নয়, উপশহরগুলো তৈরি হলে সেগুলো ক্রয় করার জন্য বাংলাদেশীদের ঋণ নিতে হবে। শোনা গেছে, সে ঋণও দেবে ভারতীয় ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ভারত গাছেরটা খাবে, তলারটাও কুড়োবে এবং তারপর সে বাবদ বখশিশও আদায় করে নেবে।

বিলাস
বিচিত্র নয় যে অর্থনীতিবিদ, চিন্তানায়ক ও নির্মাণশিল্পে সংশ্লিষ্ট সব মহল থেকে সুব্রত রায়ের সাথে এই সমঝোতা চুক্তির বিরুদ্ধে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়েছে। সব তথ্য প্রকাশ হলে ব্যাংক ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই খুব ক্রুদ্ধ হবেন। সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি গ্রুপকে জ্বালানি খাতে বিনা টেন্ডারে কন্ট্রাক্ট দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। যত দূর জানা যায়, সে সম্বন্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলেন বলেই টেলিভিশন সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি ও সাগর সরোয়ারকে হত্যা করা হয়েছিল। সে হত্যার সুরাহা করার ব্যাপারে সরকারের অনীহা থেকে সাধারণ মানুষেরও বিশ্বাস জন্মেছে যে, দুর্নীতি ঢাকার লক্ষ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনো মহল সে দু’টি অমূল্য প্রাণ বিনাশের জন্য দায়ী। সাহারা গ্রুপের সাথে সমঝোতা চুক্তিও করা হয়েছে একই রকম সন্দেহজনক এবং অস্বচ্ছভাবে। 
সবাই জানেন বাংলাদেশের সাড়ে ছয় শ’ স্থাপনায় শেখ পরিবারের কোনো-না-কোনো সদস্যের নাম খোদিত হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি দেশ। জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের বিবরণ অনুযায়ী প্রতি বছর দুই লাখ একর করে জমি স্থায়ীভাবে কৃষির বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন দিন দৃশ্যমান ভবিষ্যতেই আসতে পারে যখন এ দেশে দাঁড়ানোর স্থানও থাকবে না। সেসব মানুষকে খাদ্য দিতে হবে। সৌভাগ্যবশত দেশটি পলিসমৃদ্ধ খুবই উর্বর এবং চাষবাসের উপযোগী সমতল। আমাদের কৃষক কঠোর পরিশ্রমী এবং নিবেদিতপ্রাণ। উদায়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তারা কোনোমতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু মাথাভারী প্রকল্প কার্যকর করতে যে হাজার হাজার একর আবাদি জমি স্থায়ীভাবে চাষের বাইরে চলে যাবে সে কথা একবারও ক্ষমতাসীনদের কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা এলাকার লাখ লাখ অধিবাসীর ক্রোধের সঞ্চার করেছিলেন। দিনের পর দিন আন্দোলন করে এবং সে আন্দোলনে প্রাণ দিয়ে আড়িয়াল বিলের অধিবাসীরা সরকারকে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। বিকল্প যে স্থানগুলোর কথা তখন শোনা গিয়েছিল, সেখানের মানুষও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, আড়িয়াল বিলের মতো আন্দোলন করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছিল। দেখা যাচ্ছে যে, সেসব সত্ত্বেও সরকারের মোহ ভঙ্গ হয়নি।

ঋণ পরিশোধ করবে নতুন প্রজন্মগুলো
পদ্মা সেতু তৈরি হয়নি কিন্তু তার মধ্যেই এত দুর্নীতি হয়েছে যে বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেই সেতুর জন্য অর্থ জোগান দিতে অস্বীকার করেছে। তারা সবাই প্রকারান্তরে বর্তমান সরকারকে চোর বলে রায় দিয়েছে, দুর্নীতিবাজদের যথোচিত শাস্তির দাবি করেছে। কিন্তু তেমন উদ্দেশ্য সরকারের আছে বলে কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশের মানুষ মনে করে সেসব দুর্নীতি সরকারের উঁচু স্তরে ঘটেছে বলেই দায়ী ব্যক্তিদের সাজা দিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে সস্তা ঋণ ফিরে পেতে সরকার চেষ্টা করছে না। তার পরিবর্তে তারা বহু গুণ বেশি সুদে বিকল্প অর্থায়ন সংগ্রহ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সরকার বেশি দিন গদিতে থাকবে না, কিন্তু সে উচ্চ সুদের হারের ঋণ বাংলাদেশের মানুষকে চক্রবৃদ্ধি হারে পরিশোধ করতে হবে যুগ যুগ ধরে। প্রধানমন্ত্রীর অবাস্তব স্বপ্নের জন্য বংশানুক্রমে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং হয়তো নতুন রাজধানী নির্মাণেও যে দুর্নীতির ‘বঙ্গোপসাগর চুরি’ ঘটবে সে সম্বন্ধে কারো কোনো সন্দেহ নেই। 
ব্রিটেনে দুটো অবকাঠামো প্রকল্প বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিথরো সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর। পাঁচটি টার্মিনাল এবং দু’টি রানওয়ে এখন যথেষ্ট নয়। গ্যাটউইক, স্ট্যানস্টেড ও লুটন এবং সর্বশেষ সাউথে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো উপচে পড়া যাত্রী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বিগত লেবার দলীয় সরকার হিথরোতে একটি এবং গ্যাটউইক কিংবা স্ট্যানস্টেডে আরো একটি রানওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। বস্তুত হিথরোর রানওয়েটির জন্য জমি অধিগ্রহণও করা হয়েছিল। কিন্তু মূল্যবান কৃষিজমি এবং পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। 
দুই বছর আগের সাধারণ নির্বাচনে টোরি পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হিথরোর তৃতীয় রানওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা তারা বাতিল করবে। সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে টোরিরা এখন একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। হিথরো রানওয়ের বিকল্প সন্ধানে তারা জটিল সমস্যায় পড়েছে। টোরিরা ঘোষণা করেছে, তারা লন্ডন আর বার্মিংহামের মধ্যে দুই শতাধিক মাইল গতিবেগের হাইস্পিড রেল চালু করবে। এতে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি আবাদের বাইরে চলে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিত্ত ও প্রভাবশালী ভূস্বামীরা বিরোধিতা ঘোষণা করেছেন। সরকারের সমস্যা এই যে, ভূস্বামীরা সাধারণত টোরি দলের সমর্থক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যরা সবাই টোরি দলের। এই হাইস্পিড রেল এখন শিকেয় ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঢাকার বর্তমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির ‘ক্যাপাসিটির’ (যাত্রী চলাচল ক্ষমতা) ৪০ শতাংশেরও কম এখন ব্যবহার হচ্ছে। দৃশ্যমান ভবিষ্যতে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাহিদা বাংলাদেশে হবে না। আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশের কোনো এলাকার মানুষই তাদের চাষের জমিতে বিমানবন্দর তৈরি করতে দেবে না। এখন আবার সাহারা গ্রুপকে পাঁচটি উপশহর তৈরি করতে দিচ্ছে সরকার। কোথায় তৈরি হবে সেসব উপশহর? কোন ভাগ্যহীন কৃষক ভূসম্পত্তি হারিয়ে পথে বসবেন? 

অসাধু উদ্দেশ্যের দুর্গন্ধ
সরকারের আয়োজনের পেছনে অসাধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। সুব্রত রায় সাহারার মতো পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বেশির ভাগই দাবি করেন, তাদের পূর্বপুরুষেরা ঢাকার বিক্রমপুর কিংবা বরিশালের জমিদার ছিলেন। কলকাতায় সামাজিক বৈঠকে এমন দাবি আমিও অজস্রবার শুনেছি। আমাদের এক বন্ধুর মা একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা, মরার আগে ভাগ্যকুলে আমার মামার বাড়িটি কি একবার দেখতে পাবো?’ বৃদ্ধা কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। ভাগ্যকুল দেখা তার ভাগ্যে জোটেনি।
অনুপস্থিত জমিদারেরা কলকাতায় বসে ব্যবসায়-বাণিজ্য কিংবা রাজনীতি করতেন। বিধানসভা নির্বাচনে তারা পূর্ববাংলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় তাদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের অথবা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের মুসলমানদের সম্পত্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের সম্পত্তি তাদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। দেশভাগের সময়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর খুনখারাবির মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাবকবালা বা অন্য কোনো বৈধ দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের নূরুল আমিন সরকার ১৯৫০ সালে আইন করে জমিদারি প্রথা বাতিল করে।
এখন আবার পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভারতের হিন্দুদের বাংলাদেশে ছেড়ে আসা সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্য জরুরিভাবে আবেদন করতে বলেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। তাদের খুশি করার কোনো চেষ্টারই ত্রুটি রাখছে না বর্তমান সরকার। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জ্ঞাত চোর-ডাকাত কিংবা খুনি হলেও হিন্দুরা তাদেরই ভোট দেবে, কেননা তারা জানে যে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাদের স্বার্থের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হবে, বিশেষ সুবিধা পাবে তারা।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে কয়েক লাখ ভারতীয় হিন্দু বাংলাদেশে এসেছে, বৈধ কিংবা অবৈধভাবে তারা বাংলাদেশে চাকরি কিংবা ব্যবসায়ও করছে। অনুমান করা হয়েছে, একমাত্র বৃহত্তর ঢাকা ও শিল্পাঞ্চলেই তিন লাখের বেশি ভারতীয় নাগরিক আছে। অনেকেই সন্দেহ করেন তাদের কেউ কেউ পূর্বপুরুষদের সম্পত্তির ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লা পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। সরকার আশা করছে, ভারতের হিন্দুরা চার-পাঁচ কিংবা সাতপুরুষ আগের সম্পত্তি দখল করতে পারলে তারা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকের কলেবরও বৃদ্ধি পাবে।
সৎ বিশ্বাসে যারা সাতচল্লিশে হিন্দুদের সাথে সম্পত্তি বিনিময় করেছিল তারা এখন মহাবিপদে পড়তে পারে। পঁয়ষট্টি বছর ধরে ভোগ করা সম্পত্তি হিন্দুদের ফিরিয়ে দিতে হয়তো তাদের বাধ্য করা হবে। অথচ ভারতে ফেলে আসা সম্পত্তি তারা ফিরে পাবে না, কেননা তাতে বর্তমান সরকারের আগ্রহ নেই। সরকারের এই উদ্যোগটি সাধারণভাবেই দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করবে এবং তাতে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেবে। সে উদ্যোগ সরকারেরই গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধবে। 
লন্ডন, ০৫.০৬.১২ 
serajurrahman34@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

জেল-জুলুম দিয়ে গণআন্দোলন দমন করা যায় না



সিরাজুর রহমান
দেশটাকে ঠেলতে ঠেলতে আওয়ামী লীগ সরকার একেবারে অতল গহ্বরের ধারে নিয়ে এসেছে। মাত্র দুটো ব্যাপারই ঘটতে পারে এখন : দেশ যদি অতলে তলিয়ে যায়, শ্মশান-নৃত্যের মতো করে আওয়ামী লীগওয়ালারা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার চালাবে। আর দেশ যদি টিকে থাকে, তলিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশকে এখন এই দুই সম্ভাবনার মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে।
ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছিল পঁচাত্তরে। সংসদে মাত্র তিন মিনিটের আলোচনার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন। সবগুলো রাজনৈতিক দলকে তিনি নিষিদ্ধ করেন, এমনকি আওয়ামী লীগকেও। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন চারখানি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্র-পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। প্রস্তুতি হিসেবে আগের বছরেই জরুরি ক্ষমতা আইনের বলে অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এসবেরও পটভূমি ছিল রক্ষী বাহিনীর হাতে ৪০ হাজার খুন, সর্বস্তরে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যেও অবাধ দুর্নীতি, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু।
একই পটভূমি এখন বাংলাদেশেও চলছে। মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের মধ্যে কেউ যদি দাবি করেন যে, তিনি দুর্নীতি করছেন না তাহলে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত কর্ণবিদারী অট্টহাসি শুরু হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সরকার সবাই এখন বেপরোয়া দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তাগিদ দিচ্ছে। র্যাব এখন রক্ষীবাহিনী হয়ে গেছে। তারা হাসিনার ক্যাডার আর আওয়ামী লীগের ঘাতকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। খুনের সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম করা। সাংবাদিকদের হত্যা, চ্যানেল-ওয়ান বন্ধ, একুশে টেলিভিশন, ইসলামী চ্যানেল প্রভৃতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার মিডিয়া জগতে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে ৯ মাস জেল খাটানো হয়েছে। শুনেছি এখনও ৫৩টি সাজানো মামলা ঝুলে আছে তার বিরুদ্ধে, প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। সরকার ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদকে নিউইয়র্ক দূতাবাসে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে আর বাংলাদেশে একজন বিচারপতি গায়ে পড়ে তার বই ‘দেয়াল’ প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এখন আর কোনো নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নেই। অর্থনৈতিক সঙ্কট, বেসামাল দ্রব্যমূল্য এবং বিদ্যুত্ ও পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত।
পঁচাত্তরের মতোই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশে। এ সরকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, বরং ঐতিহাসিক ভুলগুলোর অন্ধ অনুকরণের পথই তারা বেছে নিয়েছে। হত্যা-নির্যাতন, মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ এবং জেল-জুলুমের পথ ধরেছে সরকার। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব করে তোলার বহু আয়োজন তারা এরই মধ্যে করেছে। দেশের মানুষ ভয় করছে আরও একবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন শেখ পরিবারের এক সদস্য। সে জন্যই তারা গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য, র্যাবের হাতে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে মুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছে। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সাজানো অভিযোগ আর সাজানো মামলায় গ্রেফতার হওয়া বিএনপি ও ১৮ দলের নেতাদের বিনাশর্তে মুক্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা প্রত্যাহার করার দাবি।

মিথ্যা অভিযোগ সাজানো মামলা
বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, পূর্ববর্তী এক হরতালে তারা সচিবালয়ে পাঁচটি ককটেল বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন অথবা করিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে সড়কে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছিলেন কিংবা লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬ মে তারা জামিনের জন্য নিম্ন আদালতে সশরীরে হাজির হলে জামিন না দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
অনেকগুলো প্রশ্ন গিজগিজ করছে এখানে। নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অজুহাত সৃষ্টির জন্য উস্কানিদানের কৌশল ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। বহু দেশ কালে কালে যুগে যুগে সে কৌশল ব্যবহার করেছে—এমনকি ভারত শাসনের সময় ব্রিটিশরাও। সে কৌশল যে আওয়ামী লীগ জানে না সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। যেভাবে সচিবালয়ে ককটেল ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ের রাজপথে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা দুটোকে ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে সন্দেহ প্রবল হয় যে, সম্মিলিত বিরোধী ১৮ দলের গণতন্ত্রের আন্দোলন দলনের লক্ষ্যে ঘটনা দুটো শাসক দলের ভেতর থেকেই সাজানো হয়েছিল।
আন্দোলন উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠলে এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চরমে উঠলে কর্মীরা সময় সময় শৃঙ্খলা হারিয়ে ফেলতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু অঘটন ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেসব ঘটনায় প্রায় কখনোই শীর্ষ নেতাদের সম্মতি থাকে না। গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় জনসাধারণের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে। রাজনীতি করে যাঁরা শীর্ষ স্তরে উন্নীত হন তারা অবশ্যই জানেন, উচ্ছৃঙ্খল এবং বিশৃঙ্খল আচরণ জনসাধারণ পছন্দ করে না। কিছুকাল ধরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবং পরে ১৮ দলের ঐক্যজোট হরতাল প্রভৃতি কর্মসূচি দিতে ইতস্ত করেছে এবং তাতে করে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়েছে; খালেদা জিয়া প্রমুখ নেতারা বারংবার বলেছেন, হরতাল দিয়ে সর্বসাধারণের অসুবিধার কারণ ঘটাতে তারা চান না, কিন্তু স্বৈরতন্ত্র-লিপ্সু নির্যাতক সরকার তাদের জন্য উপায়ান্তর রাখেনি।
১৮টি বিভিন্ন দলের ৩৩ জন শীর্ষ নেতা নিজেরা সচিবালয়ে বোমা ফাটিয়েছেন এবং প্রায় একই সময়ে তিন-চার মাইল দূরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে একখানি গাড়িতে আগুন লাগিয়েছেন, অথবা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে কর্মীদের ডেকে এসব ঘটনা ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন, উন্মাদ না হলে এমন দাবি কেউ করতে পারে না।
‘চোরেরও ধর্ম থাকে’, ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ ইত্যাদি বহু প্রবচন সকলেরই জানা আছে। রাজনীতি একটা সম্মানজনক পেশা। অন্তত তেমনই হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা রাজনীতি করেন। বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি অন্তত পেশাগত সৌজন্য দেখানো তাদের কর্তব্য ছিল। কারাবন্দি নেতাদের প্রতি যে ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, যেভাবে তাদের ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে একই কারাগারে নেয়া হয়েছে তা থেকে ধরে নিতেই হবে, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এ সরকারের সবাই উন্মাদ হয়ে গেছেন। তাদের ভরাডুবি যে অনিবার্য সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের আচরণগুলো এখন লাঠিপেটা খাওয়া সাপের মরণ-কামড় বলেই মনে হয়।
লোভনীয় সম্ভাবনা
কোনো দলের সাধারণ কর্মী কিংবা সমর্থকের কোনো দুষ্কর্মের জন্য যদি দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির সৃষ্টি করা হয়, তাহলে অত্যন্ত লোভনীয় একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী পাঁচ বছর এবং বর্তমানের প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তার ক্যাডার, দলীয় কর্মী এবং দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাব যে হাজার হাজার হত্যা, ধর্ষণ, ভূমিগ্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার সন্ত্রাস, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি দুষ্কর্ম করেছে সে জন্য শেখ হাসিনাকে ‘হুকুমের আসামি’ করে কোনো সময় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মামলা রুজু করা স্বাভাবিক হবে। সরকারের সদস্যদের মনে রাখতে হবে যে, দিন কারও সমানে যায় না। দিন পাল্টালে তারা যে ধরনের ব্যবহার আশা করবেন ঠিক সেভাবেই বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি তাদের আচরণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বহুবার বলেছেন যে, ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি গদিতে থাকতে চান। তার মন্ত্রিরাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সে আভাসই দিয়েছেন। মুক্ত নির্বাচন অসম্ভব করে দিয়ে তিনি ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের স্বৈরশাসকদের এবং বাংলাদেশে তার পিতার মতো স্বৈরশাসক হতে চান। কিন্তু একটা কথা তিনি ভুলে যাচ্ছেন। তিনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এটা বিংশ নয় একবিংশ শতাব্দী এবং বাংলাদেশের মানুষ ল্যাটিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যবাসী নয়।
তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের লক্ষ্যে। হাসিনার পিতার স্বৈরাচার তারা সহ্য করেনি। প্রকৃত হত্যা যদিও জনকয়েক সৈনিক করেছে কিন্তু শেখ মুজিবের পতনের পেছনে বাংলাদেশের মানুষের অন্তত মৌন সম্মতি ছিল। হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার পিতার হত্যায় বাংলাদেশের মানুষ চোখের পানি ফেলেনি এবং সে জন্য বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। হাসিনার স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার বাসনা এ দেশের মানুষ মেনে নেবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে তিনি এ কারণ-সে কারণ দেখিয়ে, বিচারের দোহাই দিয়ে এবং না দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জেলে পুরেছেন। ভারত ও মার্কিনিদের মনোরঞ্জনের আশায় ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’দের ধরপাকড় চালিয়ে গেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশজোড়া তার স্বৈরতন্ত্রী বাসনার বিরোধীদের রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। প্রধান বিরোধী বিএনপি দলের উচিত ছিল তখন থেকেই এই পাইকারী ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। অপেক্ষাকৃত ছোট গণতান্ত্রিক দলগুলোরও উচিত ছিল বিএনপির ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সেটা তারা করেনি। সে জন্যই ফ্যাসিস্ট সরকার এখন তাদের সবার বিরুদ্ধে হাত বাড়াতে সাহস পাচ্ছে। গত ১৬ মে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ এং ১৮ জোটেরও কিছু কিছু নেতাকে জেলে পাঠিয়ে সে প্রমাণই দিয়েছে সরকার।
বিএনপি কোন পথে?
বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট কী করবে এখন? বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে একটা মহল এতদিন ‘সাংবিধানিক আন্দোলনের’ কথা বলে এই নির্যাতক স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। আমি নিজেও কয়েকটি কলামে বিরোধী দলকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম—এ সরকারকে যতই সময় দেয়া হবে ততই তারা বিরোধী দলের আন্দোলন আর গণতন্ত্রের পথকে অসম্ভব করে তুলবে। সরকার কি বিএনপিকে গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেনি? তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব, ক্যাডার ও গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে রক্তারক্তি ঘটায়নি সরকার? প্রাণহানি করেনি? বিএনপির প্রধান কার্যালয় কি ফ্যাসিস্ট কায়দায় কাঁটাতার আর পুলিশ দিয়ে ঘেরাও করে রাখেনি?
তাছাড়া কোন সংবিধান অনুযায়ী আন্দোলন করবেন তারা? যে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা দলীয়কৃত পুলিশ, আমলা ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় আরও একটি সাজানো নির্বাচন করে বাকশালী স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে চায়? যে সংবিধান অনুযায়ী তারা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করতে চায়?
বিএনপি এবং ১৮ দলের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল কিন্তু শাসক দলের ভেতরের উস্কানিদাতাদের দিয়ে সচিবালয়ে ককটেল ফাটিয়ে এবং তেজগাঁও এয়ারপোর্ট রোডে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের অজুহাত সৃষ্টি করা হয়েছিল। একইভাবে যদি আন্দোলন-বিমুখদের ধরপাকড় শুরু হয় তাহলে তাদের হয়ে প্রতিবাদ করতে কারা এগিয়ে আসবে? আমার আগাগোড়া বিশ্বাস ছিল এই পিছুটান দেয়া ব্যক্তিরা পরোক্ষে হাসিনার বাকশালী পরিকল্পনাতেই মদদ দিচ্ছেন। লোকে সন্দেহ করছে তাদের কারও কারও মধ্যে বিদেশী প্রভাব সক্রিয় থাকতে পারে।
১৬ মে জেলে পাঠানো ৩৩ জন ছাড়াও রিজভী আহমেদ, খায়রুল কবির খোকনসহ আরও কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত ক’দিনে। ঢাকার মিডিয়ায় খবর ছাপা না হলেও জেলা পর্যায়ে বহু নেতাকর্মীকে ধরপাকড় চলছে। অচিহ্নিত গাড়িতে সাদা পোশাক পরিহিত লোকেরা এখন দেশব্যাপী ধরপাকড় চালাচ্ছে। এখন আর সন্দেহ নেই যে, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে বিরোধী দল ও জোটকে নেতৃত্বশূন্য এবং কর্মীবিহীন করে গণতন্ত্রের আন্দোলন নস্যাত্ করে দেয়া। আরও দুটো মতলব আছে তাদের। তারা আশা করছে, তাদের ইচ্ছা পূরণের আদালত বিরোধী দলের বহু নেতাকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের প্রার্থী হওয়ার পথ বন্ধ করে দেবে। নেতারা জেলে পচতে থাকলে নির্বাচন দিয়ে তারা জয়ী হতে পারবে বলে আওয়ামী লীগ আশা করে।
‘কারার ওই লৌহ কপাট’
নেতাদের জেলে নেয়া হয়েছে সেটা এমন কিছু হতাশ হওয়ার ব্যাপার নয়। গান্ধী-নেহরুরা জেলে গিয়েই ইংরেজদের তাড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশেও বহু অন্যায় জনসাধারণ আন্দোলন করে ঠেকিয়েছে। আন্দোলন করে তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, বলতে গেলে দেশকে স্বাধীনও করেছে। এসব আন্দোলনে অজস্র মানুষ গ্রেফতার হয়েছিলেন, জেল খেটেছিলেন। শেখ হাসিনার পিতা আগরতলায় গিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। পাকিস্তানিরা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছিল। তাকে জেলে পোরা হলে দেশের মানুষ আন্দোলন করে তাকে মুক্ত করেছিল। এবারে আটক নেতাদের কেউ কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেননি। তারা শুধু জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকারই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তারা সবাই দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রকামী। দেশে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। কথা হচ্ছে বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের নেতারা আন্দোলন করে তাদের বন্দি নেতাদের মুক্ত করতে এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে পারবেন কি-না।
অথচ দেশের মানুষ প্রস্তুত আছে। নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনেকগুলো জেলাতেই কর্মীরা গত ১৭ মে হরতাল ডেকেছিলেন। তারপরই শুধু ঢাকা থেকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান হরতালের ডাক দেন। তা সত্ত্বেও সেদিনের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল খুবই সফল হয়েছিল। অর্থাত্ কর্মীদের মধ্যে ইচ্ছা ও উদ্দীপনার অভাব নেই। জনসাধারণ অতীতে বহুবার দেশের ডাকে বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, একাত্তরে দেশ স্বাধীন করতে তিন লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের মধ্যে পিছুটানওয়ালাদের উত্পাত।
‘কুইক-কুইক-স্লো’ মনোভাব নিয়ে কোনো আন্দোলনই সফল হতে পারে না। ২০০৬ সালে ‘কুইক মার্চ! হল্ট!’ মার্কা আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ১/১১ সৃষ্টি করেনি। তারা লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ চালানো অসম্ভব করে দিয়েছিল। আন্দোলন সফল করতে হলে বিএনপি এবং ১৮ দলের জোটের নেতাদের সে পথই ধরতে হবে। প্রথম কাতারের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সারির নেতারা তো আছেনই। তারা গ্রেফতার হলে তৃতীয় কাতারের নেতারা এগিয়ে আসবেন। কিন্তু এ অভিযাত্রা তাদের সফল করতেই হবে। তারা সবাই জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ব্যর্থ হলে জাতি কখনও তাদের ক্ষমা করবে না। (লন্ডন : ২০.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com

গোয়েবলসের পদাঙ্ক অনুসরণ

গোয়েবলসের পদাঙ্ক অনুসরণ


॥ সিরাজুর রহমান ॥

অ্যাডলফ হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাভারিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে করপোরাল পর্যন্ত হয়েছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে তাকে নবগঠিত জঙ্গি রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পাঠানো হয়। কিন্তু হিটলার নিজেই সে দলে যোগ দেন। হারম্যান গোয়েরিং, রুডলফ হেস, জোসেফ গোয়েবলস প্রমুখের ছোট একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি প্রথমে জার্মানির ক্ষমতা এবং ক্রমে ক্রমে বাকি ইউরোপ দখলের পরিকল্পনা করতে থাকেন। 
ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি সংসদীয় রাজনীতিতে ঢুকে হিটলার কিছুকালের মধ্যেই সে দলের নেতৃত্ব দখল করেন। সে দল রাইখস্টাগে (সংসদ) কিছু আসনও পেয়েছিল কিন্তু হিটলারের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। কিশোর-যুবক ও ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলে তিনি জার্মান আধিপত্য, বিশুদ্ধ আর্য জার্মান রক্ত ইত্যাদি মন্ত্র তাদের মাথায় ঢোকাতে থাকেন। হিটলার তাদের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন যে ইহুদি, কমিউনিস্ট, ট্রেড ইউনিয়নপন্থীরা জার্মান জাতিকে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, আর একশ্রেণীর লেখক ও বুদ্ধিজীবী তাদের হাতিয়ার হয়ে কাজ করছে। যুব-কিশোর সংগঠনগুলোকে তিনি এসব শ্রেণীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। 
হিটলারের ভীতিকর উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতালিপ্সাকে বাগ মানাতে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ ১৯৩২ সালে তাকে চ্যান্সেলর (প্রধানমন্ত্রী) নিয়োগ করেন। কিন্তু হিটলার হিন্ডেনবার্গের মতলব বুঝে ফেলেছিলেন। তার সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো ১৯৩৩ সালে রাইখস্টাগ পুড়িয়ে দেয়। হিটলার অগ্নিকাণ্ডের সব দোষ চাপিয়ে দেন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। কমিউনিস্ট, ইহুদি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ওপর হামলা শুরু হয়। হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের লিখিত বই, সাময়িকী ইত্যাদি পোড়ানোর কাজ শুরু হয়। জার্মানিতে নাৎসিবাদ এসেছিল এভাবে। 
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন নাৎসিদের প্রচারবিদ। তিনি মনে করতেন বারবার একই কথা প্রচার করা হলে সে কথা শ্রোতার মস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে যায়, মিথ্যাকেও সাধারণ মানুষ সত্য বলে বিশ্বাস করতে শেখে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাকে এবং তার ছোট বোন রেহানাকে রেখেছিল বিশেষ তত্ত্বাবধানে। ভারতীয় নাগরিকদের সাথে তাদের সামাজিক দেখা-সাক্ষাতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ধারণা করা যেতে পারে, সর্বক্ষণ তাদের ভারতের স্বার্থের দিকগুলোই বোঝানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের যেসব রাজনীতিককে ভারত তার স্বার্থের অনুকূল বিবেচনা করে না তাদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের দুই কন্যার মন বিষিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় ছয় বছর ধরে। কিন্তু আর কী করতেন শেখ হাসিনা? এমনও কি হতে পারে যে, নাৎসিদের ক্ষমতাপ্রাপ্তি ও ক্ষমতা স্থায়ী করার কলাকৌশল সম্বন্ধেই পড়ছিলেন অথবা সে বিষয়ে কারো পরামর্শ শুনছিলেন তিনি।
গত প্রায় ২৯ মাসে শেখ হাসিনার উক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার দেখা যাবে, তিনি প্রকৃতই গোয়েবলসের প্রচার-দর্শনে বিশ্বাস করেন। দু-একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে থাকেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়, তার রাজনৈতিক বিরোধীরা ক্ষমতা পেলে তারা চুরি করে। প্রথমেই দেখা যাক দেশের মানুষকে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাসিনা ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নেমেছিলেন এবং গত ২৯ মাসে দেশের মানুষ কী পেয়েছে।
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়া, দ্রব্যমূল্য সামলে রাখা, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়া, দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলা, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব মিডিয়ায় প্রকাশ করা ইত্যাদি। এই প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে কোনটি রক্ষা করা হয়েছে বলে আপনি এবং আপনারা বিশ্বাস করেন?

বিদ্যুতের সয়লাব দেখছেন প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে এ বছর অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে বলে পত্রিকায় পড়েছি। এত বেশি উষ্ণতা আমি জীবনে মাত্র একবার দেখেছি মিসরে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা আর আরিজোনার মরুভূমিতে তাপমাত্রা এ রকম কিংবা তার চেয়েও কিছু উঁচুতে ওঠে বলে শুনেছি। নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের মানুষ এমন অস্বাভাবিক গরমে অভ্যস্ত নয়, সে জন্য প্রস্তুতও নয় তারা। এই তীব্র গরমে পাখা চালাতে পারলে জীবন একটু সহনীয় হয়ে উঠতে পারত, রাতে তারা একটু ঘুমোতে পারত। বিদ্যুৎ নেই, বাতি জ্বলে না, পাখা চলে না। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আর মশার কামড়ে এপাশ-ওপাশ করে রাত কেটে যায়। সবাই স্বীকার করবেন দিবারাত্রির মধ্যে কিছুটা সময় গভীর নিদ্রায় বিশ্রাম নিতে না পারলে শারীরিক কিংবা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না, এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে মানুষের আয়ু হ্রাস হয়।
ত্রিপুরা রাজ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোর জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যন্ত্রপাতি নেয়া হয়েছে। সে জন্য তিতাস নদীতে এবং তার শাখা-প্রশাখা ও খালে বাঁধ দিয়ে পানির স্রোত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে তাতে। আরো শুনেছিলাম যে, সে বিদ্যুৎ কারখানার জন্য বাংলাদেশের গ্যাস ভারতকে দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। অনেক বড় বড় কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা। বিনা টেন্ডারে ভাড়া করা যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ডার দেয়া হয়েছিল বহু হাজার কোটি টাকার।
তার কোনো সুফল বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পায়নি। বিদ্যুতের অভাব আর রেকর্ড মাত্রার গরমে দেশের মানুষের প্রাণ হাঁসফাঁস করছে, তারা ঘুমাতে পারছে না। তারা স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে বিক্ষোভ করছে, সড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে তাদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ থাকবে বলে আশা করা যায় না। কিন্তু ওই যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনা টেন্ডারে ব্যয় করা হয়েছে তার কী হলো? শোনা যাচ্ছে, এ বাবদ ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটা ব্যবসায়ী গ্রুপ। এ গ্রুপগুলোর মালিক আওয়ামী লীগের নেতারা, কোনো কোনোটির মালিক আবার প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় বলে শোনা গেছে। প্রধানমন্ত্রী গোয়েবলসীয় প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন। তার ধারণা বিদ্যুৎ দিয়ে তিনি দেশকে সয়লাব করে দিয়েছেন।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা অল্পবিস্তর সবাই জানেন। এই সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির দু’টি ঘটনার বিবরণ বিশ্বব্যাংক সরকারকে দিয়েছিল। ব্যাংক বলেছে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া না হলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করবে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রমুখ দাতা দেশ ও সংস্থা বিশ্বব্যাংকের মতোই বলেছে যে, দুর্নীতির সাজা না হলে তারাও অর্থ জোগান দেবে না। বিশ্বব্যাংক গত সপ্তাহে আরো সাতটি দুর্নীতি সম্বন্ধে সরকারকে তদন্ত করতে বলেছে।

তারা বাড়িতে এসে চোর বলে যাচ্ছেন
এসব অভিযোগই হয়েছে পূর্ববর্তী যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের আমলের ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে। তার বিরুদ্ধে দেশেও অজস্র অভিযোগ ছিল। এমনকি দেশের বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনও করেছিলেন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তাকে এমন একটি দফতরে বদলি করা হয়েছে যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ আরো বেশি বলে শুনেছি। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞ মহলগুলো সন্দেহ করেন সৈয়দ আবুল হোসেন শুধু নিজের জন্য নয়, আরো ওপরের কারো কারো এজেন্ট হিসেবে দুর্নীতি করছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিতে সরকারের অনিচ্ছাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্বব্যাংক এবং স্বাভাবিক সাহায্যদাতারা পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থসাহায্য দেবে না। দেশে ও বিদেশে সরকারের অপরিসীম দুর্নাম ছড়াচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রীসহ বিদেশীরা বাংলাদেশে এসেও দুর্নীতি সামাল দিতে সরকারকে তম্বি করছেন। 
এ সরকারের বহু ত্রুটির মতো আরেকটা বদগুণ হচ্ছে তাদের ফাঁকা দম্ভ। তারা বলছে বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়েই পদ্মা সেতু তৈরি করবে। এখানে-সেখানে তারা সেতুর জন্য ঋণপ্রাপ্তির তদবির চালাচ্ছে। শোনা গেছে, একমাত্র মালয়েশিয়া থেকে একটা প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু তারা সুদ চাইছে বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হারে। সে সুদ শোধ করতে হবে দেশের মানুষকে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই বলে দিয়েছেন চড়া হারে সুদ নেয়ার কোনো চুক্তি হলে বিএনপি সে চুক্তি অনুমোদন করবে না। অর্থাৎ ক্ষমতায় এলে (যেটা এখন অপরিহার্য মনে হচ্ছে) বিএনপি সরকার সে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে না। এমতাবস্থায় কোনো দেশ বা ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেবে বলে মনে হয় না।
আকাশচুম্বী দুর্নীতির অভিযোগ চাপা দেয়ার মতলবে শেখ হাসিনা আবার গোয়েবলসের শরণাপন্ন হয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তিনি জাগিয়ে তুলেছেন, বলেছেন যে বিরোধী দলের নেতার দুর্নীতির বিচার না হলে আর কোনো (দুর্নীতির) বিচার হবে না। হবে কী করে? গদি পেয়েই হাসিনার সরকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮৬টি দুর্নীতি-দুষ্কৃতির মামলা তুলে নিয়েছে। 
এগুলোর মধ্যে ১৫টি মামলা ছিল স্বয়ং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে। একটা মামলা ছিল ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশের ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী মিগ-২৯ জঙ্গিবিমান ক্রয়সংক্রান্ত। সেই মিগ-২৯ বিমানগুলোর কী হয়েছিল কেউ কি জানেন? আরেকটা মামলা ছিল অস্বাভাবিক চড়া দামে কোরিয়া থেকে বিনা টেন্ডারে কোনো রকম অস্ত্রশস্ত্রবিহীন ফ্রিগেট যুদ্ধজাহাজ ক্রয়সংক্রান্ত। আগেই বলেছি, হাসিনার বর্তমান সরকার প্রথম সুযোগেই সেসব মামলা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দোষ এবং সাফসুতরো ঘোষণা করে দিয়েছে। 

খুনি নিজেই তার বিচার করবে 
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরো ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। নিজেদের দুর্নীতির অপরাধ নিজেরা ধুয়েমুছে ফেলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তুলনা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আরেকটা দৃষ্টান্তই দেখুন। রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হাতেনাতে ধরা পড়ল। অন্তত সাধারণ বুদ্ধির মানুষ সেটাই মনে করে। সেই গুরুতর অভিযোগ তদন্তের জন্য সুরঞ্জিত নিজে মন্ত্রীর গদিতে বসে তার অনুগত ও অধীনস্থ দু’জন রেল কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। এমন তদন্ত পৃথিবীর কোনো দেশে কেউ গ্রহণযোগ্য মনে করবে বলে আমার মনে হয় না। 
তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল বলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ২০ ঘণ্টার মধ্যেই (শোনা যায় ভারতের নির্দেশে) শেখ হাসিনা আবার তাকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনেন। তারই নিয়োজিত এবং তার অনুগত ব্যক্তিদের তদন্ত কমিটি এখন বলেছে যে গভীর রাতে সুরঞ্জিতের সহকারী একান্তসচিব ও অন্য দু’জন রেল কর্মকর্তা যে ৭০ লাখ (অথবা চার কোটি ৭০ লাখ) টাকা নিয়ে রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন তার সাথে সুরঞ্জিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ সরকার আর বেশিদিন গদিতে থাকলে খুনি নিজের অপরাধ নিয়ে তদন্ত করবে এবং নিজেকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করবে। দুর্নীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং সুরঞ্জিত দোষী কি না প্রমাণ দিতে পারতেন গাড়ির চালক আজম খান। কিন্তু সে ঘটনার পর থেকেই তাকে গুম করে ফেলা হয়েছে। গোয়েবলসের অনুকরণেই ভিন্নমতাবলম্বী চিন্তাধারার টুঁটি টিপে মারা হচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল বইটি প্রকাশের আগেই সেন্সরশিপের কবলে পড়েছে। সরকারের অনুগত না হলে টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দেশের বহু জেলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে শাসকদলের গুণ্ডারা। দুর্নীতির অভিযোগ ফাঁস করার চেষ্টা করতে গিয়ে টেলিসাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর সাগর সরোয়ার খুন হয়েছেন।
হাসিনা নতুন স্লোগান ধরেছেন গোয়েবলসের অনুকরণেই। তিনি দাবি করছেন ‘বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে অনুকরণীয়’। তার সরকার এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যে বাংলাদেশ আছে সেটা অবশ্যই অনুকরণীয়। বহু বহু সৌকর্য ও সদগুণ আছে বাংলাদেশের মানুষের। কিন্তু যেহেতু মাথা দিয়ে মানুষ চেনা যায় সেহেতু শাসকদের পরিচয় দিয়ে কোনো দেশের বিচার হয় বিশ্বসমাজে। বিশ্বের নেতারা আমাদের দেশে এসেও এ দেশের সরকারকে চোর আর দুর্নীতিবাজ বলে যাচ্ছেন, সেটাকে কেউ অনুকরণযোগ্য মনে করবে না। 
অসংলগ্ন, পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা থাকলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অবশ্যই যোগ্য দাবিদার হতেন। তিনি বলে চলেছেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে দুর্নীতি হয়নি এবং শিগগিরই সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তদন্ত করার জন্য তিনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যাংক ব্যবসায়ীর অধীনে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন, বলেছিলেন যে তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তদন্তের প্রতিবেদনে নাম ধরে অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়েছিল। আবুল মাল আবদুল মুহিত লুটেরাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেননি, কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়নি। 

পুকুরচুরি আর সমুদ্রচুরি
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আবার মুখ খুলেছেন। নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্রণা সয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সুশাসনের অভাবের জন্য দুর্নীতি আর আইনের শাসনের অপব্যবহার দায়ী।’ মুহিত সেখানেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো বলেছেন, ‘পুলিশ ও বিচার বিভাগ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত।’ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু বর্তমানে পুলিশ বাহিনী যে আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসেবে কাজ করছে সেটা সবাই জানে, তারা আরো জানে যে এ দেশে এখন ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচার আশা করা যায় না। এখন সেসব সমর্থন করলেন অর্থমন্ত্রী, সব উন্নত দেশেই যে পদটিকে প্রধানমন্ত্রীর পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
শেখ হাসিনা এখন কী করবেন? তিনি কি মুহিতকে বরখাস্ত করবেন? আমার মনে হয় না। হাসিনা কি সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন? সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কি মন্ত্রিসভায় ফেরত নিতে বাধ্য হননি? হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয় প্রধানমন্ত্রীদেরও করতে হয়।
হলফ করে এ কথা বলব না যে, খালেদা জিয়ার পূর্ববর্তী তিনটি সরকারের আমলে দুর্নীতি হয়নি। আমার মনে হয় খালেদা জিয়া নিজেও সে দাবি করবেন না। আধুনিক কালে কোনো দেশই জোর গলায় নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত বলে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু দুর্নীতিরও সীমা এবং প্রকারভেদ থাকে। কেউ গাছটার যতœ নেয়, ফল পাকলে পেড়ে খায়; অন্যদের অত ধৈর্য সয় না। ফল পাকলে গাছটাকে কেটে তারা ফল নিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগকে অবশ্যই শেষোক্ত দলে ফেলতে হবে। খালেদা জিয়ার আমলে দুর্নীতিকে যদি পুকুরচুরি বলা যায় শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতিকে অবশ্যই বঙ্গোপসাগর-চুরি বলতেই হবে। তাদের ধৈর্য ও সংযম বলে কিছু নেই। তারা সব কিছুই যথাসত্বর লুটেপুটে খেতে চায়। ১৯৭২-৭৫ সালে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলোর কথা একটু আগেই বলেছিলাম। আর বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি আবারো যে দেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে সে কথা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই স্বীকার করলেন।
খালেদা জিয়া ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে হাসিনা যে অনবরত দুর্নীতির অভিযোগ করে যাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং গোয়েবলসীয় দর্শন দ্বারা পরিচালিত। সচিবালয়ে বোমা ফাটানো এবং তেজগাঁওয়ে একখানি গাড়ি পোড়ানোর মামলায় বিএনপির মহাসচিবসহ ৩৩ জনকে কাশিমপুর সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জেলে কয়েদ রাখা যে আশায় করা হয়েছে খালেদা ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগও একই আশায় করা হচ্ছে। সেটা এই যে অভিযোগ প্রমাণ হোক না হোক তার কাদা কিছু পরিমাণে এই নেতাদের গায়ে লেগে থাকবে এবং হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তার থেকে কিছু ফায়দা উঠাতে পারবে। 
লন্ডন, ২২.০৫.১২
serajurrahman34@gmail.com

বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

বিকৃত মানসিকতা সরকারকে অমানুষিক করে তুলেছে



সিরাজুর রহমান
আগেও বহুবার বলেছি এসব কথা—একাধিক বইতে এবং বহু প্রবন্ধ ও কলামে। নতুন পাঠকদের অবগতির জন্য পুনরাবৃত্তি পুরনো শ্রোতাদের বিরক্তি ঘটাবে না আশা করি।
বিবিসি থেকে ১৯৬৯ সালে ‘পাকিস্তানের রাজনীতি’ শীর্ষক একপ্রস্থ সাক্ষাত্কার প্রচার করেছিলাম। তত্কালীন পাকিস্তানের উভয় দিকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিকের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম সেজন্য। সেপ্টেম্বরের এক সকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিতে তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যাই। মুজিব ভাই ভোরে ভোরে যেতে বলেছিলেন। ভাবী আমাদের নাশতা খাওয়ালেন। সাক্ষাত্কার ছাড়াও পুরনো পরিচয়ের জের ধরে অনেক কথা হয়েছিল।
তখন জোর জল্পনা-কল্পনা চলছিল যে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। সে বছরের জুন মাসে মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। বস্তুত গণআন্দোলনের তোড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার জুন মাসে তাঁকে কারামুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। আমি তাঁর নজিরবিহীন জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করি। তিনি বললেন, দেশে লোকে আমাকে চেনে, জানি; কিন্তু বিদেশে তো কেউ আমাকে চেনে না। আমি বললাম, আপনি লন্ডনে আসুন, বিশ্বমিডিয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবো।
সে বছরের নভেম্বর মাসে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন এবং আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলাম। ব্রিটিশ ও বিদেশি মিলে ৪১ সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমি। বিবিসিতে বাংলায় আমি তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাত্কার প্রচার করি। ভাষ্যকার এভান চার্লটনের সঙ্গে তাঁর ইংরেজি সাক্ষাত্কার বিবিসির আরও কয়টি বিদেশি অনুষ্ঠান বিভাগ অনুবাদ করে প্রচার করেছিল।
ভারতে প্রায় ছয় বছর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হলেন। কিছুদিন পরেই তিনি লন্ডনে আসেন। আমি ঠিক করেছিলাম তাঁকেও মিডিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো। বিবিসি বুশ হাউসের বার্তা বিভাগে তাঁর জন্য আমি একটা চা-চক্রের আয়োজন করি। আশা ছিল বিবিসির সব বিভাগের কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে একান্তে তাঁর আলোচনার সুযোগ হবে। কিন্তু হাসিনা এলেন এক পাল চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে। একান্ত আলাপের সুযোগ রইল না। অগত্যা সহকর্মী জন রেনার আর আমি তাঁকে স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলাম বাংলা ও ইংরেজিতে সাক্ষাত্কারের জন্য।
ইংরেজি সাক্ষাত্কারে জন গোড়াতেই হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে তাঁর ভালো লাগছে কিনা। তিনি বললেন, মোটেই না, রাজনীতি তাঁর ভালো লাগে না, রাজনীতিকে তিনি ঘৃণা করেন। জন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন আপনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হতে গেলেন। আরও বিস্ময় অবশিষ্ট ছিল আমাদের জন্য। হাসিনা বললেন, ওরা তাঁর বাবাকে হত্যা করেছে, মাকে হত্যা করেছে, ভাইদের হত্যা করেছে, তাঁদের জন্য বাংলাদেশে কেউ চোখের পানি ফেলেনি, প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন।
ইশারায় জনের অনুমতি নিয়ে আমি স্টুডিয়ো ম্যানেজারকে বললাম, রেকর্ডিং থামিতে দিতে। নেত্রীকে বুঝিয়ে বললাম, তাঁর এসব কথা বিবিসি থেকে প্রচারিত হলে রাজনীতিতে তাঁর ক্ষতি হবে। আমার কথা যেন তাঁর বিশ্বাস হলো না। তখন আমি বললাম, বাংলাদেশের সব মানুষেরই তো বাবা-মা খুন হয়নি, তারা কেন প্রতিশোধ নিতে ভোট দিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করবে। যা হোক, সে অংশটা বাদ দিয়ে আবার শেখ হাসিনার সাক্ষাত্কারের রেকর্ডিং শুরু হলো।
হাসিনার প্রতিশোধ
তার পর থেকে বহুবার আমার মনে হয়েছে, হাসিনার সে উক্তিগুলো কথার কথা ছিল না, সত্য সত্যই তাঁর রাজনীতিতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ-বাসনা। তিনি বাংলাদেশের মানুষের ওপর, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপরই প্রতিশোধ নিতে চান এবং সে স্পৃহা তিনি এখনও ভুলতে পারেননি। বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন আছেন। তার আগেও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। উভয় মেয়াদেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ। প্রতিশোধের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যের অনুপস্থিতিতে ডানে-বাঁয়ে যাকে পাচ্ছেন সবার বিরুদ্ধেই তিনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন বলে মনে হয়। ছায়াছবিতে হয়তো দেখেছেন, গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ চলতে নায়ক রামদা দিয়ে ডানে-বাঁয়ে কুপিয়ে পথ করে নিচ্ছেন।
ছিয়ান্নব্বইতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা একটা সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন। তারা বহু হত্যা-নির্যাতন করেছে। বহু চোরচোট্টা, দাগাবাজ আর খুনি এই ক্যাডারে ঢুকে পড়েছিল। ঢাকার মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. এইচবি ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডাররা বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। লক্ষ্মীপুরে গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে ছিনতাই করে। তাঁর বস্তাভর্তি টুকরো টুকরো লাশ পরে নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। শামিম ওসমানের অত্যাচারে নারায়ণগঞ্জের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শামিমের আফিসে মজুত বোমা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁরা কি শাড়ি পরেন নাকি, কেন তাঁরা একটার বদলে দশটা লাশ ফেলতে পারেন না।
চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা ক্যাডারদের মতো আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর গুণ্ডাদেরও লেলিয়ে দিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন করার কাজে। কয়েক হাজার লোককে তারা খুন করেছে। সেইসঙ্গে দলীয়কৃত পুলিশ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। র্যাব কয়েকশ’ কর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। এখন আবার চলছে ‘গুম’ করার পালা। সর্বশেষ গুম হয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এবং এ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তাঁর ড্রাইভার। তার কয়েক দিন আগে গুম হন সুরঞ্জিতের সহকারী একান্ত সচিবের ড্রাইভার, যিনি সে দুর্নীতি বিজিবির কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা ছাড়া ড্রাইভারদের গুম করার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না।
বহু হাজার মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়েছে এবং হচ্ছে সরকারের প্রতিভূদের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা ৭৮৬টি মামলা তুলে নেয়া হয়েছে। হালে ঘোষণা করা হয়েছে, আরও ২৯৭টি মামলা তুলে নেয়া হবে। ১৯ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বহু দুষ্কৃতকারীকে কারামুক্ত করা হয়েছে। এদের এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে।
বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছর আগাগোড়া ব্যর্থতা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মর্মান্তিক ইতিহাস। তার ওপরও পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি জাতির রক্ত চুষে খেয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি ব্যবসায়িক ‘গ্রুপ’ এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। তেত্রিশ লাখ স্বল্পবিত্ত মানুষ নিজেদের যত্সামান্য সঞ্চয় শেয়ারবাজারে নিয়োগ করেছিলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল সেটাও লুট করেছে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশের ভেতর টাকার স্বল্পতার এই হচ্ছে কারণ।
সরকারের নিয়ন্ত্রিত তদন্ত কমিটি লুটেরাদের তালিকাসহ যে রিপোর্ট দিয়েছে সরকার সেটাও গুম করে ফেলেছে। এই লুটপাটের যারা হোতা তাদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংক দু-দুটি প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজদের নামও বলে দিয়েছে। সেসব নাম প্রকাশ করার সাহস হচ্ছে না সরকারের। জনসাধারণ সঙ্গতভাবেই ধরে নিয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন।
বিপন্ন স্বাধীনতা, বিপন্ন সার্বভৌমত্ব
বাংলাদেশে এখন আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, বিচার নেই, সুশাসন নেই। সময়ে হয়তো সেসবেরও সংস্কার করা সম্ভব হতো, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ‘কমপ্রোমাইস’ করে সে সম্ভাবনার দ্বারও রুদ্ধ করে দিয়েছেন। ভারতকে বিনা মাশুলে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী এবং বন্দরগুলো, অর্থাত্ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের মূল উপাদানগুলো উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একথা সর্বত্রই বলাবলি হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের ক্ষতি করে ভারতের কল্যাণ-চিন্তায় ব্যস্ত থাকেন।
শুনেছি, বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগগুলোতে ভারতীয়রা উপদেষ্টা হয়েছেন। দুর্নীতি ধরা পড়ায় রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সীমান্তের ওপারের নির্দেশে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তাঁকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ প্রকৃতই বিপন্ন। এসব কি প্রমাণ করে না, শেখ হাসিনার প্রতিশোধ নেয়ার পালা আজও শেষ হয়নি? তাঁর নিহত বাবা-মা ও ভাইদের জন্য কেউ কাঁদেনি বলে আজও তিনি বাংলাদেশের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন?
বাংলাদেশের স্বল্পকালের রক্তঝরা ইতিহাসে বহু হিংস্রতা ও রক্তপাত ঘটেছে। পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগের চার নেতা কারাগারেই নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের কারও কারও ছেলেকে হাসিনা তাঁর সরকারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সর্বসাধারণ মনে করেছিল, বংশধরদের মন্ত্রীপদ দিয়ে হাসিনা নিহত নেতাদের স্মৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একটু খতিয়ে দেখলে মনে হবে, শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর প্রতিশোধের অভিযানে সহযোদ্ধাই খুঁজতে চেয়েছেন। বিকল্প ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরে হাসিনার প্রতিশোধ-স্পৃহা তাঁদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।
হাসিনার প্রথম সরকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। জেলে নিহত নেতাদের একজন ছিলেন তাঁর বাবা। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কাজকর্ম ও সিদ্ধান্ত প্রায়ই সাধারণ বুদ্ধিকে আহত করেছে। একসময়ে উচ্চ আদালতের বহু সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম বিচারকদের ভয় দেখাতে ‘গজারি কাঠের’ লাঠিধারী ব্যক্তিদের মিছিল নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ভবন প্রদক্ষিণ করেছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে অবশ্যি তেমন কিছু করার প্রয়োজন হয়নি। সরকার গঠনের শুরু থেকেই ‘কমিটেড’ আওয়ামী লীগপন্থীদের বিচারক নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে সরকার-সমর্থকদের গরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা পূরণের রায়গুলো সম্ভব হচ্ছে সে কারণে।
পার্ট-টাইম মন্ত্রীর পার্ট-টাইম মস্তিষ্ক
কারাগারে নিহত নেতাদের অন্য একজনের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অনেকেই বলে থাকেন, উভয় পদেই তিনি ‘পার্ট-টাইম’ দখলদার। ভাং কিংবা আফিমখোর ব্যক্তি যেমন মাঝে মাঝে সজাগ হয়ে চিত্কার করে ওঠে, সৈয়দ আশরাফও তেমনি কিছুদিন নীরব থেকে হঠাত্ করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়েন। তখন মনে হয়, অতীতের রাজা-বাদশাহদের মতো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করে ছাড়তেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, সৈয়দ আশরাফের মস্তিষ্কও তাঁর মতোই পার্ট-টাইম কাজ করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এর আগে দু’বারের সফর বাতিল করার পর ৫ মে ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বলে গেছেন, মার্কিন সরকার চায়, সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। সব দলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সংলাপের পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন তিনি। তাঁরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় দেশের মানুষ। মোটামুটি একই সময় লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও বলেছেন একই কথা।
হিলারি ক্লিনটন আরও একটা হুশিয়ারি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, এমন কাউকে সত্বর গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান নিযুক্ত করতে হবে, যাতে এই বিশ্ববিদিত প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে না যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর বর্তমান সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকের এবং গ্রামীণ ফোনের ওপর যে প্রধানমন্ত্রীর ছেলের লোলুপ দৃষ্টি আছে সেসব কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন হিলারি। তাঁর হুশিয়ারি ছিল সেজন্য।
‘গোমর ফাঁক’ হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় পার্ট-টাইম মন্ত্রী, পার্ট-টাইম মহাসচিব এবং ভারতের জামাই সৈয়দ আশরাফ গাত্রদাহ সামলাতে পারেননি। অমার্জিত এবং গণ্ডমূর্খের মতো আবোল-তাবোল সমালোচনা করেছেন তিনি ড. ইউনূস এবং কিছু পরিমাণে হিলারি ক্লিনটনের। সেইসঙ্গে নোবেল পুরস্কার কমিটি এবং যাঁরা কমিটির কাছে ড. ইউনুসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, পরোক্ষভাবে তাঁদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেছেন অন্তঃসারশূন্য সৈয়দ আশরাফ। আশরাফ বলেছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে হলে নাকি কোথাও না কোথাও যুদ্ধ থামাতে হয়। কোন কেতাবে তিনি পড়েছেন সে কথা? ড. ইউনূসের বিশ্ব-সম্মানিত ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার জন্য কেন তাঁর আকুতি?
কোথায় রানী রাসমণি আর কোথায় রইস্যার নানী?
বিশ্বনেতারা কি এতই হাভাতে যে ‘হোয়াইট ওয়াইন’ খেয়ে তাঁরা কাউকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সুপারিশ করবেন? অথবা নোবেল কমিটির সদস্যরা হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে কাউকে পুরস্কার দেবেন? তাই যদি হবে তাহলে শেখ হাসিনা কেন কূটনীতিকদের দেশে দেশে তদবির করতে পাঠিয়েও নোবেল পুরস্কার পেলেন না? আগের বারে তো আমলাদের বহু দেশে পাঠিয়ে ডক্টরেট খরিদ করানো হয়েছিল। তাও একটা-দুটো নয়, পুরো এক ডজন। বিশ্বনেতাদের কিংবা নোবেল কমিটিকে হোয়াইট ওয়াইন খাওয়ানোর সামর্থ্য কি হাসিনার আমলাদের আর কূটনীতিকদের ছিল না?
বুদ্ধিহীনতার প্রতিযোগিতায় সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে টেক্কা দিয়েছেন হাসিনার শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। তিনিও সিদ্ধান্ত করেছেন, ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। তাহলে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি কি এই দুই মূর্খ মন্ত্রীর নেত্রী? দিলীপ বড়ুয়ার বিদ্যার আরেকটা মাপকাঠি—তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধে কথা বলতে হলে রাজনীতিতে নামতে হবে ড. ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদকে। অরাজনীতিকদের কি ভোট দেয়ার অধিকার নেই? কেন তাঁরা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না?
শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের এই হচ্ছে নমুনা। মন্ত্রীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ লোকের মুখে মুখে। আরও কয়েকজন ষোলো আনা অথর্ব। অর্থমন্ত্রী কখন কী বলেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে এখন দেশের মানুষের মতো বিদেশিরাও হাসাহাসি করে।
ব্যতিক্রম মনে হয় সোহেল তাজকে। তাঁর বাবা তাজউদ্দিন আহমদ একাত্তরে নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পঁচাত্তরে জেলে নিহত নেতাদের তিনি অন্যতম। হাসিনা সোহেলকে স্বরাষ্ট্র দফতরে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। কিছুকাল পরেই তিনি আমেরিকায় পরিবারের কাছে ফিরে যান। প্রথমে তিনি ছুটির আবেদন করেন, পরে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান। তাঁর পদত্যাগ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। সম্প্রতি তিনি লক্ষ্য করেন, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আড়াই বছরের বেতন-ভাতা ইত্যাদি ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়েছে। সোহেল তাজ তার প্রতিবাদ করেন এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও পদত্যাগপত্র পাঠান স্পিকারের কাছে। হয়তো গণভবনের নির্দেশেই স্পিকার সোহেলের পদত্যাগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে যাচ্ছেন। সোহেল তাজ ক্রুদ্ধ হয়েছেন, বলেছেন, অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ গৃহীত এবং ব্যাংক থেকে তাঁর প্রাপ্য নয়, এমন টাকা ফেরত নেয়া না হলে তিনি অনেক গোমর ফাঁক করে দেবেন।
ধারণা করা হয় মন্ত্রীপদে কিছুকাল থেকেই সোহেল বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুর্নীতি আর অপকর্মের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন। গা-বাঁচানোর জন্যই তিনি আমেরিকায় ফেরত গিয়েছিলেন। কথা হচ্ছে, সরকার কেন চায় না যে তিনি মন্ত্রিত্ব কিংবা সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিন? একটা কারণ অবশ্যই এই যে, তাঁর আসন শূন্য হলে সেখানে উপনির্বাচন দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের গণসমর্থন-হীনতা প্রমাণ হয়ে যাবে। অন্য একটা কারণ অবশ্যই নিহিত আছে সোহেল তাজের হুমকির মধ্যে। কী গোপন তথ্য তিনি ফাঁস করতে চান এবং সে ভয়ে সরকারই বা কেন এমন আতঙ্কিত?
প্রাচ্যের মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতেও বিশ্বাস করা হয় যে, বিধাতা কাউকে ধ্বংস করার আগে তাকে উন্মাদ করে দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীদের আর সে দলের নেতাদের কাণ্ডকারখানা কি সে অবস্থারই ইঙ্গিত দেয় না? (লন্ডন, ১৩.০৫.১২)
serajurrahman34@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

ভিআইপিদের সফর বাংলাদেশকে কোথায় রেখে গেছে

ভিআইপিদের সফর বাংলাদেশকে কোথায় রেখে গেছে


॥ সিরাজুর রহমান ॥

যে ব্যক্তি এবং যে জাতি নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি তারা সব সময়ই আশা করে বসে থাকে ‘আত্মীয়বাড়ির লোকেরা’ তাদের জন্য মণ্ডা-মিঠাই আনবে, তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। কোথাকার কোন বিদেশী তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা বাংলাদেশে আসবেন সে নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়ার মাতামাতিতেও আমাদের পরমুখাপেক্ষিতার প্রমাণ বহন করে।
হিলারি কিনটন কিংবা প্রণব মুখার্জি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। স্বল্প সফরে হলেও তারা এসেছিলেন এবং তারা চলেও গেছেন। মামাবাড়ির অতিথিরা চলে যাওয়ার পর শিশুরা ভাবতে বসে, মিষ্টি কি তারা যথেষ্ট খেয়েছে, আরো কিছু খেতে পারলে মজা বেশি হতো। হিলারি আর প্রণবের সফরের পরে মিডিয়ারও যেন হয়েছে সে অবস্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি। বহু দেশে বহু ব্যাপারে সে এখনো কলকাঠি ঘোরায়। বাংলাদেশে অত্যন্ত দৃশ্যমান ভাবে ঘুরিয়েছিল ২০০৬-২০০৮ সালে। ভারতের রাষ্ট্রদূত আর কিছু পরিমাণে হলেও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে সাথে নিয়ে তারা একটা বর্ণচোরা সেনাশাসন চালু করেছিল। এখন আর বুঝতে বাকি নেই, একটা ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা অনুযায়ী বিএনপিকে ধ্বংস করা এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা ভারত-মার্কিন আজ্ঞাবহ সরকার স্থাপন করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই তিনটি দেশের পরিকল্পনা আর ইকোনমিস্ট সাপ্তাহিকীর ভাষায় ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা ও পরামর্শে’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর হিসাবে কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিল। অন্য বড় পৃষ্ঠপোষককে উপেক্ষা করে তিনি নিকটতম পৃষ্ঠপোষক ভারতের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ড. ইউনূসকে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বরখাস্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বহু দেশে ইউনূসের বহু গুণগ্রাহী ও বন্ধুকে আহত করেছেন। হিলারি কিনটন তখন দীর্ঘ টেলিফোন বার্তায় চাঁচাছোলা ভাষায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে মার্কিন কলকাঠি নাড়ানোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেছনের দরজা দিয়ে সে কথোপকথনের আক্ষরিক বিবরণ বিশ্ব মিডিয়ায় ফাঁসও করে দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভুল করেছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, আমেরিকা তার নতুন পাওয়া বন্ধু ভারতকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। সুতরাং ওয়াশিংটনকে হেনস্তা করে আসলে তিনি দিল্লিকে বিশেষ সন্তুষ্ট করেননি। দিল্লি তাকে চিরকাল গদিতে আসীন রাখবে এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি দিল্লির সব চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মার্কিন সরকারের অসন্তুষ্টির প্রমাণ হিসেবে হিলারি কিনটন বাংলাদেশে দু’টি প্রস্তাবিত ও নির্ধারিত সফর বাতিল করেছিলেন। তা সত্ত্বেও দিল্লির প্রভাবে ওয়াশিংটন ঢাকার প্রতি তার বিরক্তির বাড়াবাড়ি হতে দেয়নি। গত সপ্তাহে (৫ মে) একই দিনে হিলারি কিনটন আর ভারতের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত সফরে হলেও ঢাকা আগমন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। 

হিলারির ক্রোধের কি উপশম হয়েছে?
হিলারি ঢাকা এসেছিলেন চীন থেকে। তার বেইজিং সফরের সময় অন্ধ মানবাধিকার আইনজীবী চেনের ব্যাপার নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে লক্ষণীয় উত্তেজনা দেখা দেয়। হিলারির আসল উদ্দেশ্য তাতে কতখানি প্রভাবিত হয়েছে বলা কঠিন। বাহ্যতই তিনি অর্থনৈতিক বিষয়াদি (মূলত চীনের কাছে আমেরিকার বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি ও ঋণ) এবং সাধারণভাবেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার কার্যকাল শেষ হয়ে যেতে পারে। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু ও পরিচিতদের তিনি বিদায় সম্ভাষণ জানাতে চাইবেন।
কিন্তু আরেকটা ব্যাপার এখন ওয়াশিংটনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি করে চলেছে। ভারত মহাসাগরে বেশ ক’টি নৌঘাঁটি তৈরি করেছে সে। এতদঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব অত্যধিক বেড়ে যাক সেটা ওয়াশিংটনের কাম্য নয়। আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়া নিয়ে বেইজিংয়ের সাথে একটা স্বাভাবিক বৈরিতা ভারতেরও আছে। তবে চীনের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক বিরোধ হচ্ছে সীমান্ত নিয়ে। বিশেষ করে অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার মালিকানা নিয়ে ১৯৬২ সালের নভেম্বরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে, কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে একটা বলয় ও বেষ্টনী তৈরি করা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অভিন্ন স্বার্থ।
সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও আমেরিকা অনুরূপ একটা বেষ্টনী তৈরি করেছিল। তখন ভারত ছিল সোভিয়েটের প্রধান মিত্র। মার্কিন বেষ্টনী সে জন্য তৈরি হয়েছিল অবিভক্ত পাকিস্তানকে নিয়ে। কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা সেন্টো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিয়াটোতে পাকিস্তান সদস্য হয়েছিল। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় ১৯৭০-৭১ সালে বেইজিংয়ের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে অনেক উন্নতি হয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর ওয়াশিংটনের মনোযোগ পড়ে চীনের দিকে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে মত ও পথের ভিন্নতার কারণে পাক-মার্কিন সম্পর্ক এখন বড়জোর একটা ‘ক্ষুব্ধ পারস্পরিক সহনশীলতার’ স্তরে নেমে এসেছে। তা ছাড়া পাকিস্তান এখন চীনের সাথে বন্ধুত্বকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে। 
আরো একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার। চীনের বিরুদ্ধে তারা মিত্র হলেও ভারত মহাসাগরে প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে পারস্পরিক একটা রেষারেষিও আছে তাদের মধ্যে। বিগত কয়েক বছরে ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে দেখেছে দিল্লির চোখ দিয়ে। দিল্লির প্রতি নতজানু ভাব দেখে মার্কিনিরা ধরেই নিয়েছিল যে, বাংলাদেশ মার্কিনিদের নতুন মিত্র ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে না। কিন্তু অতি সম্প্রতি এতদঞ্চলে ওয়াশিংটনের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। 

উপদেশের পরিস্থিতিতে তৃতীয় মাত্রা
মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা খুবই সীমিত আকারে কিছু রাজনৈতিক সংস্কার করেছেন। তাদের এক ইঞ্চি সংস্কারের বিনিময়ে ওয়াশিংটন ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ইতোমধ্যে কয়েক গজ পুরস্কার দিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারকে। ওয়াশিংটন আশা করছে, বিনিময়ে চীনের প্রভাব কাটিয়ে মিয়ানমার পশ্চিমের দিকে ঝুঁকবে। তেমন অবস্থায় চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন বলয়টি বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রসারিত হবে। তা ছাড়া মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে বিপুল গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় মার্কিন তেল কম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগে নেমেছে। এই বিনিয়োগ রক্ষার নামে বঙ্গোপসাগরে একটা ‘ফুটপ্রিন্ট’ স্থাপন ওয়াশিংটনের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হবে। অর্থাৎ ভারতের চোখ দিয়ে দেখার পরিবর্তে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ওয়াশিংটন এখন সরাসরি নিজের চোখ দিয়েই দেখবে। হিলারি কিনটন ও প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত সফরকে এ আলোকেই দেখতে হবে। 
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানেই যার সাথে কথা বলেছেন, সবাইকে তিনি বলে দিয়েছেন, আগামী বছর সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় ওয়াশিংটন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে এবং অন্যত্রও তিনি বলেছেন, সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য বড় দুই দলকে সংলাপে বসতে হবে। ১৮ দলের জোটের প্রতিনিধি খালেদা জিয়া এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদ প্রমুখ যাদের সাথে তার দেখা হয়েছে, তারা সবাই হিলারিকে পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ছাড়া গত্যন্তর নেই।
হিলারি নিজেও কিছু স্পষ্ট কথা বলে গেছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে। তিনি বলে গেছেন, ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশ হওয়া এবং বস্ত্র শ্রমিকদের নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যা সম্বন্ধে তদন্ত হতে হবে। (প্রায় একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বলেছে, গুম আর খুনের ঘটনাগুলো বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপন করছে।) বাংলাদেশে মানবাধিকারের শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধেও হিলারি সরকারকে তম্ভি করে গেছেন। সরকারকে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছেন, গ্রামীণ ব্যাংককে অনুপযুক্ত কারো হাতে ন্যস্ত করা ওয়াশিংটনের গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিদের তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, আমিনুল ইসলামের হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন না হলে মার্কিন আমদানিকারকেরা বাংলাদেশকে সুনজরে দেখবে না অর্থাৎ বাংলাদেশের রফতানি (বিশেষ করে বিনা শুল্কে রফতানি) বৃদ্ধি পাবে না। 

প্রণব মুখার্জির নতুন বোধোদয়?
সবচেয়ে বড় কথা, হিলারি কিনটন বাংলাদেশ সরকারের আয়োজিত নৈশভোজের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে তিনি জানিয়ে দিয়ে গেলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর ওয়াশিংটন মোটেই প্রীত নয়।
প্রণব মুখার্জি বাহ্যত এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের যবনিকাপাত করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে, সেটা অছিলামাত্র ছিল। কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথাও তিনি ঘোষণা করেছেন। যেমন গত বছর বাংলাদেশকে ১.৭৫ শতাংশ সুদে দেয়া ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের ২০ কোটি মওকুফ ঘোষণা করেছেন তিনি এবং বলেছেন, সুদের হারও কমিয়ে ১ শতাংশ করা হবে। মনে হচ্ছেÑ এখানে কিছু ছাড় দিয়ে ভারত করিডোর, ট্র্যানজিট এবং বাংলাদেশী বন্দরগুলোর ব্যবহারও অনুদান হিসেবেই পেতে চায় বর্তমান সরকারের কাছ থেকে। প্রণব মুখার্জি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সাথে পুরনো চুক্তিগুলো কার্যকর করার লক্ষ্যে সর্বভারতীয় জনমত সৃষ্টি করতে চায়। 
দুই দেশের সম্পর্কে সব কিছুই যে সঠিক পথে যাবে না এ উক্তি থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ৬৫ বছর ধরে ভারত বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশী জমি ও ছিটমহল ইত্যাদি দখল করে আছে। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্তগুলোও ভারত পালন করেনি। দিল্লির দিক থেকে বক্তব্য : সব অঙ্গরাজ্যের সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না বলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা যাচ্ছে না। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর উপলক্ষে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। শেষ মুহূর্তে সই করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে সামান্যতম পানি দেয়ার ব্যাপারেও বেঁকে দাঁড়িয়েছিলেন। সমস্যা হচ্ছেÑ দিল্লি এ রাজ্য-সে রাজ্যের অজুহাত দেখিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর করছে না এবং লোকসান হচ্ছে বাংলাদেশের। এমন অনির্ভরযোগ্য চুক্তি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রণব মুখার্জির সফরের পরে দিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশকে কোনো আশার বাণী শোনানো হয়নি।

সুস্থ পরিবর্তন?
প্রণব বাবু এর আগে কোনো কোনো সফরে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ না করে কূটনৈতিক অসৌজন্য দেখিয়েছিলেন। আলোচ্য সফরে তিনি বেগম জিয়ার সাথে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করেছেন। আর একটা আশার কথা তিনি শুনিয়ে গেছেন এ সফরে। তিনি বলেছেন, ভারত বন্ধুত্ব করতে চায় বাংলাদেশের সাথে, বিশেষ কোনো দলের সাথে নয়। এত দিন পর্যন্ত ভারতীয় মন্ত্রীদের মধ্যে প্রণব বাবুই বেশি সোচ্চারভাবে বলতেন, ভারত শেখ হাসিনাকে গদিতে বহাল রাখবে। বাংলাদেশে কোন দল নির্বাচনে জয়ী হবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন ইত্যাদি সব ব্যাপারে ভারত যদি প্রকৃতই হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে সেটা প্রকৃত সুসম্পর্কের জন্য সহায়ক হতে পারে।
হিলারি ও প্রণবের সফরের পর থেকে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া কৌতুককর। সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের রণহুঙ্কার কিছুটা কমেছে। শাসক দলের মহাসচিব সংলাপের প্রয়োজন স্বীকার করে নিয়েছেন বলেই মনে হয়। ওদিকে বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে এক সপ্তাহের জন্য হলেও আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। মার্কিন ও ভারতীয় মন্ত্রীদের সফরকে সম্মান দেখিয়ে এগুলো বিএনপি নেতাদের ফাঁদে ফেলার জন্য আওয়ামী লীগের চালও হতে পারে। অন্য দিকে বিএনপির যে মহলটি আন্দোলনের বিপক্ষে তাদের ভাবখানা এমন যে, তারা লঙ্কা বিজয় করে ফেলেছেন। সেটা খুবই ভুল হচ্ছে বলে ধারণা। 
খুব সম্ভবত এ কৌশল আওয়ামী লীগ নিচ্ছে বিএনপির আন্দোলনকে শুধু ঝিমিয়ে দেয়া নয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে। আন্দোলন করে তারা যে বর্তমান সরকারের পতন ঘটাতে পারে, সেটা প্রমাণ করা বিএনপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চোখ রাঙিয়েছে, আন্দোলনের ভয় দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের সে দেমাগ অক্ষত থাকতে দেয়া কিছুতেই উচিত হবে না। বিদেশের চাপে পরবর্তী নির্বাচনে যদি বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট জয়ীও হয়, তাহলেও কথা থেকে যাবে কত দিন তারা খালেদা জিয়াকে শান্তিতে শাসন করতে, গদিতে টিকে থাকতে দেবে। গণ-আন্দোলনের জোয়ার পুরোপুরি থিতিয়ে পড়ার আগে ১৮ দলের জোটের নেতাদের উচিত হবে এ সরকারকে শেষ ধাক্কা দেয়া, এটা প্রমাণ করা যে, ভবিষ্যতে আর আন্দোলন-হরতালের হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে পারবে না।
সরকার এখনো তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি ফিরিয়ে আনেনি। ইলিয়াস আলীকে তারা এখনো মুক্তি দেয়নি। শীর্ষ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলাগুলো এখনো তুলে নেয়া হয়নি। বরং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রমুখ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আন্দোলনে ঢিল দিলে বিএনপি নেতারা দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হবেন। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কেউ আর কখনো আন্দোলনে যাবে না। 
(লন্ডন, ০৯.০৫.১২) 
serajurrahman34@gmail.com